মুম্বই মনতাজ

রবি বললেন, ‘আমি বড় কৃপণ’

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’— এই শ্রদ্ধেয়, গালভরা নামটি শোনা মাত্র আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। গর্ব ভরে কণ্ঠ মেলাই ‘জনগণমন’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’র সঙ্গে। অথচ, বঙ্গদেশ বা ভারতবাসীরা কয় শতাংশ নামে চেনে বা তাঁর লেখার, ছবির সঙ্গে পরিচিত, হলফ করে বলা খুব মুশকিল। নামে আমরা বুক ফুলিয়ে বলি— বিশ্বকবি। গোটা বিশ্বের কত জন মানুষ তাঁর সঙ্গে, তাঁর কাব্যের সঙ্গে পরিচিত— বলতে পারেন?

Advertisement

মিলন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share:

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’— এই শ্রদ্ধেয়, গালভরা নামটি শোনা মাত্র আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। গর্ব ভরে কণ্ঠ মেলাই ‘জনগণমন’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’র সঙ্গে। অথচ, বঙ্গদেশ বা ভারতবাসীরা কয় শতাংশ নামে চেনে বা তাঁর লেখার, ছবির সঙ্গে পরিচিত, হলফ করে বলা খুব মুশকিল। নামে আমরা বুক ফুলিয়ে বলি— বিশ্বকবি। গোটা বিশ্বের কত জন মানুষ তাঁর সঙ্গে, তাঁর কাব্যের সঙ্গে পরিচিত— বলতে পারেন? ইদানীং কালের সঠিক সেনসাস রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে— সাক্ষর ও নিরক্ষরের মধ্যে ফারাক হল চুয়াত্তর পয়েন্ট সামথিং এবং পঁচিশ পয়েন্ট সামথিং। যে কেউ নিজ নামটিকে, যে কোনও উপায়ে— কলম না ভেঙে লিখতে পারেন— তিনিই ‘লিটারেট’। চৌকাঠের বাইরে পা রাখার দরকার নেই। ঘরের রক্ষেকালীকেই তো নিজের পিতৃদত্ত নামটি শিখিয়ে পড়িয়ে ‘কাজ’ করতে শিখিয়েছিলুম বছর দু’এক আগে। দেখে দেখে নকল করতে করতে এখন এবড়ো-খেবড়ো হলেও স্বাধীন ভাবে অই ‘স্বাক্ষর’ করতে পারে। যখন প্রথম প্রথম এসেছিল, কথায় কথায় একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম তো শুনেছ, কালী-মা’’?

Advertisement

ওর পাল্টি প্রশ্ন ছিল, “কোথায় থাকে? হাবড়ার কাছে হলে চিনতে পারি।— তা ছাড়া, কোন কোন বাড়িতে ঠাকুরমশাই যজমানি করেন জানতে পারলেও হয়তো চিনব—।”

এই তো আমাদের দেশ! কবিগুরুর ‘ভারতবর্ষ’!! শতকরা পাঁচ জনও কবির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিনা, আমার সন্দেহ। তার কারণ, তথাকথিত শিক্ষিতরাই কত দূর ওঁর লেখা পড়েছেন বা মাঝে মধ্যে উল্টেপাল্টে দেখেন— সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। একে, ওঁর অত অত ভিন্ন বিষয় মাধ্যমে সৃষ্টি, ছাপোষা শিক্ষিত মানুষের পক্ষে, ঘর-সংসার রেখে, এক জীবনে পড়ে ওঠা অসম্ভব।

Advertisement

এখানে বা স্রেফ পশ্চিমবঙ্গে রবিঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ি কোথায় জিগ্যেস করল্ চেট্ করে টালা বা টালিগঞ্জের একজন মুচি বা মেথর নাও জানতে পারেন। অথচ, কয় দশক আগে পশ্চিমে, ইউরোপে ঘুরছিলুম কয়েকটি একক ছবির প্রদর্শনী নিয়ে। প্যারিসে সাঁ মিশেল এলাকায় ভোরবেলা খুঁজছি একটি ব্যক্তিগত মিউজিয়ম। পথঘাটে জনপ্রাণী নেই। সহসা একজন সাধারণ কর্পোরেশনের ঝাড়ুওয়ালাকে দেখলুম। ইউনিফর্ম পরে লম্বা লাঠিওয়ালা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তার কুটোকাটা, কাগজ ইত্যাদি পরিষ্কার করছে। কাছে গিয়ে শুধোলুম, “মঁসিয়েঁ এখানে শিল্পী পিকাসোর ব্যক্তিগত জাদুঘরটি কোথায়, দয়া করে বলবেন?”

মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ থামিয়ে খুবই উদ্বেগ মেশানো কণ্ঠে জানালেন ফরাসী ভাষায়, “পার্দঁ মঁসিয়ে।ঁ আপনি তো ভুল করে সাঁ মিশেলে চলে এসেছেন—”।

তার পরে বুঝিয়ে বললেন, সাঁমিশেল মেট্রো স্টেশনে ফিরে গিয়ে অমুক স্টেশনে চলে যান। রাস্তার ওপরেই একটি ছবি বাঁধাইয়ের দোকান আছে। ওখানে জিগ্যেস করলেই ওঁরা দেখিয়ে দেবে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অতি সাধারণ মানুষে মানুষে এত তফাত!

অপর পক্ষে, তথাকথিত আই এ, বি এ বা নানান বিজ্ঞান-টিজ্ঞান পাশ দেওয়া অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ির হলঘরে দেখেছি দেওয়াল জোড়া বইয়ের শেলফ। ইংরিজি ও বাংলা। মোটা মোটা সব বইয়ে বোঝাই। সুন্দর করে গোছানো। দেখেই বোঝা যায়, নিত্য ঝাড়পোঁচ হয়। তার মধ্যে দেখেছি— রবীন্দ্র রচনাবলীর সব ক’টি খণ্ড। গোরা, চোখের বালি থেকে গীতবিতান, সঞ্চয়িতা— সব দুটো তাকে সাজানো। থান ইট সাইজের বিভিন্ন ভাষার অভিধান পাশে।

একদিন জিগ্যেস করে জেনেছিলুম, উনি পড়েননি। ছুঁয়ে, খুলেও দেখেননি। অবসরপ্রাপ্তির পর ‘দেখবেন, পড়বেন’ বলে কিনে রেখেছেন। এখন এত কাজকর্মের জীবনে সময় কোথায়?

এই জাতীয় পাঠক বা পাঠিকা কবির জীবিত কালেও ছিলেন। এখন তো ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ গোছের দশা। সবচেয়ে মজার কথা প্রসঙ্গত, এখন রবি ঠাকুরের বইয়ের বিজ্ঞাপন দরকার হয় না শিক্ষিত সমাজে। তবে, কবির জীবিত কালে তাঁর বইয়ের বিজ্ঞাপনের ধূসর পাণ্ডুলিপি গোছের সংকলিত মুদ্রিত লিপি সহসা চোখে পড়েছিল সেই অধমের শৈশবে— যখন কবির জন্মশতবার্ষিকী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের পুস্তকের বিজ্ঞাপন।

চোখের বালি (ভাবা যায় ‘চোখের বালি’র বিজ্ঞাপন!) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩০ সালে। বসুমতী পুস্তক বিভাগ, গ্রে স্ট্রিট, কলকাতা।

“শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমৃতময়ী লেখনী প্রসূত বিশ্বমোহন নবীন সামাজিক উপন্যাস দ্বিতীয় সংস্করণ রাজ সংস্করণ পুস্তক ছাপা হইতেছে, কাগজ মসৃণ, ছাপা অতি সুন্দর, সুবর্ণমণ্ডিত বিলাতি বাঁধাই দ্বিতীয় সংস্করণ ৩৩৮ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ।

যে গ্রন্থের নাম আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেরই কর্ণকুহরে প্রতিদিন প্রতিধ্বনিত হইতেছে, যে উপন্যাস কবে প্রকাশিত হইবে বলিয়া প্রত্যেক বঙ্গবাসী একদিন উদগ্রীব হইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন, যে উপন্যাস বঙ্গের সর্ব প্রধান মাসিকপত্র বঙ্গদর্শনে প্রতি মাসে এক এক অধ্যায় পাঠ করিয়া পর অধ্যায় পাঠের আশায় পর মাসের বঙ্গদর্শনের জন্য গ্রাহকগণ ডাকঘরে ছুটোছুটি করিতেন, যে উপন্যাস অধ্যায়ে অধ্যায়ে অগ্নিময় সত্য, নিত্যসিদ্ধ ঘটনাবলী পাঠকের চক্ষের সম্মুখে ধরিয়ে দিয়াছে, যে উপন্যাসে লোকচরিত্র-নারীচরিত্র সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর করিয়া দেখাইয়াছেন— সেই সামাজিক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আজ গ্রাহকগণের দ্বারে উপস্থিত হইল।

অতি শীঘ্র এই উপন্যাস পাঠ করুন। নরনারী, যুবক-যুবতী, বিবাহিত-অবিবাহিত, যাঁহারা নতুন বিবাহ করিয়াছেন, যাঁহাদের বিবাহ পুরাতন হইয়াছে, যাঁহাদের প্রেমে ভাঁটা পড়িতেছে, যাঁহারা স্ত্রীকে মনের মতো করিতে চাহেন, যাঁহারা সুখের দাম্পত্য প্রেম চাহেন, তাঁহারা ‘চোখের বালি’ পাঠ করিবেন।” (বানান, কমা ইত্যাদি অপরিবর্তিত)।

আরও একটি ‘মজারু’ ঘটনা।

শেষ বয়সেও কবি ছাড়ান পাননি।

“১৯৪১ সালে ব্রিটিশ আমলে সেনসাস কর্তৃপক্ষগণ রবীন্দ্রনাথকে লইয়া বড়ই গোলে পড়িয়াছিলেন। ২১ নং প্রশ্ন,

‘আপনি কত দূর পড়িয়াছেন? যে সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি লাভ করিয়াছেন, তাহা বলুন।’

রবীন্দ্রনাথ কত দূর অবধি পড়িয়াছেন? কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথকে ব্যতিক্রমের মধ্যে ফেলিয়া সমস্যা এড়াইলেন।

তাঁহারা গণনাকারীকে উপদেশ দিলেন,

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেলায় তাঁহার বহু সম্মান সূচক উপাধির মধ্যে যে কোনও একটি লিখিলেই হইবে।’

বুঝুন সরকারি হেনস্থা!!

তাঁর জীবিতকালের, মানে, গত শতাব্দীর অতীতের বিষয় কাটিয়ে নব-শতাব্দীরতে চলে আসা যাক—।

রক্ষেকালীকে বললুম,

“চলো! যাবে তো?”

ঘরের কাজকম্ম, রান্নাবাড়ির পাট চুকিয়ে দুপুরে বোকাবাক্স দ্যাখে আর বিকেলে যায় কাছেপিঠের পাড়া বেড়াতে। দু’একটা ‘বই’ দেখতে যায় ন’মাসে, ছ’মাসে। এ ছাড়া, বিশেষ কোনও প্রমোদের ব্যাপারে ওর আগ্রহ নেই।

প্রশ্ন করলে, “কোথায়?”

“বাহ! আজকের প্রোগ্রাম দেখতে, মানে, শুনতে যাবে না? সাহানার রবীন্দ্রসঙ্গীত?”

একটু ভেবে নিয়ে বললে,

“নাহ! আপনি বরং যাও—”।

“বলি, তুমি কেন যাবে না, অ্যাঁ? বাংলা প্রোগ্রাম! তা ছাড়া, তুমি নিজেও তো পাকশালে গুনগুন করো—”।

মাঝে মধ্যে নিজের মনে ওঁকে গুনগুন করতে শুনেছি। অসুর-বেসুরো বলা যাবে না। সুরের ছোঁয়া আছে।

“নাহ গো, দা’বাবু! তুমি ঘুরে এসো—”।

“তোমার না যাবার কারণটা কি শুনি?”

জবাব দিতে গিয়ে যেন লজ্জাই পেল মা-কালী। আমতা আমতা করে চোখ নামিয়ে জানান দিলে,

“ঘুম পায়।”

হে ঠাকুর, রক্ষে করো! তুমি আর যাই করে থাকো, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড জয় করে, নোবেল জাতীয় অজস্র সম্মানের অধিকারী হয়ে, হে প্রাণের ঠাকুর, কোটি কোটি অন্তরে স্থায়ী বসত অধিকার করেও, গুমোহাবড়া, কামারথুবার রক্ষেকালী ওরফে বিমলা মালির হৃদয় জিততে অপারগ হয়েছ!

ওর জবাবের খেই ধরে আরও একটি ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ল। রক্ষেকালি বেচারি না হয় স্কুলে যাবার সুযোগ পাননি, কিন্তু এই দ্বিতীয় ঘটনাটির সঙ্গে ভারী বিচক্ষণ, বিদ্বান, রীতিমতন লেখক ও এক কালের বিদগ্ধ সম্পাদক— যাঁর সময়ে ইংরিজি ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ বাজারে একেবারে সুপারহিট হয়েছিল, সেই ‘পঞ্জাব কি শের’ সম্প্রতি প্রয়াত খুশবন্ত সিংহ।

নানান পুরস্কার জিতে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ তখনকার বম্বাইতে মুক্তি পেয়েছিল। প্রেসের সম্মানিত নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এই ‘সিংহমশাই’ও ছিলেন। এঁকে জিগ্যেস করা হল,— কেমন দেখলেন ছবি? কেমন লাগল?

জবাব শুনে উপস্থিত অনেকেরই মূর্ছা যাবার দশা। “ভালই হবে! ভারী সুন্দর ঘুম হয়েছে ঘণ্টা দুয়েক।”

এ জাতীয় হতভাগ্য মূর্খদের ভিড়ে আমাদের মহান দেশ গিসগিস করছে। তুমি তো, হে ঠাকুর, তথাকথিত ইস্কুলের গণ্ডিও পার করোনি। তবু দেশের তাবড় তাবড় ‘শিক্ষিত’ বিদ্বান ব্যক্তিরাও, বলতে গেলে, তোমার হৃদয়মথিত চিন্তাভাবনা, শিক্ষাদীক্ষা, দর্শন, আনন্দ-বেদনাময় অনাবিল অগণন সৃষ্টির গহন গভীরে ডুব দিয়েও তলের নাগাল পাননি। ‘তুমি যে কী’ অথবা ‘তুমি যে কে’ তাই আমাদের মতন নগণ্য অন্ধ ভক্তরা বোঝবার বা জানবার ব্যর্থ চেষ্টায় তোমার অফুরন্ত ভাণ্ডারের সামান্য প্রসাদ পেয়েই তৃপ্ত হয়েছি, ক্লান্ত হয়েছি, উথলে উঠে চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এসেছে। তোমার সৃষ্টি তো, হে চিরপ্রণম্য, অকুল পাথার। অ্যাতো গান, কবিতা, গদ্য, পত্রাবলী— এ ছাড়া কত রচনা যে তোমারই অপছন্দের তালিকাভুক্ত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে ছিন্নভিন্ন, নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তার হিসেব কে রেখেছে?

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের আপন অপছন্দের রচনাসমূহের কোনও তালিকা আমাদের জানা নেই বটে, কারণ সেসব কাটা বা ছেঁড়া লেখা, ধরেই নিচ্ছি, নিশ্চিহ্ন হয়ে চলে গেছে মহাকালের গহন গহ্বরে। কিন্তু তার বদলে আমরা যাঁকে পেয়েছি, তিনি আর এক রবীন্দ্রনাথ। একেবারে সম্পূর্ণ রূপে অন্য, ভিন্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই মানুষটির (যাঁকে মহামানব বললেও ভুল হবে না) রচিত তাঁর নিজস্ব নবীন পথ ধরে হাঁটতে যাবার আগে, মুম্বই শহরের একমাত্র প্রতিষ্ঠান তথা রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র চর্চার একমাত্র যে শিক্ষায়তনটি বিগত প্রায় ৩৫ বছর ধরে একাগ্র একনিষ্ঠতার সঙ্গে আপন দায়িত্ব পালন করে চলেছে, সেই ‘সাহানা’ সম্পর্কে দুটি কথা জানানো দরকার। আরও দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তন সম্পর্কে আমরা অনেকেই ওয়াকিবহাল। প্রাঙ্গণ ও রবীন্দ্র গীতিকা। এদের সঙ্গে সাহানা-র বেশ তফাত। এরা সঙ্গীত শেখালেও রীতিমত নিয়মিত ‘স্কুল’ নেই এদের। নিয়মিত রবীন্দ্র-চর্চার বিষয়ে এদের তেমন আগ্রহ আছে বলেও শুনিনি। যা কিনা ‘সাহানা’র, বলতে গেলে প্রায় পাঠক্রমের অন্তর্গত। এ ছাড়া সাহানা-র বৈশিষ্ট্য হল, শুরু থেকেই এই গোষ্ঠী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের নিজস্ব প্রথার অনুগামী, অন্তত দুটি বিষয়ে তো বটেই। শান্তিনিকেতনের মতনই একমাত্র ‘সাহানা’ গোষ্ঠী একই সঙ্গে ‘নববর্ষ’ ও পঁচিশে বৈশাখ’ উদযাপন করে। যেন রবীন্দ্রনাথের জন্মের সঙ্গেই নবীন সূর্যোদয়, যেন নতুন বছর শুরুই হল ‘ঠাকুরে’র জন্ম হল বলে। যদিও এমন কোনও ধারণা ‘সাহানা’ কর্তৃপক্ষের কেউ দেননি। এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত ‘আপন পছন্দের ইচ্ছা-ভাবনা’ বলতে পারেন। শান্তিনিকেতনের প্রথামতোই ছাত্রছাত্রীদের ডিপ্লোমা দেওয়া হয় প্রতি বছর সমাবর্তন উৎসবে। সঙ্গে ‘ছাতিম পাতা’র বদলে থাকে একটি ছোট্ট বীণা। এই মরাঠি-গুজরাতি অধ্যুষিত শহরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তনে এমন ‘ডিপ্লোমা’ পেয়েছেন অদ্যাবধি প্রায় দেড়শো ছাত্রছাত্রী। এটি কম কথা নয়। বাঙালি হিসেবে বেশ গর্ব করেই ঘোষণা করার মতো ঘটনা। আরও উল্লেখ্য, এ বছরের শুরুতে ফি বছরের মতন নববর্ষ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হল এবং চোখ এবং মন দুইই ভরে গেল। প্রেক্ষাগৃহ একেবারে উপচে পড়ছিল দর্শক-শ্রোতার ভিড়ে। তুলনায় প্রেক্ষাগৃহটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন হলেও ঠাসা বাঙালি-অবাঙালির ভিড় দেখে মনে হতেই পারে যে আমরা বঙ্গদেশের কাছাকাছিই আছি।

এ বার আসুন, রবীন্দ্রনাথের নবীন পথপরিক্রমায় ফিরে যাওয়া যাক। যে সব রচনার কোনও একটি শব্দ বা পঙ্ক্তি, ছত্র অথবা স্তবক হয়তো তাঁর মনোমতো হয়নি, তক্ষুনি তা কেটেকুটে অন্য শব্দ বা স্তবক লিখে ফেলতেন। কোনও পৃষ্ঠায় হয়তো একাধিক কাটাকুটির পর পদ্য বা গদ্য ঠাকুরের পছন্দ হত। চিরসুন্দরের পূজারি কবি সেই বিক্ষিপ্ত কাটাকুটি-ভর্তি পাতাটিকে কী আশ্চর্য সুন্দর করে সাজিয়ে তুলে দিলেন আমাদের হাতে, চিরকালের হাতে। সেই সব কাটাছেঁড়া অংশ অবলীলায় চোখ-জুড়োনো ডিজাইনে রূপান্তরিত হল। মডার্ন আলপনা বা ‘রংগোলি’র ডিজাইন।

যত দূর জানি, পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় অজস্র কাটাকুটিগুলি ক্রমশ চিত্তাকর্ষক ডিজাইনের রূপে প্রথম ধরা দিয়েছে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে, যখন কবি রীতিমতন পরিণতবয়স্ক, ষাট অতিক্রান্ত। ভাবুন, যে বয়েসে আমরা সাধারণ নশ্বর মানুষ রিটায়ার করে দাওয়ায় বসে ‘গুড়ুক গুড়ুক তামুক’ খাই, সেই বয়েসে এই মহামানব নিজেকে সহসা ‘ডিজাইনার’ বা শিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করলেন। সেই সময়ে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ রচনা কালে লেখার কাটাকুটি দিয়ে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলতে থাকেন।

যদিও কবির ড্রইংয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল বালক বয়েসেই, গৃহশিক্ষকের কাছে। এ ছাড়া অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচও তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করত। তবু আমার ব্যক্তিগত ধারণা, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ভেতরকার শিল্পীকে প্রথম আবিষ্কার করেন অই ‘পূরবী’ রচনাকালে। তেষট্টির বৃদ্ধ কবি আপন আনন্দে নিজেকেই নবরূপে আবিষ্কার করলেন সেই প্রথম। ক্রমশ এই নবীন রবি উঠেপড়ে কাগজে-রঙে-রেখায় আপন শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। পঁচিশে বৈশাখকে প্রণাম জানিয়ে শেষ করবার আগে, প্রসঙ্গত আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। রবিকবির লেখা কাটাকুটি করতে করতে চিত্রশিল্প গড়ে ওঠার আরও অন্য দিক রয়েছে। ওঁর গুণগ্রাহী চারুচন্দ্রের (বন্দ্যোপাধ্যায়) আপন জবানিতে শোনা যাক : “প্রবাসীতে ‘গোরা’ বাহির হচ্ছিল। তিনি আমাকে বললেন, আরও একদিন থেকে ‘গোরা’র কপি নিয়ে যেতে। আমি তাঁর কাছ থেকে ‘গোরা’ লেখার পদ্ধতিও দেখবার সৌভাগ্য লাভ করলাম। ঘাড় কাত করে খসখস করে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন, আর খানিক ফিরে প’ড়ে দেখে অপছন্দ অংশ চিত্র-বিচিত্র ক’রে কেটে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কত সুন্দর সুন্দর রচনাংশ যে কেটে উড়িয়ে দিয়েছেন তা দেখে কষ্ট হয়েছে। আমি বললাম যে, আপনি যা লিখে ফেলেন তা’তে আর তো আপনার অধিকার থাকে না, তা’ বিশ্ববাসীর হয়ে যায়, অতএব সব থাক।

কবি হেসে বললেন, আমি বড় কৃপণ। সব রাখলে কি চলে! সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস না থাকলে কি সৃষ্টি কখনও সুন্দর হতে পারে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement