বড় পুজো

আজ চতুর্থী। কালই ঢাক বেজে উঠবে মণ্ডপে। আপনি তৈরি তো? এ বারও আমরা মুম্বইয়ের পুজোর খবর জানাচ্ছি। নতুন পোশাক, নতুন জুতো। সঙ্গে পেট পুজো। মন্ত্রোচ্চারণ-অঞ্জলি-ধূপের গন্ধ-ঢাকের বোল-প্রসাদ। চারটে দিন, বাকি বছরও ভাল কাটুক, এই প্রার্থনা মায়ের কাছে। লিখলেন পারমিতা মুখোপাধ্যায় ও মিলন মুখোপাধ্যায়। তথ্য -সহযোগিতায় পৌলমী সরকার।মুম্বইয়ের দুর্গাপুজো প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় খার-এর রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোর কথা। চারটে দিনের এক দিন সেই পুজো না-দেখলেই নয়। বিশেষ করে মিশনের কুমারী পুজো। স্বয়ং বিবেকানন্দ কুমারী পুজো করেছিলেন। কাশ্মীরে এক মুসলমান মাঝির মেয়েকে দেবী জ্ঞানে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

মুম্বইয়ের দুর্গাপুজো প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় খার-এর রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোর কথা। চারটে দিনের এক দিন সেই পুজো না-দেখলেই নয়। বিশেষ করে মিশনের কুমারী পুজো। স্বয়ং বিবেকানন্দ কুমারী পুজো করেছিলেন। কাশ্মীরে এক মুসলমান মাঝির মেয়েকে দেবী জ্ঞানে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ।

Advertisement

জুহু স্কিম সর্বজনীন: নামেই সর্বজনীন। আদতে এটা বিশ্বজিতের পুজো। বাংলা ও হিন্দি ছবির সাবেক নায়ক বিশ্বজিৎ পুজোটা জমিয়ে করেন। এ বার পুজো হচ্ছে অমিতাভ বচ্চনের বাংলো ‘জলসা’র পাশেই। সেন্ট জোসেফ স্কুল গ্রাউন্ডে। গতবার বাংলার নায়ক প্রসেনজিৎ সপরিবার এসেছিলেন পুজোর সময়। বাবার পুজোয় ছেলে ঢাকও বাজিয়েছিলেন। পুজো মণ্ডপে প্রচুর স্টল থাকে, সেখানে পাওয়া যায় কলকাতার লোভনীয় সব খাবার।

Advertisement

বিশ্বজিৎ আরও জানিয়েছেন, “এ বার মাতৃমূর্তি হবে সোনালি। সন্তানদের রংও তাই। আমার স্ত্রী ইরা-র ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন মৃৎশিল্পী অমিত পাল। চিরাচরিত সাদা ডাকের সাজ।”

আন্ধেরি লিঙ্ক রোড সর্বজনীন: আদতে যা ডি এন নগরের পুজো নামে খ্যাত। পরিষ্কার করে বললে, এটা কৃষ্ণেন্দু সেনের পুজো। সেই একই জায়গায়, দু’একর জমির উপর মনোরম মণ্ডপ ও স্টল। কোথাও কোনও কমতি নেই। তবে এ বার রাজস্থানি প্রাসাদের আদলে মণ্ডপ নয়, এ বার থিম-পুজো। কৃষ্ণেন্দু জানিয়েছেন, “এ বার আমরাও কলকাতার মতো থিম-পুজো করছি। মুখোশ এ বার আমাদের থিম। পুরো মণ্ডপে মুখোশের ছড়াছড়ি। মণ্ডপের মূল প্রবেশ দ্বারে থাকবে দু’টো ১৮ ফুটের মুখোশ! মুম্বইয়ে এমন পুজো এর আগে কেউ করেননি। খাবারের স্টলের ওপর এ বার আমরা জোর দিচ্ছি। হরেক রকম খাবারের স্টল। বাঙালির প্রিয় খাবারের একাধিক স্টল থাকবে। গতবার ব্যাপক বৃষ্টির জন্য মাঠে কাদা হয়েছিল, এ বার পুরো মাঠে বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাঠের পাটাতন।” কৃষ্ণেন্দু জানিয়েছেন, “এ বারও মায়ের মূর্তি হবে ২২ ফুট। মুম্বইয়ে এমন মূর্তি আর হয় না।” তবে বড়-নামী শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হবে না। স্থানীয় ব্যান্ড অনুষ্ঠান করবে। সপ্তমীর সন্ধ্যায় গানে গানে শ্রদ্ধা জানানো হবে রাহুল দেববর্মনকে।

