এই ধরনের ‘চোখ’ দিয়েই মহাকাশ দেখবে অ্যাস্ট্রোস্যাট। ছবি ইসরোর সৌজন্যে।
চোখ তার একটি বা দু’টি নয়। পাঁচ-পাঁচটি। মহাকাশের অপার রহস্যের আরও কিছু নুড়ি কুড়োনোর আশায় এ বার এই পাঁচ-চোখো দূত পাঠাচ্ছেন ভারতের বিজ্ঞানীরা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা হোক বা রিমোট সেন্সিং— মহাকাশে চক্কর কাটছে একাধিক ভারতীয় উপগ্রহ। এক বছর আগে পড়শি গ্রহ মঙ্গলের কক্ষপথেও পৌঁছে গিয়েছে ভারতের ‘দূত’। তাদের উত্তরসূরি হিসেবেই বাড়তি সন্ধানী চোখ নিয়ে মহাকাশে পাড়ি দিতে চলেছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র নতুন দূত। নাম তার ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’।
এমন নাম কেন?
ইসরো সূত্রের খবর, অ্যাস্ট্রোনমি ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার গবেষণার জন্যই এই উপগ্রহ। তাই ‘অ্যাস্ট্রো’ ও ‘স্যাটেলাইট’ (উপগ্রহ) শব্দ দু’টি জুড়ে এই নাম দেওয়া হয়েছে।
মহাকাশ গবেষণায় উপগ্রহ কেন?
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অ্যাস্ট্রোস্যাটের পাঁচটি চোখের কথাই বলছেন মহাকাশবিজ্ঞানীরা। তাঁরা জানাচ্ছেন: মহাজাগতিক যে-সব ঘটনা ব্রহ্মাণ্ডে অবিরাম ঘটে চলেছে, তার বেশির ভাগই সাধারণ টেলিস্কোপে ধরা পড়ে না। কারণ, সাধারণ টেলিস্কোপ শুধু দৃশ্যমান আলোর উপরেই নজরদারি চালাতে পারে। মহাকাশ গবেষণায় দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে সঙ্গে এক্স-রশ্মি (এক্স-রে) অতিবেগুনি (আল্ট্রাভায়োলেট) রশ্মির উপরেও নজরদারি প্রয়োজন। অর্থাৎ চাই বিশেষ চোখ। চাই রশ্মিসন্ধানী বিশেষ টেলিস্কোপ। এক্স-রশ্মি ও অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে বসে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ, বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ভেদ করে এই রশ্মির বেশির ভাগটাই পৃথিবীতে পৌঁছয় না। সেই জন্যই অ্যাস্ট্রোস্যাট উপগ্রহে পাঁচটি রশ্মিসন্ধানী যন্ত্রচক্ষু লাগিয়ে তাকে মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে।
পাঁচটি যন্ত্রচক্ষু কী কী?
আইইউকা ও ইসরো সূত্রের খবর:
• অ্যাস্ট্রোস্যাটে ৪০ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি টেলিস্কোপ থাকবে।
• মাঝারি ক্ষমতার এক্স-রে রশ্মি ধরার থাকবে জন্য ‘লার্জ এরিয়া জেনন প্রোপোরশনাল কাউন্টার’ নামে একটি যন্ত্র।
• থাকছে কম ক্ষমতার একটি এক্স-রশ্মি সন্ধানী টেলিস্কোপও।
• উচ্চ শক্তির এক্স-রে ছবি ধরার জন্য একটা ‘ক্যাডমিয়াম জিঙ্ক টেলুরাইড কোডেড মাস্ক ইমেজার’।
• মহাবিশ্বে এক্স-রে রশ্মির উৎস সন্ধানের জন্য থাকবে একটা স্ক্যানিং স্কাই মনিটর বা এসএসএম।
পাঁচটি চোখ কেন?
এই প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার পুণের ইন্টার-ইউনির্ভাসিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউকা) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষকেরা বলছেন, ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সন্ধান করতে গেলে এক ধরনের রশ্মি বা একটি যন্ত্র যথেষ্ট নয়। তাই অতিবেগুনি রশ্মির পাশাপাশি তিন ধরনের এক্স-রে রশ্মি ধরার যন্ত্র বসানো হয়েছে ওই উপগ্রহে। আইইউকা-র এক গবেষক বলছেন, ‘‘মহাকাশের যে-সব বস্তু এক্স-রশ্মি বিচ্ছুরণ করে, তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করতেই এসএসএম নামে যন্ত্রটি বসানো হয়েছে।’’
এক মহাকাশবিজ্ঞানী বলছেন, ‘‘অ্যাস্ট্রোস্যাটে বসানো যন্ত্রপাতি মহাকাশে অতিবেগুনি রশ্মি ও এক্স-রে তথ্য সংগ্রহ করে তা পৃথিবীর কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেবে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করেই মহাকাশ গবেষণার নতুন দিক খুলে দিতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।’’ উন্নত মহাকাশ গবেষণার জন্যই মহাকাশে এর আগে হাবল টেলিস্কোপ বসিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসা।
ইসরো-র জনসংযোগ বিভাগের অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ কার্নিক জানান, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে পিএসএলভি রকেটে চাপিয়ে অ্যাস্ট্রোস্যাট উৎক্ষেপণ করা হবে। প্রাথমিক ভাবে পাঁচ বছর ধরে পাঁচ ধরনের চোখ দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন বস্তুকে নিরীক্ষণ করবে সে।
মহাকাশবিজ্ঞানের গবেষকেরা বলছেন, ১৯৯৬ সালে আইআরএস-পি৩ নামে একটি রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ পাঠানো হয়েছিল। তার মধ্যে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল এক্স-রে সন্ধানী যন্ত্রও। কিন্তু সেটা কখনও পুরোপুরি কাজ করেনি। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও তা ছিল নিম্ন মানের। সে-দিক থেকে অ্যাস্ট্রোস্যাট হতে চলেছে ভারতীয় মহাকাশবিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রথম হাতিয়ার। ইসরোর একটি সূত্র জানাচ্ছে, ১০ অগস্ট উপগ্রহটি বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশও করে গিয়েছে।
মহাকাশে গিয়ে অ্যাস্ট্রোস্যাট যে-সব তথ্য পাঠাবে, কলকাতার এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস-এর বিজ্ঞানীরাও তা বিশ্লেষণ করবেন। ওই প্রতিষ্ঠানের জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সন্দীপকুমার চক্রবর্তী বলছেন, অ্যাস্ট্রোস্যাটে যে-যন্ত্র বসানো হয়েছে, তা দিয়ে একই বস্তুকে একাধিক চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব। ফলে নিখুঁত নজরদারিতে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর এবং মহাকাশের বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য ধরা পড়তে পারে।