মুম্বই মনতাজ

মহানায়কের মহাদুঃখ

মিলন মুখোপাধ্যায়দ্বাপর বা সত্যযুগের কথা জানি না কিন্তু বর্তমান যুগে সময় একেবারে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সময়ের সেই ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে মনতাজ রাজ্যের সিনেমা হল, স্টুডিয়ো এবং নায়ক-নায়িকারা ঘুর-ঘুর ঘুরতে ঘুরতে সময়ের তলে যাচ্ছে তলিয়ে, হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। একসময়ে রাজকপূর, দিলীপকুমার বা দেবআনন্দের ছবি রিলিজ করলে হিট বা সুপারহিট।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

দ্বাপর বা সত্যযুগের কথা জানি না কিন্তু বর্তমান যুগে সময় একেবারে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সময়ের সেই ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে মনতাজ রাজ্যের সিনেমা হল, স্টুডিয়ো এবং নায়ক-নায়িকারা ঘুর-ঘুর ঘুরতে ঘুরতে সময়ের তলে যাচ্ছে তলিয়ে, হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। একসময়ে রাজকপূর, দিলীপকুমার বা দেবআনন্দের ছবি রিলিজ করলে হিট বা সুপারহিট। যেন আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা নেমে এলেন পার্থিব জগতের রুপোলি পর্দায়।

Advertisement

কলকাতায় স্কুল পালিয়ে চলে যেতুম বইপাড়ার কাছাকাছি সব সিনেমাহলগুলিতে। তারকাদের নতুন ছবি দেখার জন্য শুক্কুরবার তুলকালাম লেগে যেত টিকিট কাউন্টারের সামনে। কখনও ‘রূপম’, কখনও ‘কীর্তি’ বা ‘গ্রেস’— এখন সব উঠে গেছে বা নেমে গেছে সময়ের স্রোতে।

এর পর এল সুপার নায়ক রাজেশ খন্নার কাল। সেও এখন শ্যামল মিত্তিরের গান—“স্মৃতি তুমি বেদনার”—হয়ে গেছে। সুপার-ডুপার অ্যাংরি-ইয়াংম্যান অমিতাভরও রোমান্টিক হওয়ার বেলা পিছলে গিয়েছে। বৃদ্ধ মহারাজের সিংহাসনকে ঘিরে ঘোরাফেরা করছেন ‘খানদান’— শাহরুখ, আমির বা সলমন এবং খিলাড়ি অক্ষয়কুমার।

Advertisement

অথচ, কলকাতায় ছবির বাজারে কত মুখ এল এবং গেল। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে অজস্র নায়কের চেহারা-নাম সব একের পর এক ধুয়ে-মুছে মলিন-অস্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে গেল মহাকালের গর্ভে— এখনও যাচ্ছে। শুধু একটি নাম, একটি মুখের উজ্জল হাসিতে ছোট বা বড় পর্দা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আজও, এখনও।....ষাটের দশকের অন্তর্জলি যাত্রার সময়। ভি শান্তারামের ‘রাজকমল’ স্টুডিয়োর গায়েই ছিল অধুনা লুপ্ত ‘কারদার’ স্টুডিয়ো। যথেষ্ট নামকরা ও ক্রমে সময়ে তলিয়ে যাওয়া এক সিনেমা মাসিকের সঙ্গে জড়িত ছিলুম।

‘কারদা’-এর সেটে ঢুকে দেখি ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার। সে যুগে, আজকের মতো “ধোঁয়া-মেশিন’ ছিল না। স্টিলের দশাসই একখানা কড়াইতে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে তুকারাম। পদবি ওর জানি না। কেউ জানতেন কিনা সন্দেহ। তা, ধোঁয়া সৃষ্টি করত বলে, বয়েসের সম্মান দেখাতে ডাকতুম ‘ধোঁয়াভাই তুকারাম’। বাঁ-হাতে পাখা নাড়ছে ঘন ঘন। অন্য হাতে পাশের কৌটো থেকে ধুনো তুলে ছিটিয়ে দিচ্ছে আগুনে।

“কার শ্যুটিং চলছে, ধুঁয়াভাই?”

জবাবে দু’বার কেশে বললে, “বৈজয়ন্তীজির।”

মানে, তৎকালীন নামী তারকাদের অন্যতমা বৈজয়ন্তীমালা।

“তা, উনি কোথায়?” ধোঁয়ার নকল কুয়াশা-মেঘের আস্তরন ভেদ করে দেখার চেষ্টা করলুম। বৃথা!

“আসেননি এখনও।”

“তাহলে, কার শট নেওয়া হচ্ছে?”

ধুয়াভাই পাখা এবং মাথা নেড়ে বললে, “নাম মনে পড়ছে না। নতুন কিন্তু খুব ভাল আদমি। বঙ্গাল-কা-বাবু।”

ধোঁয়া সাঁতরে এগিয়ে গেলুম। প্রথমে তো চিনতেই পারি নে। জটাজুট, দাড়ি-গোঁফের আড়ালে শ্রীমুখ ঢাকা পড়েছে। একটি নকল বটগাছের তলায় গেরুয়া বসনে আসনপিড়ি হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই হেসে ফেললেন। ব্যস! ধোঁয়ার আবডাল, দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল চোখের সামনে থেকে মুহূর্তে হারিয়ে গেল কোথায়! অমন ভুবনমোহন হাসি শুধু একজনেরই হতে পারে। সাধু-সন্ন্যাসীর কবচ-তাবিজ-মাদুলির চেয়ে এ হাসির সম্মোহন অনেক বেশি।

মহানায়কের কাছে পোঁছে বললুম,“এ কী কাণ্ড, উত্তমদা! কী ছবি?”

হাসতে হাসতে ভরাট গলায় জবাব দিলেন রসিকতার ঢংয়ে, “হুঁহুঁম্বাবা! হিন্দি পিকচার হ্যয়! চালাকি নয়।”

“আহা, কার ছবি? কী নাম?”

ঘোষণা করার ধরনে বললেন, “প্রযোজনা-অভিনয়ে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়। পরিচালনা—আলো সরকার। নায়িকা—বৈজয়ন্তীমালা। সঙ্গীতে শঙ্কর-জয়কিশান। —আসিতেছে, আসিতেছে—তিনটে ছ’টা ন’টায়—‘‘ছোটিসি মুলাকাৎ।”

বঙ্গ-আড্ডার অন্যতম উপাদান ‘চা’ এসে গেল। এক হাতে গোঁফ-দাড়ি সামলে-সরিয়ে গেলাসে চুমুক দিলেন উত্তমদা। বললেন, “ধুর, ভাই! আপনাদের মুম্বাইতে কলকাতার আসল জিনিসই পাওয়া যায় না।”

“কী বলুন তো?”

“ভাঁড়ের চা।”

সেই প্রথম ছবি “ছোটিসি মুলাকাৎ”। বাংলা সুপারহিট ‘অগ্নিপরীক্ষা’র হিন্দি চিত্ররূপ করতে আরব সাগরের তীরে পা রেখেছিলেন উত্তমদা। তার পর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। উত্তমকুমারের প্রথম হিন্দি ছবি বাজারে চলেনি।

দিলীপকুমার থেকে তখনকার তাবড় তাবড় নায়কের ‘বঙ্গালকা বাবু’র অভিনয় দেখে বলেছিলেন, “হুঁ। এ তো ‘পোটেনশিয়াল ডেঞ্জার’।”

হিন্দি পর্দায় বাংলার মহানায়কের আবির্ভাবের সংবাদে যে সব হিরোদের দশাসই গতর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল, ‘ছোটিসি মুলাকাৎ’ বাক্স-আপিসে হিট করতে না পারায় তাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে।

কিন্তু, বিখ্যাত বাঙালির অন্তরে তথাকথিত পরাজয়ের গ্লানি বোধহয় মিলিয়ে যায়নি। তবে, হতোদ্যম তিনি হননি। তাই, বাংলার মাটি মহানায়কের প্রায় এক যুগ বাদে আবার ফিরে এসেছিল, সেই শহরে আরবার—যেখানে ‘ভাঁড়ের চা’ পাওয়া যায় না।

শ্রদ্ধেয় শক্তিদার (শক্তি সামন্ত) ডাকে সাড়া দিয়ে ‘অমানুষ’ সেজে প্রমাণ করেছিলেন— আসল ‘মাটির ভাঁড়ে’ সুস্বাদু চা গোটা দেশে সুপারহিট হতে পারে। সে-ও তো কত দিন আগের কথা.....

