সাম্রাজ্য উদ্ধারে স্ট্যালিনই বাজি ‘কালাইনারে’র

রোমাপুরী পাণ্ড্যিয়ান। তামিল রাজা পেরুভারুথি পাণ্ড্যিয়ানের সঙ্গে সুদূর রোম সাম্রাজ্যের মিত্রতার কাহিনী। সেই ঐতিহাসিক উপন্যাসকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে মেগাসিরিয়াল। ভোটের মরসুমে রমরমিয়ে চলছে। ডিএমকে-র সদর দফতরে ঢুকতেই তার বিরাট হোর্ডিং। তামিলনাড়ুর রাজনীতির সঙ্গে এই মেগাসিরিয়ালের সম্পর্কটা কোথায়? বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে দেখলেই জবাব মেলে। ঔপন্যাসিকের নাম এম করুণানিধি। দ্রাবিড় রাজনীতির এই বৃদ্ধ সম্রাটের নিজের জীবনও এখন যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা গল্প।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

চেন্নাই শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১২
Share:

ব্যানারে পিতা-পুত্র। —নিজস্ব চিত্র।

রোমাপুরী পাণ্ড্যিয়ান। তামিল রাজা পেরুভারুথি পাণ্ড্যিয়ানের সঙ্গে সুদূর রোম সাম্রাজ্যের মিত্রতার কাহিনী। সেই ঐতিহাসিক উপন্যাসকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে মেগাসিরিয়াল। ভোটের মরসুমে রমরমিয়ে চলছে। ডিএমকে-র সদর দফতরে ঢুকতেই তার বিরাট হোর্ডিং।

Advertisement

তামিলনাড়ুর রাজনীতির সঙ্গে এই মেগাসিরিয়ালের সম্পর্কটা কোথায়? বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে দেখলেই জবাব মেলে। ঔপন্যাসিকের নাম এম করুণানিধি। দ্রাবিড় রাজনীতির এই বৃদ্ধ সম্রাটের নিজের জীবনও এখন যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা গল্প।

এক দিকে তাঁর রাজ্যপাট নিয়ে দুই পুত্রের লড়াই। সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন বিতাড়িত জ্যেষ্ঠ পুত্র আলাগিরি। পৈতৃক সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে ‘বাইরের শত্রু’ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও হাত মেলানোর কথা ভাবছেন। অন্য দিকে তাঁর কন্যা কানিমোঝি, ভাগ্নে-পুত্র দয়ানিধি মারান থেকে শুরু করে প্রিয় শিষ্য এ রাজার নামে দুর্নীতির কালিমা। ইউপিএ-সরকারের টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির জালে জড়িয়ে রয়েছে করুণানিধির গোটা পরিবার। চির প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের অভাব নেই মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার হাতে!

Advertisement

লড়াই তাই ঘরে ও বাইরে। যা সামাল দিতে এই নব্বই বছর বয়সেও গোপালপুরমের দোতলা বাড়ি থেকে প্রতি সন্ধ্যায় স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ারে বসেই বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে করুণানিধিকে। তিনি যে অনুগামীদের প্রিয় ‘কালাইনার’। শিল্পী। নিখুঁত চিত্রনাট্য তাঁর। কোনও দিন এম জি আর নগর, কোনও দিন রোয়াপুরমে যাচ্ছেন সভা করতে। করুণানিধি পৌঁছলেই সভায় আতসবাজির আলো। চেণ্ডা মেলমের ঢাক। কম্বু সানাই। হুইলচেয়ারে বসেই মঞ্চে ওঠেন তিনি। এ আর রহমানের তৈরি ‘থিম সং’ শুরু হয়ে যায়। সঙ্গীর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান করুণা। কালো চশমার পিছন থেকেই মেপে নেন ভিড়। মুখে হাসি ফোটে। জনতা ‘ডক্টর কালাইনার’-এর নামে জয়ধ্বনি দেয়। নিজের চেয়ারে বসে বক্তৃতা শুরু করেন করুণানিধি।

‘আম্মা’ জয়ললিতার সম্মোহন কাটিয়ে, তামিল হৃদয় জয় করতে করুণানিধির আসল বাজি অবশ্য তিনি নিজে নন। কনিষ্ঠ পুত্র এম কে স্ট্যালিন। বৃদ্ধ পিতা জরাগ্রস্ত শরীর নিয়ে চেন্নাইয়ের বাইরে যেতে পারেন না। স্ট্যালিনের রথ ছুটছে কন্যাকুমারী থেকে কাঞ্চিপুরম। মুখে সব সময় এক গাল হাসি। গত বছরই তাঁর মাথায় উত্তরসূরির মুকুট পরিয়ে দিয়েছেন করুণা। এ বার লোকসভা ভোটে ডিএমকে-র আসল সেনাপতি তিনিই। যেখানেই থাকুন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় জয়ললিতা প্রচারে গিয়ে কী বলছেন, তার দিকে নজর রাখছেন। তার পর পাল্টা আক্রমণ শানাচ্ছেন। প্রশ্ন তুলছেন, জয়ললিতা কি ভোটের পরে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবেন? না হলে মোদীকে নিয়ে নীরব কেন উনি? অথচ এই মোদী-জুজু দেখিয়ে সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা করতেই তো মুসলমান দলগুলির সঙ্গে জোট বেঁধেছেন! স্ট্যালিনের এই খোঁচার মুখেই মোদীর সমালোচনায় মুখ খুলতে হয়েছে জয়ললিতাকে।

প্রচারে নেমে তামিলনাড়ুর উন্নয়নের জয়গান গাইছেন জয়ললিতা। স্ট্যালিন পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, পানীয় জলের অভাব নিয়ে। বিদ্যুতের অভাব নিয়ে। বলছেন, “এ বার তো ট্রেলার। সিনেমাটা দেখবেন ২০১৬-র বিধানসভায়।” বোঝাই যায়, তাঁর পাখির চোখ তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর গদি। তাঁর দল দুর্নীতির প্রশ্নে জেরবার হয়ে গেলেও স্ট্যালিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি। ডিএমকে-র অন্যতম শীর্ষনেতা, সহ-সম্পাদক ভি পি দুরাইসামি বলেন, “ছ’বছর চেন্নাইয়ের মেয়র, পাঁচ বছর রাজ্যের মন্ত্রী, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন স্ট্যালিন। তাঁর সাদা জামা আর ধুতিতে কেউ এক ছিটে কালিও লাগাতে পারেনি। পরিবারতন্ত্র নয়, একেবারে নিচুতলার রাজনীতি থেকে শুরু করে সংগঠনের শীর্ষস্তরে উঠে এসেছেন। পার্টির সবাইকে চেনেন। দলের সব প্রার্থী নিজে বাছাই করেছেন।”

আর এটা নিয়েই অভিযোগে সরব দাদা আলাগিরি। তিনি বলছেন, টাকা নিয়ে টিকিট বিলি করেছেন স্ট্যালিন। দল থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন ডিএমকে-প্রার্থীদের হারানোর শপথ নিয়েছেন আলাগিরি। স্ট্যালিনও জানেন, মাদুরাই-সহ দক্ষিণ তামিলনাড়ু দাদার এলাকা। সেখানে তাঁর রথের চাকা বসে যেতেও পারে। আলাগিরি তো ছোট ভাইকে ‘ভিলেন’ বলতেও ছাড়েননি! প্রকাশ্যে বলছেন, বাবা মোটেই তাঁকে তাড়াতে রাজি ছিলেন না। ভাই বাবার গলায় ছুরি ধরে দাদাকে দল থেকে তাড়ানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন। বাবাকে দাস বানিয়ে রেখেছে ভাই। সব কিছু হস্তগত করতে চাইছে। আন্নাসলাই হোক বা কে কে নগর, চেন্নাইয়ের যে কোনও পাড়ার আড্ডায় যোগ দিলেই জানতে পারবেন, এই ‘সব কিছু’ মানে শুধুই রাজ্যপাট আর সিংহাসন নয়। তার থেকেও বেশি হল ডিএমকে ট্রাস্টের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। স্ট্যালিন ডিএমকে-র কোষাধ্যক্ষ। তাঁর পকেটেই কোষাগারের চাবি। সেই কোষাগারের দখল নিয়েই দুই ভাইয়ের মল্লযুদ্ধ। কত টাকার সম্পত্তি? আমজনতা অবশ্য তার আন্দাজই করতে পারে। হিসেব কষতে পারে না।

জয়ললিতা তথা এডিএমকে-নেতাদের অভিযোগ, স্পেকট্রাম দুর্নীতির ঘুষের টাকা রয়েছে করুণার দুই স্ত্রী-র সিন্দুকে। প্রথম স্ত্রী পদ্মাবতীর মৃত্যুর পর দু’বার পাণিগ্রহণ করেছেন করুণা। আলাগিরি-স্ট্যালিন-তামিলারাসুর মা দয়ালু আম্মালকে তিনি ডাকেন ‘মানাইভি’ বা ‘স্ত্রী’ বলে। দয়ালু থাকেন গোপালপুরমের বাড়িতে। এক কিলোমিটার দূরের সিআইটি কলোনির বাংলোয় থাকেন আরেক স্ত্রী, কানিমোঝি-র মা রজতী আম্মাল। যাঁকে করুণা ‘থুনাইভি’ বা সঙ্গিনী বলে সম্বোধন করেন। করুণানিধি কাজকর্ম করেন দয়ালুর বাড়িতে বসে, বিশ্রাম নেন রজতীর বাংলোয়। গোটা চেন্নাই জুড়েই করুণানিধি এবং তাঁর ভাগ্নে মারানদের পরিবার ও ট্রাস্টের অগুন্তি বাংলো, স্থাবর সম্পত্তি। এডিএমকে নেতারা খোলাখুলিই বলছেন, ওই সব সম্পত্তির ইট-কাঠ-পাথরে লুকিয়ে রয়েছে স্পেকট্রাম দুর্নীতির অর্থ।

এক দিকে জয়ললিতার উন্নয়নের প্রচার। আম আদমির মন জয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প। তিন বছর আগে চতুর্থ বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসা জয়ললিতা এ বার কেন্দ্রে বড় ভূমিকা নিতে চাইছেন। উল্টো দিকে মনমোহন-জমানার সবথেকে বড় দুর্নীতির বোঝা করুণানিধি ও তাঁর পরিবারের ঘাড়ে। ডিএমকে নেতারা বলছেন, কংগ্রেস তাঁদের ঘাড়ে দুর্নীতির দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইছে। কিন্তু ভোটের পরে প্রয়োজনে ফের সনিয়া গাঁধীর কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁরা হাত মেলাবেন কি না, সেই প্রশ্নেও

রোমাপুরী পাণ্ড্যিয়ান মেগাসিরিয়ালের দারুণ ভক্ত আন্নাসলাইয়ের রেস্তোঁরার ম্যানেজার সুথি বালা সালেম। তিনি পুরনো উপন্যাসেই আজকের রাজনীতির রূপ খুঁজে পেয়েছেন রসিক মানুষটি। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইতালির সনিয়া গাঁধীর মিল টেনে বালার মন্তব্য, “করুণানিধির গল্পের রাজা রোম সম্রাটের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। কালাইনার ফের ইতালির সনিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন না দিল্লির রাজনীতিতে একঘরে হয়ে পড়েন, মেগাসিরিয়ালের সেই এপিসোডটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছি!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement