আট মাস আগের সেই দিনটা এখনও ভুলতে পারেননি আসানসোলের বেশ কয়েক জন বিজেপি নেতা। সে দিন দ্বিতীয় বার প্রচারে গিয়েছেন প্রার্থী। এবং গিয়েই ধাক্কা। এর আগের বার যে হোটেলে উঠেছিলেন, তারা সোজা দরজা দেখিয়ে দিল স্থানীয় নেতাদের! তাদের সাফ কথা, এখানে জায়গা হবে না, অন্য কোথাও যান!
বাবুল সুপ্রিয়কে নিয়ে যে রাগ সেই সময় বাজিয়েছিল তৃণমূল, এটা তার আলাপ হলে বিস্তারটাও লোকসভা ভোটের আগেই দেখে নিয়েছে আসানসোল। কখনও তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপ অবস্থায় মন্দিরে ঢোকার অভিযোগ, কখনও অস্ত্র আইনে মামলা। সেই সব পেরিয়ে বাবুল শুধু সাংসদই হলেন না, এক সময় মন্ত্রী হিসেবে সংসদের সেন্ট্রাল হলে শপথও নিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের যন্ত্র তখন ঝালায় পৌঁছে গিয়েছে। নবান্ন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম বার যখন কলকাতায় এলেন বাবুল, তাঁর সঙ্গে রাজ্যের আমলাদের দেখা করতে পর্যন্ত মানা করে দেন তিনি।
সেই স্বর হঠাৎই নেমে এল খাদে। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে, সংসদের সেন্ট্রাল হলে। মমতা তখন দলের সাংসদদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাবুল এসে বলেন, “দিদি, বিজেপির সাংসদ বা মন্ত্রী হিসেবে বলছি না, এক জন গায়ক হিসেবে অনুরোধ করছি। সন্ধ্যায় সংসদেরই বালযোগী সভাগৃহে আমার গানের অনুষ্ঠান রয়েছে। আপনি এলে ভাল লাগবে।” দলের অন্যদের অবাক করে মমতা হাসিমুখেই বাবুলের কথা শুনলেন। তার পর দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, “আমার তো ওই সময় রাষ্ট্রপতিকে দেখতে যাওয়ার কথা। তাই যেতে পারছি না।” তার পর দলের সাংসদদের দিকে ফিরে বললেন, “আপনাদের সময় থাকলে যাবেন কিন্তু।”
নেত্রী যখন এই কথা বলছেন, সাংসদদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু হয়ে গিয়েছে! সকলেই জানেন, বাবুলের সম্পর্কে কী ধারণা সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন মমতা। তাঁর হঠাৎ এমন বদল! দু’এক জন ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েও দিলেন, গানের আসরে যাবেন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য গিয়ে উঠতে পেরেছিলেন সৌগত রায় ও মুমতাজ সঙ্ঘমিতা। শতাব্দী রায় জানালেন, তিনিও গিয়েছিলেন। তবে শেষ দিকে। বললেন, “বাবুল নিজে কার্ড দিল, যেতে বলল।”
বাকিদের কেউ ব্যস্ত কাজে, কেউ দিল্লির বাইরে। শুভেন্দু অধিকারী যেমন জানালেন, তিনি কাঁথিতে রয়েছেন। “থাকলে হয়তো যেতাম।” নাতনি অসুস্থ বলে দিল্লিতে নেই শিশির অধিকারীও। অন্য কাজে ব্যস্ত দেবও গরহাজির। যাননি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “বাবুল দিদির সঙ্গে কথা বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমাদের সরাসরি কিছু বলেননি।” তবে সরাসরি নেমন্তন্ন করলে যেতে আপত্তি ছিল না তাঁর। বললেন, “বাবুলের তো রাজনীতির বাইরেও পরিচয় আছে। তিনি গায়ক। তা ছাড়া আমার মোবাইলে তো তাঁর গান রেকর্ড করা আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত।”
বাবুল যদি ‘এক’ হন, তা হলে ‘দুই’ অবশ্যই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। যে বাংলাদেশকে ছিটমহল থেকে তিস্তার জল, সব কিছু ছাড়তেই প্রবল অনীহা ছিল মমতার এই কিছু দিন আগেও, সে দেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে তিনি দিল্লি সফরের মেয়াদ বাড়িয়ে দিলেন! বৃহস্পতিবার ভারতে এসেছেন হামিদ। শুক্রবার প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছেন। সেই ভোজসভায় থাকার জন্য দিল্লি সফরের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন মমতা।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন? কেন দিদি এমন বদলে গেলেন? কেন বাবুলের প্রতি সদয়? কেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সৌজন্যে দেওয়া নৈশভোজে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে দিলেন সফরের দিন, বাতিল করলেন রাজ্যের অনুষ্ঠান? তৃণমূল নেতারা বলছেন, দিদি তো কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপির সঙ্গে সৌজন্য রক্ষার কথা বলেইছেন। এ সব তো তারই দৃষ্টান্ত। বাবুলের গানের অনুষ্ঠান বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির জন্য নৈশভোজের সঙ্গে রাজনীতি কোনও যোগ নেই। তা হলে আপত্তি করবেনই বা কেন?
কিন্তু জনান্তিকে কেউ কেউ বলছেন, মমতা যাঁকে অচ্ছুৎ করেন, তাকে দূরে সরিয়েই রাখতে চান। সেটা খুব ভাল বুঝতে পেরেছেন কুণাল ঘোষ। তা হলে এখানে কী এমন ঘটল যে সব উল্টে গেল? এর জন্য সারদা কেলেঙ্কারির দিকেই আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন তাঁরা। বলছেন, এই কেলেঙ্কারি ঘিরে সিবিআই যে ভাবে জাল গুটিয়ে আনছে, যে ভাবে মদন মিত্রের মতো মাথাকে গ্রেফতার করে পরের ঘুঁটি তোলার জন্য তৈরি হচ্ছে, তাতে আশঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। স্বাভাবিক স্নায়ুবৈকল্যও।
তা হলে কি চাপে পড়ে ভোল বদলালেন দিদি? ঘরোয়া আলোচনাতেও এই নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না তৃণমূল নেতারা। শুধু সামনে তুলে ধরছেন অন্য একটি তথ্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নৈশভোজে থাকার কথা নরেন্দ্র মোদীর। যাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে এখনও মুখোমুখি দেখা হয়নি মমতার। প্রশ্ন, তা হলে কি মোদীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যই নৈশভোজে যাওয়ার সুযোগ ছাড়তে চাইছেন না মমতা? তিনিই কি তবে তৃণমূল নেত্রীর আসল লক্ষ্য?
তৃণমূল জুড়ে এর জবাবে শুধু নীরবতা।