সামনের চব্বিশে জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা মনে পড়ায় অ্যালবাম ঘাঁটছিলুম। আবার দেখা হল উত্তমদার সঙ্গে। ...যেন এই সে দিনের কথা। মিলিয়ন ডলার হাসিটি উপহার দিয়ে হাত রাখলেন কাঁধে।

জিজ্ঞেস করলুম, “ক’ দিন থাকছেন মুম্বইতে এ যাত্রা?”

‘কিতাব’ ছবির কাজ শেষ হয়ে গেছে। মনমোহন দেশাইজির ‘দেশপ্রেমী’তেও আমার শ্যুটিং শেষ হল কাল। আজ সকালের ফ্লাইটেই ঘরে ফিরব। বাসুবাবু মানে, আপনাদের বাসু ভট্টাচার্য আটকে দিলেন। নতুন ছবি নিয়ে কথা বলতে চান।”

‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেলে ওঁর ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “চা না কফি?”

“উত্তমদা! কেন লজ্জা দিচ্ছেন? আমাদের পশ্চিমের এ শহরে তো ‘ভাঁড়ের চা’ পাওয়া যায় না। সুতরাং কফিই বরং—”।

দরাজ গলায় হাসতে হাসতে আমার জন্যে কফি আর নিজের জন্য চা অর্ডার দিলেন। বললেন, “সেই ছোট্ট ঝামেলার জন্যে— আমার কফি, সিগারেট বারণ হয়ে গেছে।”

আগের কথার খেই ধরিয়ে দিলুম, “বাসুদার কথা কী যেন বলছিলেন—? কোন ছবি?”

“নতুন। নাম ‘আবিষ্কার’।”

“কাজ করছেন?”

“না। ঠিক মানে জমল না!”

ঠিক! বাসুদা ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন বটে, তবে রাজেশ খন্নাকে নিয়ে জমাতে পারেননি। সে সব অন্য ইতিহাস....। চিত্রজগৎ থেকে, জগৎসংসার থেকে চলে যাবার মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। উত্তমদা সেই শেষ বারের মতো এ রাজ্যে এসেছিলেন। যত দূর জানি, ‘বোম্বাই’ বা ‘মুম্বই’তে মহানায়কের এটাই শেষ সাক্ষাৎকার। কারণ, এর পর আমার কফি, ওঁর চা শেষ হবার পর— হোটেল থেকে সোজা তিনি সান্তাক্রুজ বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। সঙ্গে গিয়ে ‘সি-অফ’ করেছিলুম। যাবার আগে ইংরেজি দৈনিকের ফোটোগ্রাফার-বন্ধু সূর্যকান্ত কুলকার্নির এই সাদাকালো ছবিটিই এ রাজ্যে তোলা উত্তমকুমারের সর্বশেষ ছবি।

তার পর আর কি? সেই বিকালের ফ্লাইট ধরে চলে গেলেন প্রথমে কলকাতায়, কিছু দিন পরে—আরও দূরে—“সূর্য গেল অস্তাচলে, আর উঠিল না।”

জুলাইয়ের শেষ দিকে, বর্ষার শব্দের মধ্যে আজও হঠাৎ কখনও শুনতে পাই, অম্লান লক্ষ টাকার সম্মোহনী হাসিমাখা কণ্ঠস্বর, “ধুর ভাই! যৌবন ফুরিয়ে ফেললেন, তবু, এই বর্ষার মধ্যেও আপনাদের ‘বোম্বাই’তে ভাঁড়ের চা খাওয়াতে পারলেন না।”

সব শেষে বলি, এই অধম কলমচি মুম্বইয়ে বহু নায়ক দেখেছে, অনেককে কাছ থেকে দেখেছে, চিনেছে, দেখেছে অনেক ভাল অভিনেতা, তবু কোনও দ্বিধা না রেখেই বলতে পারে, নায়ক এক জনই--- উত্তম কুমার। তিনি সর্বোত্তম। তিনি মহানায়ক। তাঁর তুলনা তিনিই। এত বড় মনই বা ক’জনের হয়!

ছবি: লেখক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement