ভোটে তিব্বতি জট, সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক

লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম তিব্বতি শরণার্থীদের ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাতেই ঘুম ছুটেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, এর ফলে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে। শুধু তাই নয়, দেশের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। এই রিপোর্ট পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নির্বাচন কমিশনের কাছেও দরবার করা হয়েছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০৩:২৬
Share:

লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম তিব্বতি শরণার্থীদের ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাতেই ঘুম ছুটেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, এর ফলে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে। শুধু তাই নয়, দেশের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।

Advertisement

এই রিপোর্ট পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নির্বাচন কমিশনের কাছেও দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, কর্নাটক হাইকোর্টের নির্দেশ মেনেই তিব্বতি শরণার্থীদের ভোটাধিকার দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে তিব্বতি শরণার্থীদের ভোটার তালিকায় নাম তোলার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। বেগতিক বুঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হাইকোর্টের ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানো হবে।

১৯৫৯ সালে তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামা ভারতে আশ্রয় নেন। তার পর থেকে বহু তিব্বতি শরণার্থী এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। গত ৫৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম তিব্বতি শরণার্থীদের ভোটাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের বক্তব্য, গত বছর অগস্টে কর্নাটক হাইকোর্ট তিব্বতি শরণার্থীদের ভোটাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই অনুযায়ী ৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন এক নির্দেশিকায় জানায়, নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ১৯৫০ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে তিব্বতি শরণার্থীদের যে সব সন্তানের এ দেশে জন্ম হয়েছে, তাঁদের কোনও ভাবেই ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কারণ আইনত তাঁরা ভারতের নাগরিক। ১৯৮৭ সালের পরে যাঁদের জন্ম, তাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে যে কোনও এক জন ভারতীয় নাগরিক হলে তাঁরাও ভারতীয় নাগরিক।

Advertisement

সেই অনুযায়ী সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকদের কাছে নির্দেশ যায়, তিব্বতি শরণার্থীদের নাম ভোটার তালিকায় তোলা হোক। রাজ্যে রাজ্যে সেই কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। সরকারি অনুমান অনুযায়ী, এ দেশে তিব্বতি শরণার্থীর সংখ্যা এখন প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার। যাঁদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ভোটাধিকার পেতে পারেন।

মজার কথা হল, এত দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে এ বিষয়ে কোনও খবরই ছিল না। কমিশন ভোটার তালিকায় তিব্বতিদের নাম তোলার কাজ শুরু করার পরেই নর্থ ব্লকে গোয়েন্দা রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে বলা হয়, তিব্বতিদের ভোটাধিকার দেওয়া হলে নয়াদিল্লি-বেজিং সম্পর্কে তার প্রভাব পড়তে পারে। লোকসভা ভোটের মুখে ভারত-চিন সীমান্তে সমস্যা তৈরি হলে তাতে নয়াদিল্লিরই সমস্যা। তা ছাড়া উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনও এর ফায়দা তুলতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষকর্তাদের দাবি, এত দিন নির্বাচন কমিশন বা বিদেশ মন্ত্রক এ বিষয়ে তাঁদের কিছুই জানায়নি। নাগরিকত্ব আইনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক্তিয়ারভুক্ত। অথচ কর্নাটক হাইকোর্টের মামলায় বিদেশ মন্ত্রককে শরিক করা হয়। বিদেশ মন্ত্রকও জানিয়ে দেয়, এতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই।

নির্বাসিত তিব্বতিদের সরকারের অবস্থান হল, শরণার্থীরা ভারতের নাগরিকত্ব নেবেন কি নেবেন না, এটা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। নির্বাসিত সরকার কাউকে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে বাধ্য করবে না, কাউকে বাধাও দেবে না। নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী লবসাং সাংগে কিছু দিন আগেই এ বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, “এটা ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিষয়। যাঁরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করছেন, তাঁদের আমরা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দিয়ে থাকি।”

ধর্মগুরু দলাই লামার দফতরের মুখপাত্র তেনজিং টাকলা বলেন, “আমরাও এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। এটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।” তিব্বতি শরণার্থীদের সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আন্দোলনকারীরা বলছেন, মনেপ্রাণে সব তিব্বতিই নিজেকে চিনের দখলে থাকা তিব্বতের নাগরিক বলে মনে করেন। কিন্তু ভোটার কার্ড না থাকায় অনেককেই উচ্চশিক্ষা বা প্রতিযোগিতার বাজারে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সেই কারণেই এখন বহু তরুণ-তরুণী ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করছেন। প্রশাসনের নিচু স্তরে অনেকেরই এ বিষয়ে কোনও ধারণা নেই। তিব্বতিদের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা ছিল না। এখন তা তৈরি হয়েছে।

তিব্বতি শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্বর বিষয়টি প্রথম আদালতের দরবারে যায় ৪ বছর আগে। নামগিয়াল ডোলকার লাগিয়ারি নামে এক তিব্বতি তরুণীকে ভারতীয় পাসপোর্ট দিতে আপত্তি জানায় বিদেশ মন্ত্রক। দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেন নামগিয়াল। তাঁর জন্ম ১৯৮৬ সালে, এ দেশেই। তাই নাগরিকত্ব আইন নামগিয়াল এ দেশেরই নাগরিক বলে রায় দেয় দিল্লি হাইকোর্ট। সেই পথে হেঁটেই গত বছর অগস্টে কর্ণাটক হাইকোর্ট তিব্বতি শরণার্থীদের ভোটাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কর্নাটকের বাইলাকুপ্পেতেই রয়েছে তিব্বতি শরণার্থীদের সব থেকে বড় শিবির।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা অবশ্য মনে করছেন, নিরাপত্তার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। তিব্বতিদের ভোটাধিকার দেওয়া নিয়ে বেজিং যে চটবে, তাতে কোনও সংশয় নেই। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও চিন এ বিষয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সরব হতে পারে। সেই কারণেই কর্নাটক হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে, তা নির্বাচন কমিশন ও বিদেশ মন্ত্রককেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, কর্নাটকের মহীশূর, হিমাচলপ্রদেশের ধর্মশালা, জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ, সিকিমের গ্যাংটক ও মেঘালয়ের শিলং লোকসভা কেন্দ্রে তিব্বতি শরণার্থীদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement