স্বপ্ন দিয়ে মোড়া উপত্যকা। প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের পুরো ডালিটা বসিয়ে দিয়েছে এই উপত্যকার আনাচে-কানাচে। যে দিকেই তাকানো যায়, সে দিকেই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা অসাধারণ ছবি। একদিকে বরফমোড়া পাহাড়, অন্য দিকে সবুজের বুগিয়াল। মাঝে মাঝে ছবির মতো সেঁটে থাকা বাক্স-বাড়ি। পাশ দিয়ে বয়ে চলা বহতা নদীর উচ্ছলতা। রঙবেরঙের ফুলের বাগবাগিচায় তখন রঙের তুফান তুলেছে। মিশকালো কালো পিচ রাস্তার দু’পাশে চিনার গাছের মিনার নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। পাখির কুজন, রঙবেরঙের ফুলের বাসর, আপেল, বেদানা, চেরি, আলুবোখরা, আখরোটের মতো শুকনো ফলের সেরা ঠিকানা ভূস্বর্গ কাশ্মীর। এবং অবশ্যই জাফরান। পৃথিবীতে এত ভাল জাফরান আর কোথাও পাওয়া যায় না। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক নানান প্রতিকূলতাকে, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদী বামলার আশঙ্কাকে দূরে ঠেলে ছুটে আসেন কাশ্মীরে। বিশেষ করে বাঙালিরা বুক ফুলিয়ে বারে বারে ছুটে আসেন ভূস্বর্গের ভূমিতে।
ইতিহাসের পটপরিবর্তন
কাশ্মীরের ইতিহাসটাই বেশ প্রাচীন। রামায়ণ, মহাভারতে উল্লেখ আছে কাশ্মীরের। সম্রাট অশোক, কুষাণরাজ কণিষ্কও এখানে রাজত্ব করেছেন। যিশুখ্রিস্ট স্বয়ং এখানে এসেছিলেন বলে গবেষকেরা দাবি করেন। সপ্তদশ শতকে হিন্দুরাজাদের কবলে আসে কাশ্মীর। মোগলরা তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী করেছিলেন এই উপত্যকায়। ক্রমেই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নানান প্রাসাদ, বাগবাগিচা নির্মাণ করেন মোগলরা। শিখরা আসেন মহারাজা রণজিৎ সিংহের হাত ধরে। শিখদের পর ব্রিটিশরা কাশ্মীরেও রাজত্ব করতে শুরু করেন। এর পর গুলাব সিংহের হাত ধরে আবার হিন্দুদের আয়ত্তে আসে এই রাজ্য।
এই ভাবে ইতিহাসের নানান পটপরিবর্তনের সাক্ষী দেশের মানচিত্রের মাথায় থাকা এই রাজ্য। সেই থেকে আজও নানান রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, পর্যটন নির্ভর এই রাজ্যে প্রতিনিয়ত দিন গুজরান করেন অসংখ্য মানুষ। সেনাবাহিনীর ভারী বুটের আওয়াজ নেমে আসে শ্মশানের নিস্তব্ধতায়। ‘কারফু’, ‘বন্ধ’ এই শব্দগুলো কাশ্মীরবাসীরা রপ্ত করে ফেলেছেন। পর্যটকরাও অকুতোভয়ে নিশ্চিন্তে চষে বেড়ান উপত্যকার আনাচে-কানাচে। ‘ভূস্বর্গ’ দর্শন বলে কথা, এত আতুপুতু করলে হয় নাকি? বঙ্গের পর্যটক মহল অসহ্য গরমকে দূরে ঠেলে প্রতি বছর চলে আসেন প্রকৃতির স্বপ্নপুরী ভূস্বর্গ কাশ্মীরে।
কাশ্মীর নামের ইতিকথা
কথিত আছে, অতীতে কাশ্মীর ছিল পাহাড় ঘেরা সরোবরের এক দেশ। চিরবসন্ত বিরাজিত এই ক্ষেত্রের নাম ছিল ‘সতীসর’। ‘সতীসর’ নামটি আসে দেবী পার্বতীর ‘সতী’ থেকে। সেই সময় এখানে দৈত্যরাজ চলত। সাধারণ মানুষের ওপর চলত অকথ্য অত্যাচার। দৈত্যদের অত্যাচার থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসেন মহর্ষী ব্রহ্মার মানস পুত্র মরীচ ও মহামুনি কাশ্যপ। তাঁরাই দৈত্যদের নিধন করে মনুষ্যকুলের বাসভূমি গড়ে তোলেন কশ্যপনি বা কশ্যপ পাহাড়ের কোলে। কশ্যপ থেকে ‘কাশ্মীর’ নামের উৎপত্তি হয়েছে।
জাফরানি রং আকাশে
বৈষ্ণাদেবী দর্শন সেরে অসহ্য গরমের ৩০০ মিটার উচ্চতার জম্মুতে দাঁড়িয়ে। মহারাজ জম্বুলোচনের নামেই এ শহর। এটাই ‘গেটওয়ে অফ কাশ্মীর’। জানেন কী, জম্মুতে দারুণ দুর্গাপুজো হয়! পুজোয় কাশ্মীর গেলে দুর্গাপুজোও দেখা হবে। কাটরায় দুর্গাপুজো দেখার মতো। কলকাতার জাঁক নেই, ভক্তি-আন্তরিকতা আছে।
এক দিকে তাওয়ই, অন্য দিকে চন্দ্রভাগা নদীকে পাশে পাশে নিয়ে ঘিঞ্জি শহরটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম। প্রায় ১০ ঘণ্টার যাত্রা। গন্তব্য ১৭০০ মিটার উচ্চতার শ্রীনগর। হাজারো রাস্তার বাঁক পেরিয়ে চলেছি নীল আকাশের ফসিলদের সঙ্গে নিয়ে। প্রতিটি বাঁকেই প্রকৃতির রূপরসের বদল। আমাদের গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলেছে আরও অনেক গাড়ি। অবশ্যই পর্যটকদের।
মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়িতে মুখ ঢেকে সশস্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ান। সতর্ক দৃষ্টি প্রতিটি গাড়িতে। সহজ সরল গ্রাম্য মুখ, লাল টুকটুকে আপেলের মতো গায়ের রং ওদের। গাড়ি এসে থামল জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কের মাঝে নিরালা পাহাড়ি গ্রাম, পাটনিটপে। পাহাড়ের ঢাল জুড়ে বিছানো রয়েছে পাইন, দেওদারের ঠাস বুনোট। গাড়ি থেকে নামতেই এই প্রথম ঠান্ডার স্পর্শ পেলাম। লাঞ্চ সেরে সামান্য হাঁটাচলা করতেই প্রেমে পড়ে গেলাম। ২০২৪ মিটার উচ্চতার পাটনিটপের আকাশে জাফরানি রঙের পোঁচ অসাধারণ। মূল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উপরে উঠলেই দেখা মিলবে আপাত নির্জন পাটনিটপ গ্রাম। শীতমাখা দুপুরে পাখির গান শুনতে শুনতে মন হারানো অচিনপুর পাটনিটপে। হঠাৎ ওসমান ভাইয়ের (আমাদের গাড়ির চালক) হর্নে সম্বিত ফিরে এল। ‘সাব, আব চল না হোগা’। বনপাহাড়ি পাটনিটপকে বিদায় জানাতে হল।
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে
দূর থেকে লম্বা গাড়ির লাইন চোখে পড়ল। গাড়ি আর বাসের ভিড়। সামনে চেকপোস্টে প্রতিটি গাড়িতে কঠিন-কোমল চেকিং চলছে। প্রায় ২০ মিনিট পর আমাদের গাড়ি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন ভারতীয় জওয়ানরা। তার পর ঢুকে পড়লাম জওহর টানেলের অন্দরমহলে। সার বেঁধে গাড়ি চলেছে। ভেপার ল্যাম্পের আলো সুড়ঙ্গের অন্ধকার ঘুঁচিয়েছে। অন্তত মিনিট কুড়ি ধরে চললাম এশিয়ার দীর্ঘতম গুহা-পথ। অবশেষে সরু ফিতের মতো আলোকবিন্দু চোখে পড়ল। বিন্দুটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। একসময় দীর্ঘ গুহা-পথের অবসান।
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে গাড়ির গতি কমতেই আখরোট-আপেল-চেরি হাতে স্থানীয় যুবকরা ছেঁকে ধরল। সেই সস্নেহ আবদার রক্ষা করতে এক কিলো আপেল কিনতেই হল। দূরে বছর ছয়েকের শিশু, হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ, বাড়িয়ে দিল। যার চোখেমুখে উপত্যকার স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের সরলতা। ৫০ টাকায় এক গুচ্ছ গোলাপ। মুগ্ধ শিশুর হাসিমুখের কাছে টাকার অঙ্কটা নিতান্তই তুচ্ছ। সামনের বিস্তীর্ণ উপত্যকার বুক চিরেছে লম্বা টানা সরু ফিতের মতো রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে রয়েছে চিনার গাছের ছায়াময় স্পর্শ। বিকেলে সোনা রোদের গুঁড়ো মায়াবী চিনার পাতায় চলকে পড়ে মায়াময় করেছে গোটা উপত্যকাকে। গাড়ির চাকা এগিয়ে চলে মাইলস্টোনকে পেছনে ফেলে। আপারমুন্ডা, ঘানাবল, অবন্তীপুর আরও কত সব নাম। কোথাও স্নিগ্ধ সবুজের বুগিয়াল, কোথাও বাগ-বাগিচা। ছোট্টগ্রামের পটভূমি শুধু নামে নয়, দর্শনেও স্পর্শ করা যায় ভূস্বর্গের সৌন্দর্যের সঞ্জীবনী ভাণ্ডার।
মায়াময় সবুজের সুড়ঙ্গ
সুড়ঙ্গের আবার কোনও রং হয় নাকি? নিকষ কালো অন্ধকার ফুঁড়ে গাড়ির হেডলাইট ঝলসে দেয় জমাটবাঁধা অন্ধকার। অন্তত এক কিমি আগে থাকতে চোখে পড়ল ‘গ্রিন টানেল’। গোটা উপত্যকা জুড়ে তখন মায়াবী আলোর রোশনাই। আকাশ ঘন নীল। কিন্তু সুড়ঙ্গ কই? খানিক চলার পর বুঝতে পারলাম সবুজ সুড়ঙ্গের রহস্য। প্রায় ৩ কিমি লম্বা রাস্তা জুড়ে উইলোর সবুজ সারিবদ্ধ গাছ, আকাশকে ছোঁয়ার চেষ্টায়। ঘনত্ব এতটাই বেশি যে গাছের সারির মধ্যে ব্যবধান খুবই সামান্য। সবুজ উইলোর আকাশ ছোঁয়ার চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দু’পাশের নিবিড় গাছের পাতার ঠাসবুনোট ঢেকে দেয় নীল আকাশকে। ফুরফুরে হিমেল বাতাসের বন্যায় এ ওকে কাছে টানছে। আবার নিবিড় আবেগে নিজেদের খেয়ালখুশির বাঁধনকে আরও আপন করেছে।
বাতাসে রোম্যান্টিক সুরের মূর্ছনা। শাম্মি কপূর থেকে রাজেশ খন্না থেকে অমিতাভ বচ্চন--- বহু হিন্দি ছবির এই সেই বিখ্যাত পটভূমি। আকাশ ঢাকা পড়ে সবুজের সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছে। সেই সৌন্দর্যের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এমন দীর্ঘ ‘গ্রিন টানেল’ ভূ-ভারতে আর কোথাও নেই, কাশ্মীর ছাড়া। সত্যিই, একমেবাদ্বিতীয়ম। এত সুন্দরের মাঝেও উইলোর ফাঁকে ফাঁকে উর্দিধারী সেনা জওয়ানরা। চোখে বাইনোকুলার, কারবাইন হাতে তৎপর। যাদের লক্ষ্য, এই সৌন্দর্যকে আগলে রাখা। আলো-আঁধারির কালচে সবুজ ছায়ামাখা পথ পেরোতেই দূরের পাহাড়ের খাঁজে সূর্য মুখ লুকিয়েছে। সামনেই শ্রীনগর।
লেকসিটি শ্রীনগর
