বিনম্র। নিউটাউনে আন্তর্জাতিক কলাকেন্দ্রের উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী। সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
বৃহস্পতিবার ভেঙে গেল জয়ললিতার সঙ্গে বামেদের জোট। আর সে দিনই তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বার্তা পাঠালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিলেন, জয়া বা অন্য কোনও আঞ্চলিক নেতা যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তা হলে তাঁকে সমর্থন করতে তাঁর (মমতা) কোনও অসুবিধা নেই। কারণ তিনি কুর্সি নয়, সাধারণ মানুষকে নিয়েই চিন্তিত।
একাধিক জনমত সমীক্ষা যখন আসন্ন লোকসভা ভোটে আঞ্চলিক দলগুলির রমরমার আভাস দিচ্ছে, তখন সেই জোটের নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা গোপন রাখেননি জয়ললিতা। এই অবস্থায় জয়া, মুলায়ম সিংহ যাদব এবং নীতীশ কুমারকে সামনে রেখে গত মাসে ১১ দলের তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন করে বাম দলগুলি। চেন্নাই গিয়ে জোটের কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রকাশ কারাট, এ বি বর্ধনেরা। কিন্তু জয়া তামিলনাড়ুতে চাহিদামতো আসন ছাড়তে রাজি হননি, এই যুক্তি দেখিয়ে আজ তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করল সিপিএম, সিপিআই।
গত সপ্তাহে নিজের ৬৬তম জন্মদিনে তামিলনাড়ুর ৩৯টি এবং পুদুচেরির একটি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেন এডিএমকে নেত্রী। তবে একই সঙ্গে আশ্বাস দিয়েছিলেন, বামেদের সঙ্গে সমঝোতা হলে তালিকায় বদল হবে।
জয়ার রাজ্যে দুই বাম দলের চাহিদা ছিল মোট ৬টি আসন। কিন্তু তাদের দু’টির বেশি আসন ছাড়তে চাননি এডিএমকে নেত্রী। পাশাপাশি, বিজেপি-র সঙ্গে সমঝোতার পথ খোলা রাখতে আম্মা চাইছিলেন, তামিলনাড়ুতে বামেরা যেন নরেন্দ্র মোদীর খুব বেশি সমালোচনা না-করেন। এতদসত্ত্বেও বামেরা জয়াকে ধরে রাখতে আগ্রহী ছিলেন। কারণ, জয়া না-থাকা মানে তৃতীয় ফ্রন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠা। সেই কারণে জয়ার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চাইছিলেন বাম নেতারা। কিন্তু জয়া তাঁদের সেই সুযোগই দেননি। উল্টে এডিএমকে-র পক্ষ থেকে গত কাল বামেদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, জোটের আশা না-করাই ভাল।
এই অবস্থায় আজ চেন্নাইতে বৈঠক করে জোট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম-সিপিআই। আর সেই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় স্তরে তৃতীয় ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। যদিও বাম নেতাদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্যস্তরে জোট ভাঙার প্রভাব জাতীয় স্তরে পড়ার সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে জাতীয় জোটকে যখন প্রাক্-ভোট নয়, ভোট-পরবর্তী ব্যবস্থা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তবে জয়ার বিদায় যে কারাটকে ধাক্কা দিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ, মমতার জোট চেষ্টা বানচাল করতে তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি।
আর তৃতীয় ফ্রন্টের বিপর্যয়ের এই দিনেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জয়াকে বার্তা দিলেন তৃণমূল নেত্রী। লোকসভা ভোটের পরে তৃণমূল জাতীয় স্তরে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠবে বলে যখন দাবি করছেন দলীয় নেতারা, তখন মমতার ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা গোড়াতেই ধাক্কা খায়। তাঁর ডাকে সাড়া দেননি নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়কেরা। ফলে জাতীয় স্তরে খানিকটা একলাই হয়ে পড়েন তৃণমূল নেত্রী। এই অবস্থায় অরাজনৈতিক নেতা অণ্ণা হজারেকে সঙ্গে নিয়ে গোটা দেশে ১০০ আসনে লড়ার পরিকল্পনা রূপায়িত করতে উদ্যোগী হন তিনি। সঙ্গী করার চেষ্টা করেন উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরার ছোটখাটো দলকে।
এখন তৃতীয় ফ্রন্টে ধাক্কা মমতার সামনে সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বলেই মনে করছেন অনেক রাজনীতিক। শুধু জয়া নন, এর আগে তৃতীয় ফ্রন্টের বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীনও। তৃতীয় ফ্রন্ট দুর্বল হওয়ার এই সুযোগটাই নিতে চান মমতা। আর সেই কারণেই আরও এক বার তৃতীয় ফ্রন্টকে ‘টায়ার্ড ফ্রন্ট’ আখ্যা দিয়ে তিনি আজ আম্মার সমর্থনে এগিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
বস্তুত, নীতীশ কুমার, মায়াবতী, মুলায়ম যাদব কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা নিয়েই তাঁর আপত্তি নেই বলে আজ জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “ওঁর (জয়ললিতার) যদি জাতীয় রাজনীতি ঘিরে কোনও উচ্চাকাঙ্খা থাকে তাতে ক্ষতি কী! এতে ভুল কিছু নেই। নীতীশজি যদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, আমি খুশিই হব। মায়াবতী, মুলায়মজি যে কেউ চাইতে পারেন।”
মায়াবতী, জয়ললিতা ও তাঁর দল যদি একসঙ্গে সরকারে থাকে তা হলে সরকার চালাতে কোনও সমস্যা হবে না বলেও আজ দাবি করেছেন মমতা। তাঁর কথায়, “অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের আমলে তো আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।”
মমতার এ দিনের বার্তা সম্পর্কে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের ব্যাখ্যা, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, তিনি মোটেই প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য লালায়িত নন। বাইরে থেকে সমর্থন দিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীই থেকে যাবেন।” মমতা নিজেও বলেছেন, তিনি ক্ষমতার জন্য লালায়িত নন। গত চৌত্রিশ বছর ধরে যে হেতু রাজে কোনও উন্নয়ন হয়নি, সে হেতু এখন তিনি সেখানেই কাজে ব্যস্ত। তিনি চান, কেন্দ্রে শক্তিশালী সরকার তৈরি হোক। যারা দেশকে আর্থিক প্রগতির দিকে নিয়ে যাবে।
এই অবস্থানের মধ্যে দিয়ে তৃণমূল নেত্রী ভবিষ্যতে বৃহত্তর জোটের রাস্তা খুলে রাখতে চাইলেন বলেই অনেকের মত। বস্তুত, ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়তে গিয়ে এক বার হাত পোড়ানো মমতা তৃতীয় ফ্রন্টের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এখনই আর একটা জোট গড়ার ঝুঁকি নেবেন না বলেই তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য। যা হবার, লোকসভা ভোটের পর হবে। তখন সবটাই নির্ভর করবে, কে কত আসন পেয়েছে তার উপরে। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “সংখ্যাই শেষ কথা বলবে। তাই এখনই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে অহেতুক জল ঘোলা না করে দলনেত্রী সমস্ত বিকল্প খুলে রাখার পক্ষে।”
আর আসনই যে হেতু শেষ কথা বলবে, তাই গোটা দেশে যত বেশি সম্ভব আসনে লড়ে যতটা সম্ভব ফসল ঘরে তুলতে চান তৃণমূল নেত্রী। সেই লক্ষ্যে ১২ মার্চ রামলীলা ময়দানে অণ্ণার সঙ্গে যৌথ জনসভা করবেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি ছাড়াও দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে, হরিয়ানাতে এ বার প্রার্থী দিচ্ছে তৃণমূল। মমতার দাবি, “খোদ অণ্ণা চান আমরা রাজ্যের বাইরে গিয়ে নির্বাচন লড়ি। সেই কারণে আমরা অন্য রাজ্যে প্রচার করছি। আর তা ছাড়া এখন ছ’টি রাজ্যে আমাদের বিধায়ক রয়েছে। আর একটি রাজ্যে স্বীকৃতি পেলে তৃণমূল জাতীয় দল হিসাবে গণ্য হবে।”
একই সঙ্গে দলের প্রচারে অণ্ণা হজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে বলেও এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। দল জানিয়েছে, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে যৌথ প্রচারে যাবেন মমতা ও অণ্ণা।