ভিএস অচ্যুতানন্দন
ঠিক ৫০টি বসন্ত আগে এক বার ওয়াক আউট করেছিলেন। সদলবল। সে বার ছিল ভিন্ রাজ্যে তেনালি কনভেনশনের মঞ্চ। অর্ধ-শতাব্দী পরে আবার দলের সম্মেলন-মঞ্চ থেকে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে গেলেন সে দিনের তরুণ নেতা। এ বার নিজের জন্মভূমি আলাপুঝায়। সে দিনের তরুণ এখন নবতিপর। এবং নিঃসঙ্গ!
সিপিএমের কেরল রাজ্য সম্মেলনের আসর শনিবার অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ ভিএস অচ্যুতানন্দনের কক্ষত্যাগে। দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাজকর্মের বিরুদ্ধে সম্মেলনের ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে চিঠি দিয়েছিলেন কেরলের বিরোধী দলনেতা। তাতে ক্ষুব্ধ দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী রীতিমতো নজিরবিহীন ভাবে ভিএসের নামে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করেছিল! রাজ্য সম্মেলনে পেশ হওয়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্টও প্রবল ভাবে ভিএসের বিরুদ্ধে। শুক্রবার সন্ধ্যায় সম্মেলনে সেই রিপোর্ট পেশ হওয়ার সময় থেকেই অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে একের পর এক প্রতিনিধিকে তাঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগতে দেখে এ দিন দুপুরে সম্মেলন কক্ষ ছেড়ে সটান আলাপুঝায় নিজের পুরনো বাড়িতে ফিরে গেলেন সিপিএমের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য! মঞ্চে বসে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট তখন হতবাক এবং নিথর!
আরও বড় নাটক অবশ্য এ দিনই ঘটে যেতে পারত। যদি না তড়িঘড়ি সম্মেলন ছেড়ে বৃদ্ধ নেতার কাছে দৌড়তেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। ভিএস ফিরে গিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলে দিয়েছিলেন, এ দিনই তিনি দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা করবেন! সম্মেলনের মাঝখানে এবং আগামী বছর কেরলে বিধানসভা নির্বাচনের আগে যা ঘটলে সিপিএমের মাথায় বড় বজ্রাঘাত হতো! ইয়েচুরি গিয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে সম্মেলনে ফিরিয়ে আনতে পারেননি ঠিকই, তবে ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত করতে পেরেছেন বলেই খবর। অর্থাৎ, গোল লাইন সেভ। যদিও ইয়েচুরি-ঘনিষ্ঠ এক নেতা বলছেন, “সেভ আর কী! যখন তখন ফের গোল হয়ে যেতে পারে!”
প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে কেরল সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। দলের পলিটব্যুরো সদস্য কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন বলেছেন, “ভিএস ওয়াক আউট করেননি। ব্যক্তিগত কারণে দলকে জানিয়েই চলে গিয়েছেন। গোটা সম্মেলনে কাউকে বসে থাকতে হবে, এমন কোনও নিয়ম তো নেই!” বালকৃষ্ণনের ব্যাখ্যা তথ্যের খাতিরে একেবারে অসত্য নয়। তবু বিতর্ক ঢাকা যাচ্ছে না। কেরল সিপিএমের এক নেতার কথায়, “সম্মেলনের প্রতিবেদনটা এ বার যেন ভিএসের নামে চার্জশিট! সকালে এ দিন কান্নুর (পিনারাই বিজয়নের জেলা) এবং কোল্লমের (এম এ বেবির জেলা) প্রতিনিধিরা ভিএসের প্রবল সমালোচনা শুরুর পরে উনি প্রথমে কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন এ সব বন্ধ করার জন্য। কেউ কিছু করছেন না দেখে উঠে পড়ে রীতিমতো প্রকাশ কারাটকে ‘গুড বাই’ বলে বেরিয়ে যান! একে ‘বলে গিয়েছেন’ বলা যেতেই পারে!”
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতৃত্বের লাইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ১৯৬৪ সালে তেনালি কনভেনশন থেকে ওয়াক আউট করে সিপিএম গড়ার দিকে এগিয়েছিলেন যে ৩২ জন, তাঁদের জীবিত দুই সদস্যের এক ভিএস। রাজনীতির এমনই মোচড় যে, ৫০ বছর পরের ওয়াক আউটের পরে এ বার তাঁকে কেরলের রাজ্য কমিটি থেকেও বিদায় দিতে চান দলের রাজ্য নেতৃত্ব! বৃহত্তর সঙ্কট এড়াতে কারাট-ইয়েচুরিরা সক্রিয় হয়ে রাজ্য নেতৃত্বকে নিরস্ত করেন কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
এই সম্মেলনেই কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ভিএসের প্রবল প্রতিপক্ষ পিনারাই বিজয়ন! তাঁর জায়গা নেবেন বালকৃষ্ণনই। সিপিএম সূত্রের খবর, যাওয়ার আগে ভিএস-কে একেবারে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন বিজয়ন। তাই লাভালিন মামলায় বিজয়নের পক্ষে দাঁড়ালে আইনজীবীদের কী ভাবে হেনস্থা করতেন ভিএস, সেই কাহিনি থেকে শুরু করে ভূরি ভূরি দল-বিরোধী কাজের অভিযোগ আনা হয়েছে সম্মেলনের রিপোর্টে। কিন্তু সেই বিড়ম্বনা ‘গুড বাই’ বলে বিজয়নদেরই ফিরিয়ে দিলেন ভিএস!