অনির্বাণ, পৌলমী দু’জনেই খড়্গপুর আইআইটি-র কৃতী। বছর বত্রিশের অনির্বাণ ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছেন। আর ত্রিশের কাছাকাছি পৌলমী সেখানকারই সহায়ক গবেষক ছিলেন। বিষয় ছিল গ্রামোন্নয়ন। সেই সূত্রেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা-বাগান লাগোয়া গ্রামে যাওয়া শিলিগুড়ির অনির্বাণের।
বন্ধ চা-বাগান লাগোয়া গ্রামগুলি ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না অনির্বাণ নন্দী এবং পৌলমী চাকী নন্দী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এসেছিলেন গ্রামোন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করতে। লক্ষ্য ছিল, গবেষণা শেষে চাকরিবাকরি খুঁজে দেশের অন্যত্র বা বিদেশে গিয়ে থিতু হবেন। কিন্তু সেই গ্রামই কখন যেন ওঁদের দু’জনের জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। এখন সব কিছু ছেড়েছুড়ে বন্ধ চা-বাগান লাগোয়া গ্রামগুলি ছাড়া ওঁরা আর কিছুই ভাবেন না। ভাবতে চানও না শহর থেকে আসা যুগল— অনির্বাণ নন্দী এবং পৌলমী চাকী নন্দী।
লাল রঙের ছোট্ট গাড়িটার পিছনের দিকে তাকে-সাজানো বই। সবই স্কুল-কলেজের পাঠ্য। আর সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন। এই গাড়ি নিয়েই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান তরুণ দম্পতি। চা-বাগানের মানুষজন তাঁদের দু’জনকে ‘মোবাইল লাইব্রেরি জুটি’ নামে চেনেন। মুখোমুখির সম্বোধনে ‘দাদা’ ও ‘দিদি’। বন্ধ হয়ে যাওয়া চা-বাগান সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের ছেলেমেয়েরা ওই জুটির কাছে লেখাপড়ার পাঠ নেয়। জীবনশিক্ষারও। বিনিময়ে সম্মানদক্ষিণা মাসে ১০ টাকা। শুধু শিক্ষাই নয়, ওই গ্রামগুলির নারীস্বাস্থ্যের বিকাশও অনির্বাণ-পৌলমীর লক্ষ্য। বই-খাতা-কলম দেওয়া, পড়ানোর পাশাপাশি তাই নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনও বিলি হয় ওই লালগাড়ি থেকে। প্রায় ৮ হাজার নারী ওঁদের মধ্যেই আজ প্রাথমিক স্বাস্থ্য-ভরসা খুঁজে পেয়েছেন।
অনির্বাণ, পৌলমী দু’জনেই খড়্গপুর আইআইটি-র কৃতী। বছর বত্রিশের অনির্বাণ ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডি করেছেন। আর ত্রিশের কাছাকাছি পৌলমী সেখানকারই সহায়ক গবেষক ছিলেন। বিষয় ছিল গ্রামোন্নয়ন। সেই সূত্রেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন চা-বাগান লাগোয়া গ্রামে যাওয়া শিলিগুড়ির অনির্বাণের। মা সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। ছোট থেকেই মায়ের লড়াই দেখে বড় হওয়া অনির্বাণ এখনও বিশ্বাস করেন, মেয়েরা খুবই ক্ষমতাধারী হন। সে কারণেই বন্ধ চা-বাগানের ওই সব গ্রামের দুঃস্থ নারীদের দেখে খারাপ লাগত। গবেষণার কাজ করতে করতে মনে হওয়া শুরু, এঁদের জন্য যদি কিছু যায়! অনির্বাণ বলছিলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের গ্রামোন্নয়ন নিয়ে গবেষণার কাজ যখন শুরু করি, পাহাড় থেকে সমতলের বিভিন্ন পথে ঘুরেছি। নানা কিছু কর্মকাণ্ড মাথায়। কিন্তু বাস্তবায়িত করতে পারছিলাম না। ২০১৭-য় বিয়ের পর সবটা আবার নতুন করে পরিকল্পনা করলাম। এখন প্রায় ১৬টা চা-বাগান আর ৩০টা গ্রামে আমরা যাই। পড়াই। বইপত্র দিই। ওঁদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখি। আমাদের এখন বৃহৎ পরিবার।’’
লাল রঙের ছোট্ট গাড়িটার পিছনের দিকে তাকে-সাজানো বই। সবই স্কুল-কলেজের পাঠ্য। আর সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন। এই গাড়ি নিয়েই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান তরুণ দম্পতি। —নিজস্ব চিত্র।
শুরুর দিনগুলো আজও স্পষ্ট মনে আছে পৌলমীর। বিয়ের পর অনির্বাণের সঙ্গে একের পর এক চা-বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন। তখনই সমস্যাটা প্রকট ভাবে নজরে আসে। এই সব এলাকার মহিলাদের ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। ফলে নানা রকম যৌন-সমস্যা এবং শারীরিক অসুবিধায় ভোগেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের আশঙ্কা তৈরি হয়। ত্বকেরও নানা সমস্যায় ভোগেন তাঁরা। এ সবের কোনও ঠিকঠাক সমাধান চা-বাগানে পাওয়া যায় না। তার পরে রয়েছে লোকলজ্জার ভয়। ফলে, সমস্যা প্রতিদিন বাড়তে থাকে।
অনির্বাণের আবার মাথায় ঘুরছিল অন্যান্য সমস্যা। তার মধ্যে সবচেয়ে চিন্তার— স্কুলছুট। ডানকানস্, গঙ্গারাম টি এস্টেটের মতো ডুয়ার্সের বড় বড় বাগান বন্ধ হয়েছে। পেটের দায়ে স্কুল ছেড়ে ছেলেমেয়েরা ঢুকেছে দিনমজুরির কাজে। কেউ কেউ একটু বেশি টাকার কারণে চলে যাচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ আবার ভিন্ দেশে যাবে বলে হারিয়েও যাচ্ছে। অনির্বাণ বলছিলেন, ‘‘এমন একাধিক উদাহরণ ছিল আমাদের কাছে। শিক্ষা ছাড়া এ সব সমস্যার সঙ্গে লড়াই করার আর কোনও অস্ত্রের কথা আমাদের জানা ছিল না।’’ পৌলমীর কথায়, ‘‘মনস্থির করেছিলাম, আমরা দু’জন এদের জন্য লড়ব। কাজে লাগল আগে থেকে করা আমাদের সেই গবেষণা। সমীক্ষা করা শুরু করলাম। একটা গ্রামে কত জন মেয়ে রয়েছে, ছেলেও বা কত জন, পড়ুয়ারা কোন ক্লাসে পড়ে, পরিবারে কত জন— সবটার খবর নেওয়া শুরু করলাম গ্রাম ধরে ধরে। সেই সমীক্ষা মোতাবেক একটা গাড়ি করে বই, খাতা ও স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে রওনা দিলাম চা-বাগানে। প্রথমে নিজেরাই কিছু বই কিনি। এর পর পরিচিতেরাও সাহায্য করেন।’’
গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টেছে। যে গ্রামের মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই ছিল না, আজ তাঁদেরই কেউ নার্সিং পড়ছেন, কেউ জিএনএম পড়ছেন, কেউ আবার বাইরে গিয়েছেন ডাক্তারি পড়তে। কেউ কেউ তো চাকরিও পেয়ে গিয়েছেন। —নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু গ্রামের মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন বার করতেই পালিয়ে যেত। পৌলমী বলছিলেন, ‘‘এখন যদিও গ্রামের মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়ায় স্যানিটারি প্যাড নেওয়ার জন্য। পুরুষরা নিজেরাই আশপাশ থেকে সরে যায়। প্রত্যন্ত গ্রামে স্যানিটারি প্যাড প্রকাশ্যে বিলি করা কিন্তু শহরের মতো সহজ নয়।’’ অনির্বাণের কথায়, ‘‘বিষয়টা অনেকটাই সহজ হয়েছে সঙ্গে পৌলমী থাকায়। মহিলারা এসে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারছেন। এখন তো মেয়েদের বাবা বা স্বামীরা আসছেন ন্যাপকিনের জন্য। দূর হয়েছে লজ্জা। একটা সময় দেখা যায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য ভিড় বাড়ছে। আর সেই সুযোগেই হাতে ধরিয়েছি পড়ার বই।’’
ধীরে ধীরে মোবাইল লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। পরিচিত জনদের কাছে পুরনো বই জমা দেওয়ার আবদার করতে থাকেন অনির্বাণ-পৌলমী। বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিচিত জনেরা জানাতেন, তাঁদের কাছে বই আছে। নন্দী-দম্পতি পৌঁছে যেতেন সেখানে। সেই সময় থেকে আজ— শুধুমাত্র মোবাইল লাইব্রেরির বই রাখার জন্য ওঁদের দুটো গুদাম বানাতে হয়েছে। গ্রামে গিয়ে ইচ্ছুকদের হাতে বই তুলে দিতেন ওঁরা। কিন্তু গোল বাধল, বই ফেরত দেওয়া নিয়ে। বই নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনও খবর নেই মাসের পর মাস। সেটাকেও নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হয়েছে। অন্যান্য লাইব্রেরির মতোই নিয়ম চালু করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি অনির্বাণ-পৌলমী শুরু করেন ‘কমিউনিটি টিচিং’। শুধু মোবাইল লাইব্রেরি বা স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়, শুরু হল পড়ানো। সম্মানদক্ষিণা ১০ টাকা। কারণ বিনা পারিশ্রমিকে কিছু করালে, তার আবেদন অনেক সময় কমজোরি হয়ে যায়। শুরু হয় ১০ টাকার ‘টিউশন’। প্রথমে অনির্বাণ ও পৌলমী শুরু করলেও, পরে আরও অনেকেই তাঁদের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন। এর পর শুরু হয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। অনির্বাণের কথায়, ‘‘শিক্ষার বৈষম্য দূর করাটা অত্যন্ত জরুরি। শহরের ছেলেমেয়েরা যে পদ্ধতিতে শিক্ষা পায়, গ্রামের বা চা-বাগানের পড়ুয়ারা তা পায় না। কিন্তু যে কোনও ধরনের চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কিন্তু কোনও বৈষম্য থাকে না। তাই আমরা কোয়ালিটি এডুকেশন দেওয়ার চেষ্টা করি।’’ এখন গ্রাম প্রতি একটা করে কম্পিউটার রয়েছে। পালা করে চলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।
শুধু মোবাইল লাইব্রেরি বা স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়, শুরু হল পড়ানো। সম্মানদক্ষিণা ১০ টাকা। কারণ বিনা পারিশ্রমিকে কিছু করালে, তার আবেদন অনেক সময় কমজোরি হয়ে যায়। শুরু হয় ১০ টাকার ‘টিউশন’। —নিজস্ব চিত্র।
গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টেছে। যে গ্রামের মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই ছিল না, আজ তাঁদেরই কেউ নার্সিং পড়ছেন, কেউ জিএনএম পড়ছেন, কেউ আবার বাইরে গিয়েছেন ডাক্তারি পড়তে। কেউ কেউ তো চাকরিও পেয়ে গিয়েছেন। পৌলমী বলেন, ‘‘এ সবের পাশাপাশি স্বনির্ভর হচ্ছে গ্রামের মেয়েরা। মাশরুম চাষ শেখানো হয়েছে তাঁদের। সেই মাশরুম যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়।’’
নকশালবাড়ির লোহাসিং গ্রামের পূজা রাউতিয়া দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তার মা চা-বাগানে পাতা তোলার কাজ করেন। তার কথায়, “আমরা দুই বোন। মা বলেছিল, মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা চালাতে পারবে না। মোবাইল লাইব্রেরি থেকে আমি বই-খাতা পাই। ১০ টাকায় টিউশন নিই। আমার বোনও নেয়। ইংরেজি, কম্পিউটার, অর্থনীতি— সবই পড়ায় দাদা-দিদি। এ বছর নার্সিংয়ের জন্য আবেদন করব।”
আর এ সব দেখে-শুনে অনির্বাণ-পৌলমী কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন। নিজেদের নিরাপত্তা মাখা জীবন ছেড়ে গ্রামের উন্নয়নে এ ভাবে মিশে যাওয়াটাকে সৌভাগ্য বলেই মনে করেন ওঁরা।
জীবন তো এক প্রকার গবেষণাই। সেই গবেষণাগারেই কাজ করে চলেন সাধারণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই দুই অ-সাধারণ।