লোখান্ডওয়ালা সর্বজনীন: এটাও নামেই সর্বজনীন। আদতে এটা অভিজিতের পুজো বলে খ্যাত। প্রকৃত পাঁচ তারা পুজো। ব্রান্ড-এর ছড়াছড়ি এই পুজোয়। এই পুজো না-দেখা বড় ‘মিস’। আবাহন থেকে বিসর্জন— অভিনবত্ব।

প্রগতি: আন্ধেরিতেই রয়েছে আর একটা বড় পুজো। ৫০ পার হওয়া এই পুজো দেখতেই হবে।

কান্ডিভিলি কৃষ্টি: লোখান্ডওয়ালা, কান্ডিভিলি টাউনশিপের এই পুজোর এ বার দশম বছর। এই তিনটে পুজো দেখলেই মালুম হবে মুম্বইয়ের পুজো কেমন, কত বড়।

বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতি: মুম্বইয়ের প্রাচীন পুজো। পুজোর এ বার ৮৫ বছর পূর্তি। পুজো প্রেসিডেন্ট জয়ন্ত বসু। অগস্ট ক্রান্তি ময়দানের কাছে অগস্ট ক্রান্তি মার্গে তেজপাল হলে এই পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঐতিহ্য মেনে এ বার ডাকের সাজের একচালা প্রতিমা। পুজো সেক্রেটারি তনুশ্রী সেন।

অপরাজিতা মহিলা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন: গোরেগাঁও ইস্ট-এর পুজো পুরোপুরি মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত। ১১ বছর ধরে একই মহিলা কমিটি এই পুজো করে আসছে। পুজো সেক্রেটারি শর্বরী বাগচি।

অ্যান্টপ হিল: আদতে অ্যান্টপ হিল ওয়াডালার পুজো। এই পুজোর উদ্যোক্তাদেরও বেশির ভাগ মহিলা। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা পূর্বা শূর জানিয়েছেন, “নারী শক্তি ও একাত্মতাই আমাদের মূল কথা।” কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বিশাল আবাসন অ্যাটপ হিল, ওয়াডালায়। তাঁরাই পুজো শুরু করেছিলেন। সুন্দর ভোগ বিতরণ করা হয় এই পুজোয়।

কলবাদেবী সর্বজনীন: জাভেরি বাজারের বাঙালি স্বর্ণশিল্পীরা এই পুজো সূচনা করেছিলেন। ১৯৩০ সালে এই পুজোতেই প্রথম ঢাক বেজেছিল মুম্বইয়ে। তাড়দেও, ক্রস ময়দানের পর পুজো হচ্ছে সি পি ট্যাঙ্কের কাছে মাধব বাগে। মায়ের নাকের বিশাল নথ থেকে কানের দুল— সব হিরের। গলায়-হাতে সোনার অলঙ্কার। সব আয়ুধ রূপোর। পুজোর পাঁচ কেজি ওজনের ঘটও রূপোর। পুজোর এ বার ৮৫ বছর!

