আজকের ছেলেমেয়েরা, যারা স্কুলপর্ব শেষ করে স্নাতক স্তরে প্রবেশ করছ এবং নিজেদের কর্মজীবনের কথা ভাবতে শুরু করেছ— তাদের একটু স্পষ্ট ধারণা করে নিতে হবে ভবিষ্যতের ব্যবসার ধরন কোন দিকে চলেছে আর কাজের সম্ভাবনা কোথায় তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে। আজকের ছবিটাই কিন্তু তার জন্য যথেষ্ট নয়, ভাবতে হবে পাঁচ বা দশ বছর পরের কথাও। কারণ, তোমার কাজের জন্য সে সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিকে তাকালে দেখব, সমানেই চাহিদা বাড়ছে সাহিত্য ও কলাবিভাগের বিষয়গুলিতে সহজাত দক্ষতার। অথচ বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়ুয়াদের সে বিষয়ে ধারণা বেশ ক্ষীণ। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য যে কোনও বিষয়ে তাদের একটা উদাসীনতা।
এত দিন প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি চেষ্টা করেছে মানুষের কায়িক পরিশ্রম বা হিসাবনিকাশের মানসিক পরিশ্রমকে কমিয়ে আনতে। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞানের বিষয়ভিত্তিক তালিমই হয়তো প্রযুক্তিক্ষেত্রে নিজের জীবিকা গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটেছে একটা পরিবর্তন, আরও ঘটবে। সেটা হল— প্রযুক্তি এখন এগিয়ে চলেছে মানুষের মনের চলনকে ধরতে, আর তাকে ব্যবসায় পরিণত করতে।
এই যেমন, আজকাল আমরা যখন গুগ্ল-এ কিছু খুঁজতে চাই, বেশ অবাক হয়ে দেখি যে আমার ভাবনার চলন গুগ্ল কেমন আগে আগেই জেনে ফেলেছে, আর সেইমতো আমাকে তথ্য জোগাচ্ছে। অবাক লাগে ভেবে, আমি কী জানতে বা দেখতে চাই, সেটা এই সফটওয়্যার ‘বুঝল ক্যামনে’। ব্যাপারটা কিন্তু কাকতালীয় নয়, এর পিছনে আছে এক সুবিশাল কর্মকাণ্ড। সহজে বলতে গেলে, এটাই হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধা। আগামী দিনগুলোতে এই কৃত্রিম মেধাকে কেন্দ্র করে নানা রকম ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হবে— তা সে গুগ্ল-এর মতো সার্চ ইঞ্জিন হোক, আর ফেসবুক-এর মতো সোশ্যাল মিডিয়া, বা এমন কোনও সফটওয়্যার হোক, যা শিক্ষা বা চিকিৎসার মতো বিষয়েও মানুষের আগে আগে চলবে। তা ছাড়াও আছে কত রকমের অনলাইন বাজার— যারা সারা ক্ষণ বুঝতে চেষ্টা করছে মানুষ কী চায়, তার চিন্তার ধরন কোন পথে চলে, কী ভাবে বিপণনের লোভ দেখানো যায়।
ভবিষ্যতের খেলাটা যখন হতে চলেছে মানুষের মনকে বোঝার, এবং তার মতো করে সফটওয়্যার তৈরি করার— তখন প্রথাগত ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞানশিক্ষার সীমাবদ্ধতা প্রকট হতে শুরু করেছে। আমাদের সাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষা এই তালিম-ই দেয় যে একটি প্রশ্নের একটি উত্তরই হয়। গবেষণার স্তরে পৌঁছে না গেলে তার বাইরে কিছু ভাবার বা অজানাকে খোঁজার কোনও তাগিদ তৈরি হয় না।
কিন্তু মানুষের মন সে ভাবে চলে না— তার অনেক স্তর, অনেক রং, নানান চলন। সেখানে আছে আবেগ, অনুভূতি, আবার নানা রকম রিপুর প্রভাবও। সেই সব কিছুকে হিসেবে নিয়ে কোনও প্রশ্নের বহুমাত্রিক উত্তর খোঁজা এবং সেই সব সম্ভাবনার জালকে ধরতে পারা— তার জন্য লাগে একটা অন্য রকম দক্ষতা। আর সেখানেই একটা ওলটপালট এখন ঘটে যাচ্ছে— প্রযুক্তিক্ষেত্রেও বিরাট চাহিদা তৈরি হচ্ছে এমন মানবসম্পদের, যারা ‘অন্য রকম’ ভাবে ভাবতে পারে। আজকের সফটওয়্যার ক্ষেত্রে যারা কর্মী নিয়োগের দায়িত্বে, তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাচ্ছেন— সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, এই সব বিষয়ে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা না থাকলে বেশি দূর উন্নতি করা কঠিন। যত দিন যাবে, ততই প্রোগ্রাম লেখার কাজগুলো সহজ হতে থাকবে। চাহিদা বাড়বে তাদের, যারা মানুষের মনস্তত্ত্ব আর চিন্তার জটিলতাকে ধরতে পারবে একটা লজিকের কাঠামোয়, যার থেকে প্রোগ্রাম তৈরি হবে।
সেই প্রেক্ষিতেই আজকের ছেলেমেয়েদের অনুরোধ: বিজ্ঞানের বিষয়ের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও আগ্রহ বাড়াও। সিলেবাসের বইয়ের বাইরেও নানা রকম বই পড়ার অভ্যেস তৈরি করো। এটা বুঝে নেওয়া ভাল যে, স্বপ্নের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলেও সমাজ ও সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগ জরুরি। বিদেশের কাজ দিয়ে শুরু হলেও, এখন কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিতে মূল প্রসার ঘটছে আমাদের দেশের বাজার ধরার লক্ষ্যেই, শহর ছেড়ে গ্রামেও তা প্রভাব ফেলছে। তাই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাপত্রও পড়া দরকার, নিজের দেশের সমাজকে জানা দরকার। স্কুলে পড়ার সময় থেকে সেই চর্চা শুরু করতে না পারলে পরে তা প্রায় অসম্ভব। তাই এ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব থেকে যায় অভিভাবকদের, যাঁদের একটা বড় অংশ ছেলেমেয়ের বাংলা ভাষা না-জানাটাকে প্রায় একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট-এ পরিণত করে ফেলেছেন।
লেখক ইনকিউব-এর অধিকর্তা