কার্টুন: শৌভিক দেবনাথ।
ক্যালেন্ডার জানান দিচ্ছে, দিনটা ১৪ নভেম্বর। ঝট করে ভাবলে মাথায় আসবে শিশু দিবসের কথা। তবে এ দিনটা শুধু তাতেই আটকে নয়, গুগলের পাতায় জ্বলজ্বল করছে আরও দু’-দুটো উপলক্ষ। রসগোল্লা আর ডায়াবিটিস— শত্রুশিবিরের দুই প্রধান সেনানীরও দিন আজ। ১৪ নভেম্বর এক দিকে যেমন বিশ্ব রসগোল্লা দিবস, তেমনই এই একই দিনে আবিশ্ব পালন করছে ডায়াবিটিস দিবসও! এর চেয়ে বড় আখড়াই কুস্তির বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে!
আর এই দিন নিয়েই বাঙালি এক অদ্ভুত দোলাচলে পড়েছে। যে দোদুল্যমানতার দৃষ্টান্ত সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি! বন্ধুর ছেলের বিয়ের পর তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন সঞ্জীব। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই উঠে ফ্রিজ খুলে কিছু একটা দেখে ফিরে আসছেন বন্ধু। বার পাঁচেক এমন হওয়ার পর সঞ্জীববাবু জানতে চাইলেন, ‘‘বার বার উঠে ফ্রিজে কী দেখিস?’’ হাই ডায়াবেটিক বন্ধু জানালেন, ‘‘গিয়ে দেখে আসি ফ্রিজে কী কী ধরনের আর ক’টা রসগোল্লা আছে।’’ আকাশ থেকে পড়েন সঞ্জীববাবু! ‘‘তোর না সুগার!’’, বন্ধুর সপ্রতিভ উত্তর: ‘‘হ্যাঁ, তাতে কী? দেখতে তো বারণ না!’’
রসগোল্লা আর ডায়াবিটিস এই দুই দিবসকে একই দিনে পালন করার মধ্যে বিদেশিদের ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন চিকিৎসক সুশোভন সরকার। শহরতলির এমন এক এন্ডোক্রিনোলজিস্ট, যাঁর নিজেরই ১২ বছর বয়স থেকে ডায়াবিটিস রয়েছে। আর তার সঙ্গে সমান তালে রয়েছে রসগোল্লা খাওয়ার লোভও! কিন্তু ‘ষড়যন্ত্র’ কেন? এমন এক দিনে চিকিৎসকদের প্রতিনিধি হয়েও তাঁর ভোট রসগোল্লা দিবসের দিকেই। সুশোভনবাবুর মতে, ‘‘বাঙালির রসগোল্লার প্রতি টান রুখে যাতে আরও বেশি করে বেকড রসগোল্লা বিদেশে রফতানি হতে পারে, সেই কৌশলকে কাজে লাগাতেই মনে হয় এই একই দিনে দুটোকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে ভোট রসগোল্লাকেই, কারণ রসগোল্লা খেলেই ডায়াবিটিস হবে, এ ধারণা ভুল। কিন্তু হ্যাঁ, রসগোল্লা বাদ পড়বে বাড়াবাড়ি রকমের ডায়াবিটিস ইতিমধ্যেই থাকলে।’’
আরও পড়ুন: লক্ষণ প্রকাশের অনেক আগেই শরীরে স্তন ক্যানসার বাসা বেঁধেছে কি না জানিয়ে দেবে এই রক্ত পরীক্ষা!
আরও পড়ুন: এই ডায়েটে কফির ম্যাজিক! ব্যায়াম ছাড়াই ঝরবে মেদ, অল্প অনিয়মেও শরীর থাকবে ঝরঝরে
কিন্তু মাঝেসাঝে একটাও নয়? খানিক ক্ষণ চুপ। তার পর ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ বলেই বসলেন, ‘‘আরে রাখুন তো মশাই ডাক্তারের কথা! মাঝেসাঝে একটা চলবে! ওতে কোনও দোষ নেই। তবে ভয় একটাই, এই ‘এক-আধটা’ অঙ্কের হিসেব বুঝে উঠতে পারেন না বেশির ভাগ ডায়াবিটিস রোগীই। প্রতি বার খাওয়াকেই ‘এক-আধটা খাই’ বলে দেগে দেওয়ায় বিপদ আছে কিন্তু!’’
বাধানিষেধের কথা খুব একটা মানতে রাজি নন ‘রসগোল্লা’-র ইতিহাস নিয়ে ছবি তৈরি করা পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কাছে আবার মুড়ি আর রসগোল্লা, এই দুই বৈশিষ্ট্যই বাঙালিকে ‘বাঙালি’ বানায়। কিন্তু ডায়াবিটিসের ভয়? ‘‘বিন্দুমাত্র নেই, জানেন আমার বংশে কারও ডায়াবিটিস নেই!’’ ঝেঁঝে উঠলেন পরিচালক। কথায় কথায় জানিয়ে দিলেন, ‘‘রসগোল্লার লোভকে যদি ডায়াবিটিস দিয়েই জয় করা যেত, তা হলে ‘রসগোল্লা’ মুক্তির দিন যে আমরা যখন সবাইকে হল-এ রসগোল্লা খাওয়ালাম, কই? কোনও রিফিউজাল আসেনি তো! ভিয়েন কে সি দাস বেঁচে থাকুক!’’