শিবাজি পার্ক বেঙ্গল ক্লাব: দাদারের এই পুজোও বেশ পুরনো। শিবাজি পার্কে নিজস্ব জমিতে এই পুজো হয়। পুজোর এ বার ৭৯ বছর! এটা সাইলেন্স জোন হওয়ায় আনন্দ অনুষ্ঠান হয় ভিন্ন প্রকৃতির। এখানকার ভোগ প্রসাদের আয়োজন এলাহি।

পওয়াই বেঙ্গলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন: পওয়াইয়ের পুজোটা বেশ বড়। পুজো উদ্যোক্তাদের তরফে পিনাকী দত্ত জানিয়েছেন, “এ বারও তাক লাগানো পুজো হচ্ছে। এ বারও আলোয় ভাসবে এক কিলোমিটার এলাকা। এ বার মণ্ডপও ভিন্ন রুচির। সেরা মানের ভোগ বিতরণ করা হবে এ বারও।” তিনি আরও জানিয়েছেন, “এ বার খুঁটি পুজোর সূচনা হয়েছে। মুম্বইয়ে খুঁটি পুজোর প্রবর্তন করা হল বলা যায়। খুঁটি পুজোর অনুুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুরকার শান্তনু মৈত্র।”

বান্দ্রা নতুন পল্লি: পুরোপুরি বাঙালিদের পুজো। শক্তি সামন্তের পুজো বলে খ্যাত এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রমোদ চক্রবর্তী, রাহুল দেববর্মণ, বাসু চট্টোপাধ্যায়।

ফালক্রাম কালচারাল ফাউন্ডেশন: থানের এই পুজোটা দেখতেই হবে। পুজোর এ বার তৃতীয় বছর। অন্যতম পুজো উদ্যোক্তা রঞ্জিত মজুমদার জানিয়েছেন, “থানে পোখরান রোড নাম্বার টু-এ পুজো হচ্ছে। প্রতিমা গড়ছেন শুভজিৎ দাশ। মণ্ডপ ও আলোর দায়িত্বে বিনায়ক ডেকরেটর। মহাসপ্তমীতে গান গাইবেন বাবুল সুপ্রিয়। অন্তত দু’হাজার মানুষ ভোগ প্রসাদ পাবেন। বাজেট ২১ লক্ষ টাকা। অষ্টমীতে হবে কুমারী পুজো।”

লোনাভালা: এই বিশ্বের অন্যতম সেরা জায়গা লোনাভালা, এটা জানা। কিন্তু জানেন কি, সেখানে বেশ সুন্দর দুর্গাপুজো হয়!

ভাসি কালচারাল ও নভি মুম্বই বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন: ভাসির এই পুজো দু’টো বেশ বড় মাপের। পুরনোও। পুজো দেখতে নভি মুম্বইবাসীদের মূল মুম্বইয়ে না এলেও চলে, এই পুজো দুটোর কল্যাণে। অনেক ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে চললেও নভি মুম্বই বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন-এর পুজো টোল খায়নি। দুটো পুজোতেই বেশ ভাল মানের ভোগ বিতরণ করা হয়।