পাক্কা এগারো ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে শ্রীনগর পৌঁছলাম। বহু প্রাচীন এই নগরীর নির্মাণ করেন সম্রাট অশোক। সম্রাট অশোক কন্যা চারুমতীকে নিয়ে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে শ্রীনগরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মেয়ের অনুরোধে তৈরি হয়েছিল বিহার। তৈরি হল জনপদ। অপার্থিব সৌন্দর্যের নামকরণ করেন শ্রীনগর। ১৭৩০ মিটার উচ্চতায় পিরপাঞ্জাল পাহাড় শ্রেণির কোলে ডাল, নাগিন, উলার লেক আর ঝিলাম নদীর বহতা নিয়ে এ শহরের বিস্তার। জম্মু থেকে প্রায় ২৯৫ কিমি দূরত্বে এই রাজধানী শহর। জিরো ব্রিজ পেরোতেই সেনাবাহিনীর তল্লাশি। তার পর নীলচে রংমাখা সুন্দর ঝলমলে বুলেভার্ড রোড।
বিশাল ডাল লেকের বুকে সারি সারি শিকারা আর ভাসমান ঝাঁ চকচকে হাউসবোট। তারাভরা উজ্জ্বল কালচে নীল রঙা আকাশের নীচে সারিবদ্ধ হাউসবোট দখল করে নিয়েছে ডাল লেকের হৃদয়। পাঁচতারা হোটেলের সমস্ত সুযোগ-সুবিধাই মজুত। এক্কেবারে রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার। আন্দরমহলে কাঠের কারুকাজ বিস্ময়কর ও মনোমুগ্ধকর। রাতের খাওয়া-- কাশ্মীরী বিরিয়ানির শাহি খানাপিনা। তার পর হিমেল হাওয়ায় ভূস্বর্গের রাতের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে যাওয়া। দূর থেকে ভেসে আসছে সন্তুরের ঝংকার। নিশব্দে হাউসবোটের ডেকচেয়ারের পাশে রাখা ‘কাংরি’ (কাশ্মীরের নিজস্ব হাত সেঁকার হিটার)। রেখে গেছে জান মহম্মদ ভাই।
হাজারো হাউসবোটের প্রতিবিম্ব লেকের কাজলকালো জলে। লেকের ও পারের ঝাঁ চকচকে বুলেভার্ড রোড তখন নিঝুম। মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর কনভয় হুইসেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। ডাল লেকের ‘প্যারাডাইস হাউসবোট’এ রাজকীয় রাত উপভোগ করেছি। একসময় এই ডাল লেক ছিল প্রায় ৪০ ফুটের মতো গভীর। আজ তা এসে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ২০ ফুটে। ডাল লেকের বিস্তার ছিল প্রায় ৭৫ কিমি। এখন ২৫ কিমিতে এসে ঠেকেছে। এখন অনেক রাত। গোটা শহর জুড়ে কার্ফুর স্তব্ধতা। প্যারাডাইস-এর রাজকীয় নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে দিনের শেষে ঘুমের দেশে পৌঁছে যাওয়া। স্বপ্নেও ভূস্বর্গের অসাধারণ সব ছবির কোলাজ। পর দিন সকালে লাল হলুদের স্বপ্নের শিকারায় ফুলের ডালি নিয়ে দাঁড় ছপছপ সুর তুলে ডাল লেকের বুক চিরে সারিবদ্ধ ভাবে চলেছেন শহরের দিকে। পূর্ব পাড়ের আকাশ তখনও ফর্সা হয়নি।
শিকারায় শিহরন
ডাল লেকের একমাত্র বাহন শিকারা। রাস্তার মতো হ্রদের শিকারারও ট্র্যাফিক জ্যাম। ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। টলটলে কাকচক্ষুর মতো ডাল হ্রদের বুকে পিরান (কাশ্মীরী পোশাক) পরিহিত মাঝি নিয়ে চললেন শিকারা বিহারে। চলে এলাম সবজিমান্ডিতে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন ব্যবসায়ীরা। নৌকোয় দূর দূরান্ত থেকে নানান আনাজপাতি, মাছ, মাংস। চলে দেদার কেনাবেচা। ভাসমান এক মহল্লা বললেও ভুল হবে না। জলে ভাসমান সেলুন। বিউটি পার্লার। ডাক্তারখানা। সাল-কার্পেটের দোকান। ফুল বাগিচা। কী নেই!
এমন জলে ভাসমান জীবনযাত্রার জলচিত্র, যা ভারতের অন্য কোনও প্রান্তে দেখা যায় না। ডাল লেক শহরের প্রাণভোমরা। ২৬ বর্গকিমির শরীরে তিনিট দ্বীপ রয়েছে। কবুতরখানা, তরতিমার এবং নেহরু পার্ক। শিকারায় সারা দিন ঘুরে দেখে নেওয়া যায় এই লেক মহল্লা। মাঝে মধ্যেই ফুলের গুলদস্তা দিয়ে সাজানো শিকারা। দু-এক গোছা ফুল উপহার দিয়ে চলে যাবে। তার পর ভাসমান রেস্তোরাঁয় কাশ্মীরী কাহাবা, চোঠ, পরোটা, শিককাবাবের মৌতাতে মজে যাওয়া। গোটা একটা দিন শিকারায় শিহরনের রোমাঞ্চকর ট্যুর সেরে রজতাভ শীতমাখা রোদ্দুর মেখে আবার রাজকীয় হাউসবোটের অন্দরমহলে।
মুঘল মহল্লায়: শ্রীনগরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বাগ-বাগিচা, মসজিদ, নানান স্থাপত্য ঘুরে দেখে নিন। হ্রদের পাড় ঘেঁসা বুলেভার্ড রোডের এক প্রান্তে পাহাড়ের মাথায় শঙ্করাচার্যের মন্দির। অন্য প্রান্তে হরিপর্বতের পাহাড় চুড়োয় প্রাচীন দুর্গ। যা বর্তমানে সেনাবাহিনীর দখলে। খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ২০০ বছর আগে সম্রাট অশোকের পুত্র বালুকা ‘তখত-ই-সুলেমান’ পাহাড়ের মাথায় একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আদি শঙ্করাচার্য এ পাহাড়ের চুড়োয় উঠে মন্দিরে তপস্যা করেছিলেন। তার পর থেকে ওই পাহাড়ের নাম হয়ে যায় শঙ্করাচার্য পাহাড়। গর্ভগৃহস্থ শিবমন্দির থেকে পাখির চোখে ধরা দেয় কাশ্মীর উপত্যকা। ঝিলাম নদী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে গোটা উপত্যকাকে। দূরে পীরপাঞ্জাল পাহাড়ের সাজানো সংসার, শহর থেকে ৫ কিমি দূরে ইন্দোসিরামিক স্থাপত্যশৈলির জামা মসজিদ। ১৩৮৮ সালে সুলতান সিকন্দর শাহ এ মসজিদ তৈরি করেন। মসজিদটি পরপর দু’বার ভস্মীভূত হয়। ডোগরার রাজা প্রতাপ সিংহ এই মসজিদটির সংস্কার করেন।
ডাল লেকের পশ্চিম পাড়ে হজরতবাল মসজিদ। আজ থেকে প্রায় ১০০০ বছর আগে মদিনা থেকে হজরত মহম্মদের পবিত্র ‘কেশ’ এই মসজিদে সংরক্ষিত করা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের অতি পবিত্র এই মসজিদের গঠনশৈলিতে শ্বেতপাথরের কারুকাজ মুগ্ধ করবে। সবশেষে শ্রীনগর ওল্ড সিটির খানওয়ার এলাকার রোজাবল সমাধিস্থল দেখে মুগ্ধ হলাম। ইহুদি স্থাপত্য শৈলির ‘শ্রাইন অফ হজরত ইউজা আসফ অ্যান্ড সৈয়দ নাসির-উদ-দিন’। ঐতিহাসিকদের মতে, ইউজা আসফ ও ভগবান যিশু একই ব্যক্তি, যাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। এখানে ছবি তোলা নিষেধ। ইউরোপিয়ানরা প্রবেশ করতে পারেন না।
বাহারি ফুলের রাজকীয় উদ্যান: পাহাড়ের কোলে চশমাশাহি, সম্রাট শাহজাহানের আমলে তৈরি এক অসাধারণ রাজকীয় উদ্যান। গোলাপের নানা প্রজাতি সেই ফুলের বাসরে। দূরে পাহাড়ের কুর্নিশ। নানান প্রজাতির মেলা। এক সময়ে এখানে বৌদ্ধ মঠ ছিল। পরবর্তী কালে শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাসুকো এই চশমাশাহিকে জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করেন। দূর পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলের ধারা। প্রবাদ আছে, এই প্রস্রবণের পবিত্র জল পান করলে অনেক রোগের উপশম হত। চশমাশাহি থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে আরও এক রাজকীয় উদ্যান ‘নিশাদবাগ’। পাহাড় ও ডাল লেকের ধাপ কেটে তৈরি হয়েছিল। সম্রাট জাহাঙ্গির তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী নুরজাহানের জন্য এই প্রমোদ কাননটি তৈরি করেছিলেন। নানান বাহারি ফুলের বিছানায় সুগন্ধী হিমেল বাতাসের ম ম গন্ধ। গোটা উদ্যানের পরিচর্যার জন্য রয়েছে ঝরনা আর ফোয়ারা। শালিমার বাগ আর টিউলিপ গার্ডেনের মহিমার খ্যাতি জগৎজোড়া। মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টিউলিপ ফুল পাওয়া যায়। বেগুনি, নীল, হলুদের মখমলি টিউলিপের বিস্তীর্ণ খেত মনে করিয়ে দেয় ‘ইয়ে কাঁহা আ গ্যায়া হাম’। শ্রীনগর দর্শন সেরে পর দিন চললাম ফুলের উপত্যকায়।
ফুলের ভূস্বর্গ: শহর শ্রীনগর ছাড়িয়ে মেঘ-রোদ্দুরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে তাংমার্গের পর থেকেই বদলে গেল দৃশ্যপট। চারপাশে বরফের পাহাড়, তার মধ্যে বরফির ছোঁয়া। চিরবসন্তের দেশ। সবুজের বুগিয়াল। তার মাথার উপর মুকুট পরে আছে দেশের প্রথম স্কি রিসর্ট। পনেরো শতকে সুলতান ইউসুফ খান এই ফুলের দেশকে আবিষ্কার করেন। গৌরী মার্গ হয়ে যায় জুলমার্গ। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ি গুঁড়ো গুঁড়ো ফুলের বিছানায় মোড়া অপার্থিব রূপ। এখানকার মূল আকর্ষণ এশিয়ার দীর্ঘতম কেবলপার গণ্ডোলা। দুটি পর্বতের বিস্তার। প্রথমার্ধে জুলমার্গ থেকে কংডোরি। দ্বিতীয় পর্বে কংডোরি থেকে আপারওয়াট। পাইনের বন আর মেঘ কুয়াশা সরিয়ে প্রায় আড়াই কিমি এই অসাধারণ যাত্রাপথের সৌন্দর্যে শুধুই মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা। দ্বিতীয় পর্বে বরফে মোড়া কংডোরি হয়ে আপারওয়াটের আড়াই কিমির যাত্রাপথে সঙ্গী শুধুই বরফ আর বরফ। সঙ্গে কারাকোরাম পর্বতশ্রেণির সুন্দর ঘেরাটোপ। উফ্ অসাধারণ। শীতে গুলমার্গ ঢেকে যায় শুধু বরফের চাদরে। শীতকালীন ক্রীড়ার আয়োজনে মেতে ওঠে বরফিলা গুলমার্গ।
সোনালি সোনমার্গ: শ্রীনগর থেকে আরও একটা দিন এক সোনামাখা উপত্যকায় বেরিয়ে পড়া। দূরত্ব ৮৭ কিমি। শ্রীনগর থেকে যে রাস্তা লে-লাদাখের দিকে চলে গিয়েছে, সে পথে গেলে সঙ্গী হবে সিন্ধু নদ। যার পাইনের বুকচেরা পাহাড়ের ঢালে, বুকচেরা রাস্তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে দৃশ্যপট বদলের সাক্ষী থাকে দু’চোখ। তাই ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’। আর হিন্দু থেকেই ‘হিন্দুস্থান’। অবশেষে ৮৭৫০ ফুট উচ্চতায় পাইন-ফারের চোখধাঁধানো মেলবন্ধনে এক সবুজ বুগিয়াল। নাম সোনমার্গ। গাড়ি এসে থামতেই নাছোড়বান্দা ঘোড়সওয়ারির দল। গাঁদা রঙা রোদ চলকে পড়ছে সবুজ বুগিয়ালে। ব্যাকড্রপে দুধ সাদা বরফ মোড়া পাহাড় শ্রেণির মাথায় ঘন নীল আকাশ। বরফমুক্ত বুগিয়ালে সোনালি ঘাসজমিনের অর্ধেকটায় এখন সবুজ। ছোট ছোট পাহাড়ি ফুলের চাদর মাড়িয়ে চলে এলাম থাজিবাস গ্লেসিয়ারের দিকে। আশেপাশে পাহাড়ে ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। সামনে সাদা বরফের গিরিপথ। পুরু বরফের আস্তরণ। সেখানে কাঠের স্লেজে, বরফের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছেন পর্যটকরা। হিমেল বাতাসে পুরু বরফ গ্লেসিয়ারের নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধুর প্রবাহ। সারা দিন সোনমার্গে প্রকৃতির সমস্ত রূপ-রং চেটেপুটে স্মৃতির হার্ডডিস্কে প্রচুর ছবি সংগ্রহ করে সিন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আবার শ্রীনগর ফেরত এলাম।
যিশুর যুসমার্গ: শ্রীনগর থেকে যুসমার্গের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিমি। ক্ষীরভবানী মন্দির দর্শন সেরে অল্প চেনা বনপাহাড়ের দেশ যুসমার্গে পৌঁছে গেলাম। ২৩৭৭ মিটার উচ্চতায় পথের দু’পাশে আঙুর, আপেল, আখরোটে গাছের আধিপত্য। যার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় কারাকোরামের পবর্তশ্রেণি। এরই মাঝে সবুজ বুগিয়ালের এক কোণে গুর্জরদের গ্রাম। প্রকৃতির স্তব্ধতা। ঢেউ খেলোনো সবুজ উপত্যকা। সেই সবুজের মাঝে লাল পপির সাম্রাজ্য। পর্যটন দফতরের রেস্তোরাঁ থেকে কারাকোরামের মাউন্ট টাটাপোটি, মাউন্ট রোমেস থং, সানমেট পিকে রঙবেরঙের খেলা দেখতে দেখতে লাঞ্চ সারা। এখানে আলাপ জান মহম্মদ আলমের সঙ্গে। ৮২ বছরের বৃদ্ধ। কপালে ডন ব্র্যাডমানের মতো অজস্র ভাঁজ। তিনি জানালেন স্বয়ং যিশু সূদুর জেরুজালেম থেকে লাদাখ হয়ে যুসমার্গ উপত্যকায় এসেছিলেন। যিশুর নামেই এই উপত্যকার নাম। যুসমার্গ। ফেরার পথে চারার-ই-সরিফের মাজারটি ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। কাঠের এই মাজারটি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু মাজারটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যুসমার্গে না এলে বোঝাই যাবে না ভূস্বর্গের আসল সৌন্দর্য।
পুনশ্চ পহেলগাঁও: কাশ্মীরের বিউটিস্পট। শ্রীনগর থেকে ৯৬ কিমি দূরে ‘প্রথম গ্রাম’ বা ‘পহেলাগাঁও’ থেকেই পহেলগাঁও। ফার, পাইন, উইলো, সিনার গাছের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক অসাধারণ পিকচার পোস্টকার্ড। খরস্রোতা লিদ্দার এখানকার রাজা। তার খরস্রোতা শরীরের উছলে ওঠা যৌবন নীল আকাশকে ছুঁয়েছে। সেই নীলচে সবুজের স্রোতে মিশেছে উপত্যকার স্বর্গীয় উচ্ছ্বাস। নীল আকাশের নীচে পাইন ফারের বনের ও-পারে উঁকি দেয় শৃঙ্গরাজরা। পাহাড়ের হৃদস্পন্দনকে সঙ্গী করে চলে এলাম চন্দনওয়ারি। পহেলগাঁও থেকে ১৬ কিমি লিদ্দরকে পাশে পাশে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া। এই চন্দনওয়ারি থেকে রোমাঞ্চকর হাঁটা পথে পৌঁছোনো যায় অমরনাথ গুহায়। পাইন ফার দেওদার ছাওয়া পথে ৬ কিমি গেলেই পৌঁছোনো যায় বেতাব ভ্যালি।
কাঠের সেতু, বাগান, রেস্তোরাঁ দিয়ে সাজানো বেতাব ভ্যালিতে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আভাস, অসাধারণ। ঠিক ভাবে পহেলগাঁওকে দেখতে হলে অন্তত তিনটি দিন রাখা প্রয়োজন। পহেলগাঁও থেকে আরু, কোলহাই গ্লেসিয়ার, লিডারওয়স, তারসার লেক ভূস্বর্গের অল্পচেনা অচিনপুর। সহজ সরল গ্রাম জীবনে নীরবতা, নিস্তব্ধতার সৌন্দর্যে শুধুই বুঁদ হয়ে থাকা। চিনার গাছের থেকে ঝরে পড়া পাতা সৌন্দর্যের উড়োচিঠির মেঘবালিকারা জানান দেয় ‘ইয়ে কাশ্মীর হ্যায়, ইয়েহি.......’।
অমলিন আরু: পাহাড়ের রোদের ঝলক, রূপের হাটে মাতোয়ারা প্রকৃতির সৌন্দর্য চেটেপুটে নেবার পালা। সুন্দরতম স্বর্গীয় নিসর্গকে পাথেয় করে চলা। বারে বারে থামতে হচ্ছে গাড়ি। এমন দৃশ্য ফ্রেমবন্দি করে রাখতে হচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন এক জায়গায় জড়ো হয়েছে পহেলগাঁওয়ের ছোট গ্রাম আরুতে। পহেলগাঁও থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে অমলিন আরু। যত দূর চোখ যায়, তত দূরই সবুজ। পাহাড় থেকে নেমে আসছে সুন্দরী এক ঝরনা। গাড়ির চালক রফিক ভাই অতি সন্তর্পণে সেই ঝরনা পেরিয়ে গাড়ি দাঁড় করালেন। নীল আকাশের নীচে সবুজের ঢেউ খেলোনো বুগিয়ালে রঙবেরঙের ছোট ছোট কটেজ। ভেড়ার পাল চড়ে বেড়াচ্ছে এ দিক ও দিক। পাহাড়ের এ দিকে রোদ্দুর, অন্য দিকে মেঘ পলকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরে শরীর। ভেজে শরীর, ভেজে মন। প্রবল ঠান্ডায় ভেজা শরীর নিয়ে এক ছুটে কটেজের অন্দরমহলে। গরম কফির মগে চুমুক দিতে দিতে উপত্যকার রূপ রস যৌবনের স্বর্গীয় আভায় শুধুই চুমুক। দূরে চিনারের বিস্ময়কর ব্রিগেড। গুর্জরদের ভেড়ার পাল চড়ে বেড়ানো। এ সবই শুধু স্বর্গীয় নিস্বর্গের অমলিন কোলাজ। ভূস্বর্গ কাশ্মীরের তুলনারহিত কোলাজ।