সে দিন রাতে ঘুম আসছিল না।
কালি কলম আর মন নিয়ে কাজ করতে করতে নিদ্রাদেবীর কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়েছি— এমন হয়েছে অনেক দিন। সে দিনও দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। দুচ্ছাই বলে এক সময় বিছানা ছেড়ে উঠেই পড়লাম। শীতের রাত। তবু জানলা দিয়ে আকাশটা দেখে মনে হল একটু ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। এই ব্যালকনি, এই রাতের আকাশ আমার কত যে ভাবনার সাক্ষী— যখনই নিজেকে নিয়ে একটু একা হতে চাই, তখনই এরা আমাকে সঙ্গ দেয়। এমন বন্ধু আর কে আছে...? সে দিন আকাশ অন্ধকার ছিল না। পূর্ণিমার চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ছিল আকাশ থেকে। মনে মনে ভাবছিলাম, ভাগ্যিস এই ব্যালকনিটা ছিল! তাই জ্যোৎস্না আড়ি করে না আমার সঙ্গে। সে দিন রাতে এক আকাশ জোৎস্না নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আমি। এই জোছনাভরা রাত বড় রহস্যময় এক প্রহেলিকা। কেউ জেগে নেই। সারমেয়রাও বড় বেশি নিস্তব্ধ। রাস্তার আলোগুলো শীতের কুয়াশায় যেন ঘষা কাচের মধ্য দিয়ে সাদা আলোর মতো প্রভাহীন। আমি নিশ্চল নীরব রাতের নিজস্ব ভাষা অনুভব করার প্রয়াসে দাঁড়িয়েছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
মনে হচ্ছিল কত কাল এ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, একা। আমার চারপাশে চলমান জগৎ যেন স্রোতস্বিনী নদী। বইছে, বইছে, বইছে নিরন্তর নিরবধি। আমার নির্বাক সত্তা এক সময় মুখর হয়। জিগ্যেস করে সেই জীবন নদীকে, তুমি কোথা থেকে এসেছ? কোথায় তোমার পথের শেষ?
নদী হেসে ওঠে। কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? এ যে সার প্রশ্ন করলে গো? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? এসেছি সেই পরম পুরুষ পরমাত্মা থেকে আবার সেই পরামাত্মাতেই বিলীন হয়ে যাব। সূর্য যেমন তার থেকে নির্গত রশ্মিগুলোকে নিয়ে আবার অস্ত যায়। সূর্যের রশ্মি আবার সূর্যেই ফিরে যায়, তেমনই। কিন্তু কবে পরমাত্মার সঙ্গে মিলন হবে তা তো বলতে পারব না। মিলন হবে এই আশাতেই যে পথ চলা।
আমি চমকে উঠি নদীর কথায়! কে তুমি? তুমি তো সাধারণ নও। এই গূঢ় অনুভব এ তো সাধারণের নয়।
নদী বলে ওঠে, আত্মজ্ঞানের সার বিতরণ করাই যে আমার কাজ।
হে নদী, এতক্ষণে চিনেছি তোমায়। তুমি সরস্বতী...দেবী! বাগীশ্বরী, মহাবিদ্যা, মহাবাণী। তুমি অগ্নিকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলে সমুদ্রে। সমুদ্র অর্থাৎ পরমাত্মা আর অগ্নি আত্মজ্ঞান। তুমিই দেবীরূপে পরিগ্রহ করে মানুষকে আত্মজ্ঞান লাভের পথনির্দেশ করো। বিদ্যা, কলা, সুর, তাল, ছন্দ— এ সবই যে সেই পরমাত্মার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম বিশেষ। তাই তুমি দেবী। জ্ঞানলাভের আকাঙ্ক্ষা নদী সরস্বতীর বহমানতার সঙ্গে মিশে রূপ পরিগ্রহ করেছেন দেবী সরস্বতী।
অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আমাদের মুক্তির আলোয় নিয়ে চলো হে দেবী। অন্তরের অন্তস্থলে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন তিনি। শুভ্রবর্ণা, শ্বেতবসনা দেবী পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর চার হাত চার দিককে নির্দেশ করছে— তিনি চরাচরে পরিব্যস্ত। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার— ব্যক্তিত্বের এই চার বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ তাঁর মধ্যে। তাঁর হস্তধৃত পুস্তক সম্যক জ্ঞানের পরিচায়ক। অপর হস্তে রুদ্রাক্ষের মালা— যার অর্থ মনঃসংযোগ ও ধ্যানের দ্বারা লাভ করতে হবে এই জ্ঞান। সরস্বতীর বাহন রাজহংস। সংসারে থাকো কিন্তু জানো এ মায়ার সংসার— এই গূঢ় অর্থ বহন করে এই হংস। কখনও কখনও দেবী ময়ূরের উপর উপবিষ্ট। ময়ূর প্রকাশ করে মানুষের জাগতিক বাসনা, যার কোনও শেষ নেই। তাই জাগতিক কামনা ত্যাগ করে অন্তর্মুখী হও— অন্তরেই পরম পুরুষের আবাস। সরস্বতীর বীণার তারে বেজে ওঠে মহাকালের সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা যা জাগিয়ে তুলবে অন্তরের শক্তিকে।
ওই জ্যোৎস্নালোকিত রাতে শুভ্র পবিত্র দেবীমূর্তি আমার মানসলোক আলোকিত করে উদয় হলেন। আমি যেন স্নানুবৎ এক সামান্য দর্শক। আমার সম্মুখে মহাকালের বিশাল চলচ্চিত্র অভিনীত হয়ে চলেছে।
ঐ তো সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ধ্যানে বসেছিলেন। ব্রহ্মার কপাল থেকে নির্গত হয়েছেন দেবী সরস্বতী। অপরূপ সুন্দর বললেও কম বলা হয় এমনই তাঁর সৌন্দর্য। চোখ মেলে তাকালেন ব্রহ্মা। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়লেন তিনি দেবী সরস্বতীর। কামনা করে বসলেন দেবীকে। হায় পুরুষ, হলেনই বা তিনি দেবতা— যুগে যুগে নারী যে তার কামনার ধন। নারীর সত্তাকে কোনও দিন বোঝার চেষ্টা করেছে সে? দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার শরীরসঞ্জাত— সেই অর্থে দেবী তাঁর মানসপুত্রী আর সেই দেবীকেই কিনা অঙ্কশায়িনী করতে চান তিনি। তীব্র বিরোধিতায় দেবীর মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠল। দেবী পালাতে চাইলেন ব্রহ্মার কামপূর্ণ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু যে দিকেই দেবী গমন করেছেন, সে দিকেই ব্রহ্মার একটি করে মস্তক সৃষ্টি হয়েছে। সরস্বতীর দিক থেকে এক বারের জন্যও দৃষ্টি সরাননি তিনি। এমনকী দেবী ওপরে গমন করলেও ঊর্ধ্বেও আর একটি মস্তক তৈরি হয়েছে দেবীকে চোখের আড়াল না করার নিমিত্ত। অবশেষে সফল হয়েছেন ব্রহ্মা। সরস্বতীকে বিবাহ করেছেন তিনি দেবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। দেবীর প্রভাকে ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রহ্মার কামনা।
এই কি মেয়েদের জীবন! দেবী নারী বলেই কি তাঁর এমন অসহায়তা! কেন যুগ যুগ ঘরে নারী কেবল পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে থাকবে? কেন দ্রোপদী, সীতা, হেলেনকে লাভ করার জন্য মরণপণ সংগ্রাম করতে হবে? কেন আজও পুরুষের লোভ লালসা কামনার যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হবে নির্ভয়াদের? এই ‘অজস্র কেন’র উত্তর নারীই দেবে। নারী কারও মুখাপেক্ষী নয়, কারও গলগ্রহ নয়— নারী স্বীয় মর্যাদায় ভাস্বর।
দেবী সরস্বতীকে ব্রহ্মা বিবাহ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁকে সম্পূর্ণ ভাবে পাননি। দেবীর মনন, চিন্তা, সঙ্গীত, কলা, প্রজ্ঞা এ সবই অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই দেবী একাকীই স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল। সেখানে কোনও পুরুষের ছায়া নেই। বরং পুরুষদের তিনি কৃপা করে গেছেন। দস্যু রত্নাকর মহাকবি বাল্মিকী হয়েছেন। কালিদাসের লেখনী দেবী ভারতীর আশীর্বাদেই হয়ে উঠেছে বাঙ্ময় আর আমাদের কবিগুরু যাঁর ছেলেবেলায় কেউ তাঁর সম্পর্কে বড় কিছু হওয়ার আশা করেননি, তিনিও যে পেয়েছিলেন দেবীর অকুণ্ঠ আশীর্বাণী।
পুরুষ নয়, কবি— কবি কাছে এসো, দু’হাত ভরে লাভ করবে দেবীর আশিস!
