শ্রীকান্ত গোস্বামী
তাঁর ‘আধখাওয়া আপেলে’ এখনও মজে গোটা বিশ্ব। তবু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দুনিয়ার এই সম্রাট ব্যর্থ হয়েছিলেন ক্যানসারের সামনে। আট বছর দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ২০১১ সালের অক্টোবরে মারা যান অ্যাপল-স্রষ্টা স্টিভ জোবস।
প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ে ক্যানসার হয়েছিল জোবসের। ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেন, ‘‘আট বছর সময় পেয়েছিলেন জোবস, অনেকের চেয়ে অনেক বেশি।’’ অধিকাংশ প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার রোগী ন্যূনতম চিকিৎসার সময়টুকু পান না। কারণ, ক্যানসার ধরা পড়তেই দেরি হয়ে যায়। যত দিনে ধরা পড়ে, রোগী তত দিনে ক্যানসারের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ ধাপে। ক্যানসার ধরা পড়ার পরে, মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ রোগী পাঁচ বছর বা তার বেশি বাঁচেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অন্ধকার অধ্যায়েই আলো ফেলেছেন এ রাজ্যের একদল গবেষক ও চিকিৎসক। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’-এর গবেষক শ্রীকান্ত গোস্বামী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানেরই সরোজকান্ত মহাপাত্র ও সংসিদ্ধি ভট্টাচার্য, এসএসকেএম-এর চিকিৎসক সুকান্ত রায়, ক্ষৌণীশ দাস, সুজন খামরুই, আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক সন্দীপ হালদার ও সোমদত্তা লাহিড়ী, চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ইন্দ্রনীল ঘোষ। প্যানক্রিয়াসের হেডমাসে ক্যানসার নির্ধারণ করতে পারে, এমন ‘বায়োমার্কার’ খুঁজে পেয়েছেন শ্রীকান্তেরা। গবেষকদের দাবি, এই পদ্ধতির সাহায্যে প্যানক্রিয়াসের মাথার দিকে হওয়া ক্যানসার দ্রুত ধরা পড়বে। কর্কটরোগ অগ্ন্যাশয়ে বাসা বাঁধার শুরুর দিকেই জানা গেলে, চিকিৎসার সুযোগ বাড়বে। ‘জার্নাল অব ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি।
আরও পড়ুন: শুধু বাজির ধোঁয়াই নয়, আগুন থেকেও বিপদ আসে
বিষয়টা আরও খোলসা করে বললে: ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস (অগ্ন্যাশয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ) এবং প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার— দুই রোগের ক্ষেত্রেই অগ্ন্যাশয়ের মাথার দিকে কিছুটা স্ফীত মাংসপিণ্ডের (হেডমাস) মতো তৈরি হয়। এই হেডমাসটি ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে তৈরি ‘বিনাইন’ (ক্যানসার নয় এমন) গোত্রের নাকি অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে তৈরি ‘ম্যালিগন্যান্ট’ গোত্রের টিউমার, তা বোঝা জরুরি। পরবর্তী চিকিৎসা এবং সেই চিকিৎসায় সাফল্য, পুরোটাই নির্ভর করছে এই প্রাথমিক চিহ্নিতকরণের উপরে।
গবেষক দলের প্রধান শ্রীকান্ত গোস্বামী জানান, বর্তমানে প্রচলিত পরীক্ষানিরীক্ষাগুলির কোনওটাই একেবারে ঠিক ভাবে অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার নির্ধারণ করতে পারে না। তাঁদের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল, এমন কিছু খুঁজে বার করা, যা কি না বলে দিতে পারে, অগ্ন্যাশয়ের ওই মাংসপিণ্ডে ক্যানসার আছে কি না। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে ‘বায়োমার্কার’। শ্রীকান্ত জানান, তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগীদের প্যানক্রিয়াস থেকে বাদ যাওয়া ‘হেডমাস’ বা স্ফীত মাংসপিণ্ড সংগ্রহ করেন। তার পর জিন এক্সপ্রেশন প্রোফাইল তৈরি করেন। অগ্ন্যাশয়ের কোষের সমস্ত জিন পর্যালোচনা করে ম্যালিগন্যান্ট মাংসপিণ্ডে তাদের সক্রিয়তা নির্ধারণ করা হয়। এ ভাবে পাঁচটি জিনের একটি ‘সিগনেচার’ পান বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুন: কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কাপ জনতার হাতেই
এর পরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের টিউমারে ওই জিনগুলির প্রকাশভঙ্গি বিশ্লেষণ করে দেখেন শ্রীকান্তেরা। দেখা যায়, সব ক্ষেত্রেই ওই সব জিন অতি সক্রিয়। অর্থাৎ এই জিনগুলোর সক্রিয়তাই বলে দিতে পারে, প্যানক্রিয়াসের মাথায় স্ফীত মাংসপিণ্ডে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে।
গবেষণাটি নিয়ে আশাবাদী আরজিকর-এর চিকিৎসক সোমদত্তা লাহিড়ী। শ্রীকান্তর টিমে রয়েছেন তিনিও। তাঁর কথায়, ‘‘এখন যে পদ্ধতিতে ক্যানসার নির্ধারণ হয়, তাতে অনেক সময় হেডমাসে ক্যানসার হয়েছে কি না, তা ধরা পড়ে না। শ্রীকান্তর খোঁজ দেওয়া বায়োমার্কার নিশ্চিত করে জানাতে পারবে। অবশ্যই নতুন ধরনের কাজ। উল্লেখযোগ্যও বটে।’’ এসএসকেএম-এর গ্যাস্ট্রোইন্টেসটিন্যাল সার্জন সুকান্ত রায় জানান, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্তদের শরীর থেকে হেডমাস বাদ দিয়ে, তা শ্রীকান্তদের দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে ওই রোগীর শারীরিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। সুকান্ত বলেন, ‘‘এর পরবর্তী কর্মকাণ্ডের যাবতীয় কৃতিত্ব শ্রীকান্তদের।’’