আজ চতুর্থী। দেবীপক্ষের চতুর্থ দিনে শেরাওয়ালি মা স্বমহিমায় বিরাজ করছেন মণ্ডপে মণ্ডপে। উৎসবের দিনগুলো নিয়ে এসেছে আনন্দ। গর্বা বা ডান্ডিয়া নাচে পা মেলাচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতা। সকলেই খুশিতে মাতোয়ারা। অর্কেস্ট্রার সুরের তালে ও ছন্দে দুলে উঠছে শরীর। রংবেরঙের পোশাকের বিভঙ্গে ঝিলিক দিয়ে উঠছে রাংতামোড়া ডান্ডিয়া লাঠির দ্রুত ওঠানামা। কেউ কেউ জুটি বাঁধছেন, কেউ কেউ আবার গোল হয়ে নাচছেন হাতে হাত মিলিয়ে। উৎসবের আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, বা উৎসবে সকলকে শামিল করে নেওয়া— এটিই নবরাত্রির বৈশিষ্ট্য। মায়ের আগমনই এই সৌহার্দ্যের মূল কারণ। জগন্মাতাই আমাদের সকলকে একসূত্রে গ্রথিত করে রাখেন। তবু মাঝে মাঝে এই অনাবিল আনন্দের মধ্যেও একটা বিষাদের কাঁটা মনকে ব্যথিত করে, যখন দেখি যে ডান্ডিয়া লাঠি নিয়ে সুবেশা তরুণী ঘাগরা দুলিয়ে নাচতে চলেছে, সেই রাংতা জড়ানো লাঠি বিক্রি করছে ময়লা ছেঁড়া জামা গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে। মন বিষণ্ণতার দেওয়ালে ধাক্কা খায়। মনে মনে ভাবি, এই উৎসবে আনন্দময়ী মা যেখানে অকৃপণ ভাবে ঢেলে দিচ্ছেন আনন্দরাশি, সেখানে কেন হাসি নেই এই শিশুগুলির মুখে? কী অপরাধ এই সব অবোধ, নিষ্পাপ শিশুদের? আমরা কি পারি না আমাদের রাশি রাশি নতুন জামাকাপড়ের ভেতর থেকে অন্তত একখানি ওদের জন্য রেখে দিতে? একটু ভাল খাবার, গায়ের আব্রুরক্ষার জন্য একটা জামা পাওয়ার অধিকারও কি নেই ওদের? শিশুবয়সেই পেট ভরানোর জন্য জীবনযুদ্ধে নেমেছে কচি মুখগুলো।

সুধিজন, আপনারা হয়তো ভাবছেন, আনন্দের দিনে কেন বিষণ্ণতা ঢেলে দিচ্ছে আমার এই লেখা। আত্মপক্ষ সমর্থনে বলি, বিষাদও জীবনেরই একটা অঙ্গ। বিষাদ আছে বলেই না হর্ষ, আনন্দ এত মধুর। আর এই বিষাদকে মুছে ফেলে জীবনকে আনন্দময় করে তোলা, সেও আমরাই পারি, কারণ আমরা যে আনন্দময়ী মায়ের সন্তান। আমরা পারি সকলের মুখে হাসি ফোটাতে। তা হলেই যে মায়ের পুজো সবার পুজো হবে।

এ বার আসুন, চলে যাই আরও কিছু দুর্গাপুজোর খোঁজখবরে।

নবজীবন সঙ্ঘ, মুলুন্ড (ওয়েস্ট): মুলুন্ড ওয়েস্ট-এর নবজীবন সঙ্ঘ-এর দুর্গাপুজোর এ বার তিন বছর পূর্তি। অনুষ্ঠিত হচ্ছে নালন্দা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড, পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য রোড, সেন্ট পায়াস স্কুলের কাছে মুলুন্ড ওয়েস্টে। পুজো কমিটির সদস্য পরিমল দেব জানালেন, কলকাতা থেকে শিল্পীরা এসেছেন মণ্ডপ নির্মাণ করতে। মণ্ডপ তৈরি হবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুকরণে। মণ্ডপটি ১২ হাজার স্কোয়ার ফুট এলাকায়। তিন দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় কলকাতা থেকে আগত ব্যালে ট্রুপের অনুষ্ঠান। সপ্তমীতে একটি ব্লাইন্ড অর্গানাইজেশনের অর্কেস্ট্রা। অষ্টমী-নবমী ‘সারেগামাপা’খ্যাত শিল্পীদের গানের অনুষ্ঠান। দু’দিন ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা থাকবে। পুজোগ্রাউন্ডে বসবে বিভিন্ন স্টল। পুজোর বাজেট প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ। পুজোর প্রেসিডেন্ট শান্তিময় পাল এবং সেক্রেটারি চঞ্চল দাস।

বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, ভায়েন্দার: বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন, ভায়েন্দারের এ বছর মাতৃ আরাধনার উনিশ বছর পূর্তি। পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে সত্যনারায়ণ মন্দির কম্পাউন্ড, খাড়িগাঁও, বি পি রোড, ভায়েন্দার ইস্টে। পুজোর বাজেট ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। পুজোর তিন দিন স্থানীয় শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুদিন ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সেক্রেটারি দুলাল চক্রবর্তী। পুজোর প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি যথাক্রমে বৃন্দাবন ঘোড়ুই ও বাবুসোনা কর্মকার।

বঙ্গসঙ্ঘ: আর এন টি পার্ক, বঙ্গসঙ্ঘ কালীমাতা মন্দির কমপ্লেক্স, ভায়েন্দার ইস্টে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ৩২তম দুর্গাপুজো, জানালেন পুজোর জেনারেল সেক্রেটারি শংকর মাজি। পুজোর বাজেট ১৫ লাখ। মণ্ডপ হবে মন্দির আদলে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, যাতে আগামী প্রজন্ম বাংলা সংস্কৃতির ধারক বাহক হতে পারে। সংস্থা নানা সমাজকল্যাণ মূলক কাজ আয়োজন করে থাকে। পুজোর প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র মণ্ডল।

মুম্বই থেকে পুণে সড়কপথে যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। পুণেতেও দুর্গাপুজো হয়। পুণের তিনটে পুজোর কথা জানাচ্ছি।

বঙ্গীয় সংস্কৃতি সংসদ, পুণে: পুণের বঙ্গীয় সংস্কৃতি সংসদের দুর্গাপুজোর এ বছর ৭৫ বছর অর্থাৎ প্ল্যাটিনাম জুবিলি। এই পুজো বৃহত্তর পুণে সর্বজনীন দুর্গোৎসব নামেই পরিচিত। শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। পরে ১৯৬২ সালে ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। পুজো হচ্ছে কংগ্রেস ভবন শিবাজি নগর (পুণে মিউনিসিপ্যাল অফিসের কাছে)। পঞ্চমীতে আনন্দমেলা সন্ধে ৭টা থেকে ৯টা। এর পর কলকাতার ব্যালে গ্রুপের অনুষ্ঠান। ষষ্ঠীতে পুজো উদ্বোধনের পর ‘সুরঝংকার’-এর অনুষ্ঠান। সপ্তমীর সন্ধ্যায় প্রথমে ক্লাবের সদস্যদের নাটক। এর পর কলকাতার শিল্পীদ্বয় অরুণাভ ও শ্রেয়সীর গান। অষ্টমীতে প্রথমে বীরভূমের বাউল গান এবং পরে সুবর্ণা মাতেগাঁওকর ও তাঁর গ্রুপের গান। ক্লাবের সদস্যরা প্রতিমা বিসর্জন দেবেন ৫ অক্টোবর। ৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় নীলাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় ও মহুয়া ঘোষের নৃত্যানুষ্ঠান এবং পরে কলকাতার পরমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুপ্রতীক দাসের গান। ৪ অক্টোবর পুরস্কার বিতরণের পর স্থানীয় ব্যান্ডের শিল্পীদের গান। ভোগপ্রসাদ বিতরণ করা হবে তিন দিন। পুজোর সেক্রেটারি রাজেশ বর্মন, চেয়ারম্যান বরুণ ঘোষরায়।

