গত ছ’-সাত মাস ধরে সারা পৃথিবীর মতো আমরাও এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে বন্দি। তোমাদের সবার স্কুল কলেজের বিল্ডিং-এর সঙ্গে আড়ি; বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা হল, শপিং মল— কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অনলাইনে পড়াশোনা চলছে ঠিকই, কিন্তু বন্ধুরা ছাড়া স্কুলই বা কী, আর পড়াশোনাই বা কী। পরীক্ষা চলছে অনলাইনে, কোর্সও শেষ করতে হচ্ছে। কিন্তু সব সময়েই যেন একা একা, যেন কী নেই কী নেই।
এরই মধ্যে আর ক’টা দিন পরেই পুজো। অন্য বার পুজোয় ঘোরার সব প্ল্যান মোটামুটি রেডি হয়ে যায়। কিন্তু এ বছরটা সব ওলোটপালট। বেরোনো আদৌ যাবে কি না, জানা নেই। বেরোলেও এই অবস্থায় কতটা ঘুরতে পারবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। যদি পুজোর ক’টা দিনের বেশির ভাগ সময়ই বাড়িতে বসে বা টিভিতে ঠাকুর দেখে কাটে, তা হলে কী করে পার হবে সময়? সমস্যার সমাধান আছে হাতের কাছেই, শুধু অবহেলায় চোখে পড়েনি।
বইপোকার জগৎ
একা থাকা সামাজিক মানুষের অভ্যাস নয়। একা থাকতে থাকতে তাই হাঁপিয়ে পড়ছি আমরা সবাই। ভিডিয়ো কলে আর কতটুকু দূরত্ব মেটে! এই ক’মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে থাকতে গিয়ে সেটার মোহও কেটে যাওয়ার পথে। আর ভাল লাগছে না!
এমন যদি হয়, বাড়ি থেকে বেরোতে হল না, মায়ের কাছে বেশি ঘ্যানঘ্যানও করতে হল না, সেই এক ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামও নয়, কিন্তু একটুও একা লাগল না। উল্টে অনেক মানুষ হঠাৎ জীবন্ত হয়ে তোমার চারপাশে ঘুরে বেড়াল। এত জীবন্ত যে, যখন মলাট বন্ধ করলে, মনে হল যেন তারা সঙ্গেই থেকে গিয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার চোটে বই পড়ার অভ্যাসটা হয়তো চলে গিয়েছে, কিন্তু ছোটবেলায় তো পড়তে। পুজোয় বাড়িতে থাকার সময় একটা বই বার করে পড়তে বসো যদি? প্রথমে মন বসাতে পারবে না হয়তো। তাতে কী? সাহস করে চেষ্টা চালিয়ে যাও। আগে পুজোর সময়ে তো পূজাবার্ষিকীর গল্পগুলো পড়ে ফেলার জন্য উসখুস করতে। ছোটবেলার সব থেকে প্রিয় বইটা দিয়েই শুরু করো বরং।
পছন্দের বই
ছোটবেলার সব থেকে প্রিয় বইটার নাম মনে আছে কি? না, না, ‘হ্যারি পটার’ নয়। তারও আগে, সেই ‘ফেমাস ফাইভ’ পড়ার সময়কার কথা। মনে আছে, ক্লাস ওয়ানের জন্মদিনে বাবার সঙ্গে গিয়ে ‘ফেমাস ফাইভ’-এর অনেক অনেক বই একসঙ্গে নিয়ে ফেরা? কী আনন্দই না হয়েছিল সে দিন! জন্মদিনে যত বন্ধুরা এসেছিল, তারাও কত লাফালাফি করেছিল। তোমার পড়া হয়ে গেলে এক এক করে তারাও নিয়েছিল বইগুলো। মা বলেছিলেন, কে কোন বই নিচ্ছে, তাদের নামগুলো সুন্দর করে লিস্ট করে রাখতে। তুমি একটা ছোট্ট নোটবুকও করেছিলে, সেই সব নাম লেখার জন্য।
এর পর তুমি আর তোমার বন্ধুরা উঁচু ক্লাসে উঠলে, পড়াশোনা বাড়ল। ভুলেই গেলে প্রিয় বইদের কথা। শুধু কি ‘ফেমাস ফাইভ’, আরও তো কত ছিল! ‘ম্যালোরি টাওয়ার্স’, ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’… এমনকি, অত প্রিয় নোটবইটা, যেখানে সব বইয়ের নাম লিখে রাখতে, সেটাও কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছ।
ধুলো ঝেড়েঝুড়ে আবার বার করে ফেলবে নাকি বইগুলো? উল্টেপাল্টে দেখবে নাকি তাদের? আর নোটবইটা? সেটাও খুঁজে পেতে পারো হয়তো। দেখো তো, সেই সব বন্ধুরা এখনও বন্ধু আছে কি না! না কি বাবা-মায়ের চাকরির জন্য অনেক দূরের শহরে চলে গিয়েছে? তুমি হয়তো ভুলেই গিয়েছ তার কথা। নোটবই মনে করিয়ে দেবে তোমার গল্পের বই পড়ার সেই পুরনো সঙ্গীকে।
বলেছিলাম না, বাড়িতে একা ঘরেই হঠাৎ অনেক মানুষ এসে জড়ো হবে? কখনও বইয়ের পাতা থেকে, কখনও স্মৃতির পাতা থেকে।
যদি বাড়িতে পুরনো দিনের বইপত্র রাখার জায়গা থেকে থাকে, সেখানে এক বার খুঁজে দেখো কোনও ছোটবেলার পুজোসংখ্যা পাও কি না। বইটার সঙ্গে সে বারের পুজোর স্মৃতির আমেজ হয়তো এই সময়ের মনখারাপটা কিছুটা হলেও কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলা কী দোষ করল?
অন্য কোনও পরীক্ষার আগে যা হয় না, এই পরীক্ষার আগে তা-ই হয়। না, অঙ্ক নয়; সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ, মানে বাংলা সাবজেক্টের কথা বলছি। কত বকুনি খাও মায়ের কাছে! এমনকি ঠাকুমা, যিনি অন্য কোনও ব্যাপারে তোমার উপর রাগ করেন না, তিনিও বাংলা পড়া নিয়ে তোমাকে কত বার কত কিছু বলেছেন!
তাই একটা কাজ করা যাক। বাড়িতে বন্দি থাকার সময়টা ঠাকুমা বা মায়ের কাছে একটু বাংলা ভাষা নিয়ে বসে পড়া যেতে পারে। জানি, বাংলা ব্যাকরণ খুব খারাপ লাগে, বাংলা ভাষার রচনা লিখতে গায়ে জ্বর আসে; ইংরেজি স্ক্রিপ্টে বাংলা লেখো যেমন হোয়াটসঅ্যাপে, তেমনটাই যদি লেখা যেত, কী ভালই না হত!
পড়ার বাংলা বই, বাংলা ব্যাকরণ থাক। তার থেকে বরং বাংলায় গল্প শোনা হোক। মোটা মোটা উপন্যাস পড়তে যদি ইচ্ছে না-ও করে, ‘ফেলুদা’, ‘ঘনাদা’ বা ‘ব্যোমকেশ’-এর গল্পের বইগুলো তো আছে। তুমি আর মা বা ঠাকুমা মিলেই না হয় রিডিং পড়লে। তুমি ফেলুদা পড়ে শোনালে, ঠাকুমা বা মা ব্যোমকেশ।
আর পড়তে শুরু করলেই বুঝতে পারবে, কেন বাংলা বই না পড়ার জন্য মা-ঠাকুমা এত রেগে যায়। কত যে গল্প, কত যে উপন্যাস। মা আর ঠাকুমার কালেকশনের অল্প কিছু পড়তে পড়তেই তোমার সময় হুস করে চলে যাবে। চাঁদের পাহাড় উপন্যাসের কিছুটা অংশ তোমরা তো সিলেবাসে পড়েছ। জানো, উপন্যাসটা লিখতে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে সশরীরে চাঁদের পাহাড়ে যেতে হয়নি। বাড়িতে বসে শুধু বিভিন্ন বইপত্রের সাহায্যেই তিনি লিখে ফেলতে পেরেছিলেন ওই অপূর্ব প্রাণবন্ত বর্ণনা। তার সঙ্গে লেখকের নিজস্ব কল্পনা, লেখনীশক্তি আর অসামান্য প্রতিভা তো ছিলই।
বুঝতে পারছ তো, শুধু বইয়ের উপর ভরসা করে, তাদের ডানায় ভর দিয়ে তুমি কত দূর যেতে পারো?
ইংরেজিও পড়তে হবে
তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছ, যাদের ফার্স্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ইংরেজি নয়, বাংলা। অর্থাৎ, যারা মূলত বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ো। মনে রেখো, মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার সুবিধে অনেক, তবে ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনার গুরুত্বও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তাই বাংলা গল্পের বই পড়তে বেশি ভাল লাগলেও, ইংরেজি গল্পের বইও পড়তে হবে। প্রথমে ইংরেজি খবরের কাগজে পছন্দের পাতা দিয়ে শুরু করতে পারো। যদি খেলার খবর পড়তে ভাল লাগে, তার মাধ্যমেই ইংরেজি পড়া যেতে পারে। সে জন্য আলাদা করে ইংরেজি খবরের কাগজও নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইন্টারনেটে এখন সব কাগজেরই ই-ভার্সান থাকে। পছন্দমতো বেছে নিলেই হল।
ইংরেজি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কখন যে ভয় কেটে যাবে, বুঝতেই পারবে না। আর তখনই সাহস করে আর এক ধাপ এগিয়ে যাও। নতুন নতুন ইংরেজি বইয়ের গল্প ছোট করে বলা থাকে ইন্টারনেটের অনেক সাইটে। এখন কী রকম বই বেরোচ্ছে, কোন বই পুরস্কার পাচ্ছে, সব খবরই হাতের মুঠোয়। কিছু দিনেই এমন অভ্যাস হয়ে যাবে যে, আলাদা করে মনেই থাকবে না যে, কোনও বিদেশি ভাষায় বই পড়ছ।
ফলাফল দেখে তুমিই অবাক
করোনা আতঙ্কের মধ্যেই দিন, মাস, বছর এগিয়ে চলেছে। সেই ভাবেই এসে পড়বে পরীক্ষার সময়ও। হয়তো অনলাইনেই হবে সব পরীক্ষা, তবু পরীক্ষা তো। তবে সে সব পরীক্ষার ফলাফল যখন বেরোবে, দেখবে তুমিই অবাক হয়ে যাচ্ছ! বাংলা বা ইংরেজি, ফার্স্ট ল্যাঙ্গোয়েজ হোক বা সেকেন্ড— তোমার নতুন দক্ষতায় নম্বরগুলো ঝলমল করবে। গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন যে তোমার ভাষার দক্ষতা জন্মেছে, কখন যে নিজেই শিখে ফেলেছ ব্যাকরণের নির্ভুল বাক্যগঠন, দেখবে নিজেই বুঝতে পারোনি।
তখন বন্দি দিনগুলোতে তোমার নতুন বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাতে ভুলো না যেন! দেখো, ওই বইয়ের তাকগুলো থেকে তারাও তোমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসছে। সবার পুজো কাটুক ভাল।