রসগোল্লা মোটে ফেরাতে পারেন না ডায়াবিটিসের রোগী সঞ্জয় চক্রবর্তীও। যদিও বিলক্ষণ জানেন, সমস্যা বাড়তে পারে, তবু ওই ‘এক দিন খেলে কিছু হবে না’— এই স্তোকবাক্যে ভর করে প্রায় দিনই লুকিয়ে মাঝরাতে ফ্রিজের দরজা ধরে টান মারেন তিনি। তাঁর সোজাসাপ্টা হিসেব, ‘‘রসগোল্লার টান এতই প্রবল যে তা মৃত্যুভয়কেও ডোন্ট কেয়ার করাতে পারে। খাওয়ার সময় ভয় যে একটু পাই না তা নয়, তবে আবার আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, অন্য নিয়ম আরও বেশি করে মানলে এটুকু পাপস্খালন হতে পারে।’’
তাই? সত্যিই কি এক-আধটা মিষ্টি খুব একটা ক্ষতি করে না? প্রশ্নটা শুনেই হেসে ফেললেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। নিজেও ভীষণ রসগোল্লা খেতে ভালবাসেন, নিন্দুকেরা বলেন, ডাক্তার হওয়ার সুবাদেই বোধ করি ঘুরপথে ডায়াবিটিসকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন! সাফ জানালেন, বয়স বাড়ছে তো, তাই এখন রসটা চেপে বার করে খাই কখনওসখনও, আর খুব বিপদগ্রস্ত না হলে রোগীদেরও এক-আধটা মিষ্টি খাওয়ার পরামর্শ দিই। বাঙালির পেটে ওই এক-আধটা রসগোল্লা কোনও অসুখই বাড়ায় না। তবে হ্যাঁ, রয়েসয়ে খান, লোভে পড়ে অনেকগুলো খেয়ে ফেললে বিপদ বাড়বে। তাই এমন দিনে খাওয়ার পাশাপাশি শরীর সচেতনও থাকতে হবে।’’
সন্দেহপ্রবণ হলে, মনে হতেই পারে, একই দিনে দুটো দিবস পালন করার অর্থ, এক দিকে যেমন বাঙালির রসেবশে থাকার সহজাত স্বভাবকে উস্কে দেওয়া, আর এক দিকে সেই স্বভাবের গোড়াতেই সজোরে ঘা মারা।
এমন দিন নিয়ে বড়ই বিপদে পড়েছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অল্প ডায়াবিটিস নিজের আছে বটে, তবে কোনও মিষ্টিই খুব একটা ভালবাসেন না। এ দিকে বাড়িতে প্রচুর মিষ্টি আসে। আনেন অতিথিরাও। সে সব মিষ্টি বাড়ির ছোটরা খেলেও বাকিটা দানখয়রাতি করতে হয়। শীর্ষেন্দুবাবুর মতে, ‘‘ভয় হয় বুঝলে! কোনও ভদ্রলোক বোধ হয় আজকাল রসগোল্লা নিতে চান না, তবে দেখেছি গরিব মানুষদের দিলে বেশ খুশি হন! তবে এই একই দিনে রসগোল্লা দিবস আর ডায়াবিটিস দিবস হয়ে একটা বিষয় বেশ প্রমাণিত— রসনা আর অসুখ মোটেও কেউ কারও শত্রু নয়! একটু সতর্ক থেকে খেলে পুরোটাই আনন্দের।’’
রসগোল্লাকে এমন মোহময়ী করে তোলার জন্য যাঁদের হাতযশের কাছে বাঙালি চিরকৃতজ্ঞ, সেই নবীন ময়রার উত্তরসূরী কে সি দাশের কর্মীরাও এই একই দিনে দুই ‘যুযুধান শত্রু’র দিবস পালন হওয়ায় বেশ মজা পেয়েছেন। ব্যবসায়িক স্বার্থ মাথায় রেখেও তাঁরা কিন্তু শরীর ও ইচ্ছেয় ভারসাম্য বজায় রাখতে বলছেন। এমন এক দিনে মিষ্টিবিক্রেতাদের প্রতিনিধি কে সি দাশের অন্যতম কর্ণধার ধীমান দাশ এই দুই দিনের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নিতে বললে স্বচ্ছন্দে বেছে নিচ্ছেন রসগোল্লাকেই। তাঁর মতে, এন্ডোক্রিনোলজিস্টরাও যেমন দু’-এক দিন অন্তর এক-আধটা রসগোল্লায় কোনও দোষ দেখেন না, তেমনই ডায়াবিটিস রোগীদের দোষ দেখে না কে সি দাশও। তাই ৫০ বছর আগেই ডায়াবিটিস আক্রান্তদের জন্য বিশেষ রসগোল্লা বানিয়ে আসছেন তাঁরা। সেই রসগোল্লা খেলে বাড়বে না ডায়াবিটিস, কমবে না স্বাদ!
১৪ নভেম্বর। ডায়াবিটিস আর রসগোল্লার মিলমিশ ঘটানোর দিন। এ যেন ধরেবেঁধে দুই বিপরীত চরিত্রকে বিয়ে দেওয়া। চিল-কাক বসতে না-পারা দাম্পত্যে সেখানে চুঁইয়ে পড়ে মমত্বের রস, টেবিলে জমে থাকে অসুখবিসুখ ঠেকানোর ওষুধপত্র। এ ভাবেই সুখে বাঁচে বাঙালির পরিবার।