কল্যাণীনগর সর্বজনীন দুর্গোৎসব: এই পুজোর আয়োজক নান্দনিক সংস্থা। কথা হল প্রেসিডেন্ট জে পি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এ বছর পুজো একাদশ বর্ষে পদার্পণ করল। এই সংস্থায় প্রায় ১০০ জন সদস্য আছেন। বাঙালি-অবাঙালি সকলেই পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। পুজোর বাজেট আনুমানিক ২০-২২ লাখ। পুজো হবে কোরেগাঁও পার্ক, রোহিলীলা প্যালেসে। প্রায় ৩-৪ একর জুড়ে তৈরি। মণ্ডপে স্টল দেওয়া হয়। মুম্বইয়ের প্রতাপ ক্যাটারারও স্টল দেয়। সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠানে ষষ্ঠীতে হয় ছোটদের নাটক। সপ্তমীর সন্ধ্যায় বাংলা নাটকের পর আধঘণ্টা নাচের অনুষ্ঠান। এর পর সত্যজিৎ রায় ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রের গান নিয়ে গীতি আলেখ্য। অষ্টমীতে মুম্বইয়ের শিল্পীদের অর্কেস্ট্রা। প্রতিমা বিসর্জন ৪ অক্টোবর। তাই নবমীতেও অনুষ্ঠান আছে। ওই দিন সন্ধ্যায় কলকাতার শিল্পীদের গান। তিন দিন ভোগপ্রসাদের ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন প্রায় ২-৩ হাজার মানুষ এখানে ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করেন। রাত ১-২টো পর্যন্ত মানুষ ঠাকুর দেখতে আসেন। সেক্রেটারি চারু রায়।

পুনা বঙ্গ সম্মিলনী: পুণের পুজো প্রসঙ্গে বলতে হয় পূর্ব পুনা সর্বজনীন দুর্গোৎসব-এর কথা। বড় পুজো। পুজোর এ বার দ্বাদশ বর্ষপূর্তি। পুণের মানুষকে ঠাকুর দেখতে যাতে দূরে যেতে না হয় তার জন্যই এই পূজার আয়োজন করেন বঙ্গ-সংস্কৃতিপ্রেমীরা। এই সম্মিলনী সরস্বতী ও কালীপুজোও করে। পূর্ব পুনা পুনেশ্বরী কালীবাড়িতে কালীপুজো হয়। এ বাক তাঁরা পুণেতে ‘খুঁটিপুজো’ও করেছেন।

কান্দিভিলি পূর্ব বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন: এর পুরোহিত মুম্বাই পৌঁছে যাচ্ছেন চতুর্থীর দিনই, নদিয়া থেকে। সঙ্গে ঢাকি সেই নদিয়া থেকেই, জানালেন অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো কমিটির সাধারণ সচিব সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা মূর্তি গড়ার কাজ প্রায় শেষ। দাদর শিবাজী পার্কের অস্থায়ী কুমোরটুলি থেকে মায়ের মূর্তি প্যান্ডেলে ঢুকব ঢুকব করছে। এ বার অ্যাসোসিয়েশনের পুজো ষোলো বছরে পা দিল। সংগঠনের সঙ্গে সুব্রত যুক্ত শুরু থেকেই। বাজেট আঠারো থেকে কুড়ি লাখ টাকা। পুজোটা হয় কান্দিভিলি পূর্ব বিএমসি প্লে গ্রাউন্ডে। এবার প্রতিমায় থাকছে চমক। একচালার ঠাকুরে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ অসুর সিংহ মহাদেব সব একসঙ্গে দুর্গার সাথে স্থান করে নিয়েছে। সুব্রত জানালেন, ‘এ বার প্রতিমার মুখ চিরাচরিতের থেকে একটু আলাদা, পাওয়া যাবে গ্রাম্য সাবেকি ছাপ। প্রতিমার মাথায় থাকবে না কোনও মুকুট’। পঞ্চমী অর্থাৎ কাল থেকে এখানে পুজে শুরু। কাল এখানে বসবে আনন্দমেলা। সংগঠনের সদস্যদের বাড়ির মহিলারা নানা রকম খাবারের অস্থায়ী দোকান দেবেন। সামান্য দামে এই সব খাবার বিক্রি হয়। এই খাবারের বিভিন্ন বিভাগ থাকে। বিচারক থাকেন যিনি খাবারগুলোর স্বাদ পরীক্ষা করেন। বিভিন্ন বিভাগে প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অধিকারিণীদের পুরস্কৃত করা হয়।

এই পুজোতে দর্শনার্থীদের সবাইকে ভোগ খাওয়ানো হয়। অষ্টমীর দিন হবে পোলাও। ভোগের সাথে এক রকমের ভাজা, তরকারি, চাটনি, পাঁপড়, পায়েস ইত্যাদিও দেওয়া হবে। এখানকার পুজোয় ভোগ প্রসাদ খাওয়ানো হয় বুফে ব্যবস্থার মাধ্যমে। কয়েক হাজার লোক খান পুজোর এই কটি দিনে। রাঁধুনি অবশ্য মুম্বইতেই পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও চলবে পুজোর সাথে সাথে। ষষ্ঠীর দিন সংগঠনের সদস্যদের বাড়ির লোকেরা অনুষ্ঠান করেন। সপ্তমীর দিন হবে নৃত্য নাট্য। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ভিত্তি করে নৃত্যনাট্যটি অনুষ্ঠিত হবে। অষ্টমীর দিন আধুনিক গানের অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠান করবে মুম্বাইয়ের অর্পিতা রাজ গ্রুপ। নবমীর সন্ধ্যায় আসবেন মুম্বইয়ের শিল্পী আমন পালানকর। দশমীর দিন পাওয়াইয়ের সরোবরে দেবীর বিসর্জন।

বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতির পুজো: বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতির প্রতিমা এসে যাবে আজ চতুর্থীর দিনে, তেজপাল হলে। ঢাকিরাও এসে পড়েছেন, কারণ মা এসে পড়ছেন যে। ঢাকিরা আসছেন ছয় থেকে সাত জন, এরা সবাই একই পরিবারের। শুরু থেকে এরাই আসেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি, জানালেন দুর্গাবাড়ি সমিতির সভাপতি জয়ন্ত বসু। কাল পঞ্চমীর দিন এখানে বসবে আনন্দমেলা। এই মেলার খাওয়ার স্টলের কথা এর আগে বলেছি। তবে আনন্দমেলায় কাল রসনা তৃপ্তির সঙ্গে মনোরঞ্জন করার জন্য আসছেন রায়না লাহিড়ী। তেজপাল হলের উঠোনের সামনে যে বারান্দাটা আছে সেখানেই তিনি গান শোনাবেন। ষষ্ঠীর দিন প্রাঙ্গণ গ্রুপ শরতকে বরণ করবে অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। তাই অনুষ্ঠানের নাম ‘শারদ অর্ঘ’। বাঙলা থেকে দূরে বাঙালিয়ানা ধরে রাখার মধ্যে বেদনা মেশানো নস্টালজিয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া সুরটাকে ধরে রাখার প্রয়াস করছে দুর্গাবাড়ি সমিতি দুর্গাপুজোতে। বাঙালিরা যাকে চিত্র তারকার থেকেও অনেক বেশি ‘মিসেস সেন’ ভাবতে পছন্দ করেন তাঁর স্মরণে তেজপাল হলে একটা অডিও ভিসুয়াল অনুষ্ঠান থাকছে---‘হারানো সুর’। সপ্তমীতে আসছেন কুণাল গাঞ্জাওয়ালা। অষ্টমীতে অনুষ্ঠান দুর্গাবাড়ি সমিতির সদস্যদের, মনোজ মিত্রের নাটক অবলম্বনে ‘ছন্দে ছন্দে কত রং বদলায়’।