আমি সামান্য মানুষী, দর্শক মাত্র। আমার চারি দিক ক্রমে পূর্ণ হয়ে ওঠে বনফুলের সৌরভে— বহুদূর থেকে ভেসে আসে বীণার তারের মধুর ঝংকার— কল্পলোকে রূপকথার মতো দেবী সরস্বতী কমলাসনে আসীন। কোনও সুদূরে নিবদ্ধ দু’চোখের দৃষ্টি। প্রগাঢ় অনুভব ফুটে উঠেছে সে চাহনিতে। দেবী সরস্বতী--- তাঁর আদি নেই, অন্ত নেই, তিনি সর্বব্যাপী— স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক জগতের সার।
আপনা থেকে নত হয়ে এল মস্তক।
‘সা মে বসতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী।
মুরারি-বল্লভা দেবী সর্বশুক্লা সরস্বতী।।
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমলালোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তু তে।
বীণা ও পুস্তক ধারিণী মুরারিবল্লভা, সর্বশুক্লা, দেবী সরস্বতী আমার জিহ্বায় বাস করুন। হে মহাভাগে, বিদ্যাস্বরূপে, কমললোচনে, বিশ্বরূপে, বিশালাক্ষি সরস্বতী আমায় বিদ্যা দাও, তোমায় নমস্কার। সরস্বতীস্ত্রোত্র ধ্যান করে চলেছি, এমন সময় রাতচরা পাখির ডাকে সম্বিৎ ফিরল। নিমেষে ফিরে এলাম পারিপার্শ্বিকতায়। কোথায় সেই পদ্মাসনা দেবী ভারতী? কোথায়ই বা সেই বীণার সুর! এতক্ষণ যা দেখলাম তা কি স্বপ্ন! না কি আমারই মনের ভাবনার প্রতিফলন। সে যাই হোক, অনাবশ্যক প্রশ্নকে প্রশ্রয় না দিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। দেবী তো সর্বব্যাপী। বাহির ও অন্তরে তিনিই আছেন জীবন জুড়ে। অতএব কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও দ্বিধা নয়— তাঁর ধ্যান করে চল নিরবধি। তাঁর কৃপাই নিয়ে যাবে সাধনায় সিদ্ধিলাভের পথে। এখানে একটা অকপট স্বীকারোক্তি করি! এই সরস্বতী পুজো জানে আমাদের অনেকের অনেক প্রথম কিছু। আমরা, মেয়েবেলায়, প্রথম শাড়ি পরি শ্রীপঞ্চমীর সকালেই। ছেলেরা ধুতি-পাঞ্জাবি? সে-ও সেই সকালেই। কেউ কেউ অবশ্য পাজামা-পাঞ্জাবি। ছেলেরা অনেকেই প্রথম সিগারেটের স্বাদ নেয় শ্রীপঞ্চমীর সকালেই। অপাঙ্গে তাকানো সেই সকালেই। শ্রীপঞ্চমীর সকালটা বড় সুন্দর আর ঝকঝকে।
হ্যাঁ, সাধনার কথা বলছিলাম। সাধনায় সিদ্ধিলাভ কথাটি বিপুল অর্থবহ। এক একটি মানুষ এক একটি জীবন সাধনাও তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চলে। সাধনার পথ বহু, কিন্তু পৌঁছয় সেই এক চরম লক্ষ্যে। সুধীজন আপনারা যে দিন এই লেখা পড়বেন তার কিছু দিন পরেই বসন্ত পঞ্চমী দেবী সরস্বতীর আরাধনার দিন। তারও এক দিন পরে জন্মদিন পালিত হবে ভারতমাতার এক কৃতী সন্তানের। তাঁর সাধনা ছিল দেশপ্রেম দেশমাতৃকাকে বন্ধনদশা থেকে মুক্তা করা।
ব্রিটিশ শাসনের দর্প, দম্ভকে চূণর্র্ করে পূর্ণ স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে চলাই ছিল তাঁর জীবনের মহান ব্রত। বিগত শতকে ১৯১৯ সালে তাঁর বয়স কতই বা ছিল? মাত্র বাইশ বছর। ইংল্যান্ডে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসতে গিয়েছেন এই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রটি। ১৯২০ সালে দেশের সব থেকে ‘প্রেস্টিজিয়াস’ সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছেন এবং শুধু উত্তীর্ণ নয় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন। তার পর সেই চাকরির শিক্ষানবিশ থেকে মাঝপথে বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ইংরেজের গোলামি করবেন না, যে ইংরেজের নির্মম গুলিতে পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে শয়ে শয়ে মরেছে মানুষ— শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ। নিছক অল্প বয়সের আবেগের বশে যে এই প্রত্যাবর্তন নয়, তা সারা জীবনের সংগ্রাম দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি আমাদের সকলের প্রিয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
আজ এই স্বাধীন ভারতে আমরা কেউ ভাবতে পারব বিদেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে শুধুমাত্র দেশের সেবায় জীবন উৎসর্গ করার কথা। অবশ্য এমন মানুষ কোটিতে একজনই হয়। তাই তো তিনি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি দেশের স্বাধীনতার জন্য বিরোধী কোনও কিছুর সঙ্গে আপস করেননি। স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে জটিল রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তও তাঁকে তাঁর লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ গাঁধিজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মত ও পার্থক্য ছিল বিস্তর। গাঁধিজির অহিংস পন্থায় আবেদন নিবেদন নীতির মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরোধিতায় নেতাজির আস্থা ছিল না। নেতাজি বিশ্বাস করতেন এ ভাবে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না। দরকার হল সশস্ত্র আন্দোলনের পথে যেতে হবে বইকী। ভারত বিদেশিদের পদানত হয়ে থাক এ তিনি চাননি কোনও দিনই। তাই ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বা ইংরেজের অধীনে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কংগ্রেসের অধিবেশনে গাঁধিজির পেশ করা এই প্রস্তাবের বিরোধিকা করে গাঁধিজির বিকল্প নেতৃত্বের অঙ্গীকার নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন যুবক সুভাষচন্দ্র। কিন্তু সুভাষচন্দ্র এ সবই করেছিলেন ভারতমাতার মুখ চেয়ে। ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, লোকাচার এবং সর্বোপরি ভারতের জনগণের প্রতি তিনি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, ভারতকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন এক গভীর ঐতিহ্যবাহী স্বাধীন দেশ হিসেবে যে দেশে ফল্গুধারার মতো হয়ে চলেছে অনিঃশেষ আধ্যাত্মিকতা। পরবর্তী কালে সুভাষচন্দ্র যখন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মধ্যগগনে তখন কংগ্রেসের গাঁধীপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মত ও পথের প্রকাশ্য বিরোধ তাঁকে বাধ্য করেছিল কংগ্রেস ত্যাগ করতে। তবু মনোবল হারাননি। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব দল ফরোয়ার্ড ব্লক।
মতপার্থক্য থাকলেও গাঁধিজির প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, তাই নিজে সরে এলেন। ক্ষমতার লোভ কোনও দিনই ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই--- ভারতের স্বাধীনতা। ভারতের শাসন ব্যবস্থায় সাম্যবাদ তিনি চেয়েছিলেন কিন্তু কোনও দেশের অনুকরণীয় সাম্যবাদ নয়। ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাম্যবাদ, যা মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে না। যেমনটা চিন অথবা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে আমরা দেখেছি। কামানের মুখে সাম্যবাদ চাপিয়ে দেওয়া।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ অধ্যায়--- কার্যত সুভাষচন্দ্র একাই মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ভারতের মধ্যে থেকে না হলেও ভারতের বাইরে থেকে ব্রিটিশের শত্রু দেশগুলিকে নিয়ে চরম আঘাত হানতে হবে— এই ছিল তাঁর নীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত সুযোগ নিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের নিয়ে সিঙ্গাপুরে তৈরি করেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। বর্মা সীমান্ত দিয়ে এই বাহিনী প্রবেশ করেছিল ভারতে। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইংল্যান্ডের বিপক্ষ দেশ জাপানের পরাজয় আজাদ হিন্দ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে তবু আজাদ হিন্দ-এর আঘাত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভীত টলিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
বিক্ষোভ, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের অভ্যন্তরেও। ভারতকে আর বেশি দিন পায়ের তলায় দমিয়ে রাখা যাবে না তা ব্রিটিশ শাসনকর্তারা তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। শেষমেশ ১৯৪৭ সালের পনেরোই অগস্ট আমরা লাভ করেছিলাম পূর্ণ স্বাধীনতা— যদিও এর মূল্য দিতে হয়েছিল ভারতকে বিভক্ত করে। হায়, নেতাজি সে সময় আর আমাদের মধ্যে নেই। ১৯৪৫ সালের ১৭ অগস্ট তিনি ব্রিটিশের হাতে ধরা দেবেন না বলে বিমানে রওনা হন অজানা গন্তব্যের দিকে। কিন্তু তিনি আর ফিরে এলেন না, হারিয়ে গেলেন কোথায় তা আমরা আজও জানি না। বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু আজও প্রমাণসাপেক্ষ। আমরা সেই মৃত্যু স্বীকার করি না। ১৯৪৫ সালের ১৭ অগস্ট তো তাইহোকুতে কোনও বিমান দুর্ঘটনাই হয়নি!
আসলে নেতাজির মতো মানুষের কখনও মৃত্যু হয় না। নেতাজির আদর্শই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে আপামর মানুষের মধ্যে। নেতাজি মৃত্যুহীন প্রাণ।