ভাসি আসাম অ্যাসোসিয়েশন: দুর্গাপুজো যে শুধু বাঙালিদেরই নয় অহমিয়াদেরও এটা মুম্বইতে বসেও প্রত্যক্ষ করা যায় ভাসির আসাম অ্যাসোসিয়েশনের পুজোতে। পুজোটা হয় ভাসির আসাম ভবনে। বিরাট চত্বর। সেখানে পুজোর দিন জড়ো হবেন তিনশোরও বেশি অহমিয়া পরিবার, জানালেন আসাম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সচিব শশাঙ্ক বড়ুয়া। এছাড়াও আসেন বহু বাঙালি পরিবার। মুম্বইতে বসবাসকারী ভারতবর্ষের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষ আসেন এই পুজো দেখতে। অসমে আছেন বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তাঁরাও আসেন এই পুজো দেখতে। এমনকি যারা বৈষ্ণব তারাও বাদ যান না এই দেবী পুজো থেকে। এই পুজো এ বার আট বছরে পা দিল। এ বারের দুর্গা প্রতিমার উচ্চতা এগারো ফুট। অহমিয়াদের এই পুজোতে মায়ের বসন সিল্কের। অসমের বিখ্যাত মুগা সিল্কের। আসে অসম থেকে। মা দুর্গার লাল, লক্ষ্মী-সরস্বতীর যথাক্রমে বেগুনি ও সাদা। গণেশের হলুদ, গোলাপি ও সাদা রঙের বসন। পুজোয় যে গামছা লাগে তাতে অসমের বিখ্যাত গামছা ব্যবহার করা হয়। পুজোর ভোগ প্রসাদ প্রত্যেক দিন পান প্রায় ৫০০ জন। ভোগের সাথে থাকে কলা দিল ভাজি অর্থাৎ কলার ফুল মোচার তরকারি এবং আলু কচু পিটিকা। প্যান্ডেল এখানে দুটো করা হয়। একটা পুজোর ও একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। পুজোর বাজেট ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। মুম্বইয়ের পুজোর মতো বলিউডের শিল্পী দিয়ে আসর মাতানোর চল নেই। এখানে অসমের শিল্পীদের সুযোগ দেওয়া হয়। অহমিয়া শিল্পী জয় বড়ুয়া ছাড়াও আরও অনেকে আসেন। যন্ত্র সঙ্গীতে পারদর্শী মুম্বইবাসী অহমিয়া শিল্পীরা এখানে সুযোগ পান। তবে অসমের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকলেও এই পুজোর ঢাকি, শিল্পী বিশ্বনাথ, পুরোহিত গৌতম মুখোপাধ্যায় আসেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে।

উত্তর মুম্বই সার্বজনীন দুর্গা পুজো: হোটেল টিউলিপ স্টারে প্রতিমা এসে গেছে একুশ তারিখে। মণ্ডপ সজ্জার কাজে অসুবিধা হচ্ছিল, বললেন দেব মুখার্জী। প্রতিমা জায়গা মতো বসিয়ে দিয়ে এক দিকটা বন্ধ করে ভেতরে সাজ সজ্জার কাজ নিশ্চিন্তে করা যায়। পুজোর পুরোহিত উৎপল ভট্টাচার্য মুম্বইবাসী বাঙালি। আসবেন ষষ্ঠীর দিন। আগামীকালই বাংলা থেকে দশজন ঢাকি এসে পৌঁছচ্ছেন। ধুনুচি নাচে এ বারে পরিবারের ছেলে রাজা, সম্রাট। হয়তো বাড়ির মহিলারাও নাচবেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কারা অংশ নেবেন সারপ্রাইজ রাখতে চাইলেন দেব মুখার্জী।

এ এক মিলনমেলাও বটে। পুজোকে উপলক্ষ করে কত মানুষ সম্মিলিত হন। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক বন্ধন গড়ে তুলতে দুর্গাপুজোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেটা ক্রমশ সখ্যে পরিণত হয়। গাঢ় হয় সম্পর্কের উষ্ণতা। মন পরিব্যাপ্ত হয় সকলের মধ্যে। তখন মানুষ এক একটা দ্বীপ থাকে না। মহাদেশ হয়ে ওঠে। পুজো সকলের ভাল কাটুক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement