দিল্লিতে ফের বিধানসভা নির্বাচনের সম্ভাবনা মাথায় রেখে, ঘর গোছাতে নামল আম আদমি পার্টি।
পঞ্জাব বাদে ভরাডুবি হয়েছে গোটা দেশেই। এমনকী, ছ’মাস আগেই দিল্লির মসনদ দখল করেছিল যে দল, সেই রাজধানীতেও এ বার মুখরক্ষায় ব্যর্থ তারা। দিল্লিতে লোকসভার সাতটি আসনেই দ্বিতীয় হয়েছেন আম আদমি পার্টির প্রার্থীরা। তবে দলের ভোট পরবর্তী বিশ্লেষণ বলছে, দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় লোকসভায় ৪ শতাংশ ভোট বেড়েছে আপের। দল মনে করছে, চলতি বছরেই ফের বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে দিল্লিতে। তাই পরাজয়ের গ্লানি মুছে দলের শীর্ষ নেতা অরবিন্দ কেজরীবালের নেতৃত্বে নতুন করে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নামতে চাইছেন আপ নেতৃত্ব। আর এখন নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে না পড়লে দলে ভাঙন রোখা যাবে না বলেও আশঙ্কা রয়েছে আপ শিবিরে।
ডিসেম্বরে বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির ক্ষমতা দখল করলেও, জন লোকপাল বিলে সমর্থন না মেলায় সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন অরবিন্দ কেজরীবাল। জন লোকপাল বিল পাশে ব্যর্থ হওয়ায় দিল্লির উপ রাজ্যপাল নাজিব জঙ্গের কাছে বিধানসভা ভাঙার প্রস্তাবও দেন কেজরীবাল। কিন্তু কেজরীবালের সুপারিশ খারিজ করে দিয়ে বিধানসভা জিইয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন জঙ্গ। দিল্লির রাজনীতিতে জল্পনা ছিল, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার গড়া সম্ভব হলে, হয়তো আপ শিবিরকে ভাঙিয়ে সরকার গড়বে দিল্লি বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিজেপি। বর্তমানে ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় সরকার গড়তে বিজেপির প্রয়োজন ৪ জন বিধায়ক। কিন্তু প্রথম থেকেই দিল্লিতে অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে সরকার গড়ার বিপক্ষে ছিলেন মোদী। এখন সাতটি আসনে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ জয়ের পর দিল্লিতে নতুন করে বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে বিজেপি শিবিরেই। কারণ হিসাবে মোদী ঘনিষ্ঠ দলের একাংশ বলছে, কেন্দ্রে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়েছে দল।
দিল্লিতেও সাতটি আসনে জিতেছেন দলীয় প্রার্থীরা। এর পরেও দিল্লিতে জোড়াতালি দিয়ে সরকার গড়লে আখেরে বদনাম হবে দলেরই। বরং নির্বাচনে লড়াই করাই শ্রেয়। তাতে যা হয় হবে। আর এখনকার মতো সুবিধাজনক অবস্থায় ভোটে গেলে কর্মীদের মনোবলও বজায় থাকবে।
ফলে দিল্লিতে যখন ফের নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হতে শুরু করেছে, তখন ফলাফলের পরের দিনই নিজেদের দুর্গ রক্ষায় নেমে পড়েছে আপ নেতৃত্ব। দলের শীর্ষ নেতারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আজ দিনভর বৈঠক করেন। আপ সূত্রের বক্তব্য, প্রায় চারশোর বেশি আসনে প্রার্থী দিলেও লোকসভার নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট করে দিয়েছে, দলের মূল শক্তি হল দিল্লিই। দিল্লিতে একটি আসনেও জিততে না পারলেও, প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে তারা। আপ শিবির মনে করছে, গোটা দেশের পরিবর্তে কেবল দিল্লিতে যদি দল মনোনিবেশ করত, তা হলে তাদের আসন সংখ্যা বাড়ত। কিন্তু তা না করে গোটা দেশে শক্তি বিস্তারে নেমে ভুল হয়েছে বলে মনে করছে আপের একটি বড় অংশ। যদিও কেজরীবালের পরিকল্পনাতেই আসনের চেয়ে গোটা দেশে নিজেদের পরিচিতি বাড়াতেই দল ওই রণকৌশল নিয়েছিল। কিন্তু কেজরীর ওই পরিকল্পনা নিয়ে এখন দলের মধ্যেই সরব হয়েছেন অন্য আপ নেতারা।
নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষায় এখন ওই বিবাদ ভুলে নতুন করে কেজরীবালের নেতৃত্বে লড়াইয়ে নামতে চাইছে দল। কারণ আপ শিবির জানে, তাদের প্রধান বাজি হলেন কেজরীবালই। তাই কেজরীবালকে সামনে রেখেই আজ থেকে বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে দল। দলীয় কর্মীদের কাছে রাজধানীর প্রত্যেকটি বুথ ভিত্তিক ফলাফল চেয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সেই রিপোর্ট চলে আসার কথা। কোন এলাকায় কী ধরনের খামতি রয়েছে দলের, তা খতিয়ে দেখতে আপ নেতা যোগেন্দ্র যাদবের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যোগেন্দ্র যাদব বলেন, “বিজেপির এই ঝড় সত্ত্বেও বিধানসভা নির্বাচন থেকে প্রায় চার শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে দল। সুতরাং আমাদের ভোটব্যাঙ্ক শুধু অটুট আছে তা নয়, শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।” দলের বিশ্লেষণ, বিধানসভা নির্বাচনে ঝুপড়িবাসী, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ছাড়াও, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজের ভোট পেয়েছেন আপ নেতৃত্ব। কিন্তু লোকসভায় মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তদের ভোট বিজেপির ঘরে গিয়েছে। সে কারণেই আসন পেতে ব্যর্থ হয়েছে দল। দলের বক্তব্য, ভোটব্যাঙ্ক অটুট না থাকলে পূর্ব দিল্লি থেকে রাজমোহন গাঁধীর পাঁচ লক্ষ ভোট পাওয়া সম্ভব হত না।
কিন্তু কেন মুখ ঘুরিয়ে নিল সমাজের একটি অংশ?
বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির ক্ষমতা দখলে আপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজ। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পরেই কেজরী সরকারের একের পর হঠকারী সিদ্ধান্ত, রেল ভবনের সামনে ধর্নায় বসে দিল্লির প্রাণকেন্দ্রকে অচল করে দেওয়া, সর্বোপরি জন লোকপাল বিলের প্রশ্নে যে ভাবে সরকার থেকে ইস্তফা দেন, তা দিল্লির শিক্ষিত শ্রেণি মোটেই ভাল ভাবে নেননি। দলের এক নেতার কথায়, “খোদ সরকারের এ ভাবে নৈরাজ্য সৃষ্টি দিল্লির বড় অংশের মানুষ ভাল চোখে দেখেননি। আর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে দলও দিল্লিবাসীকে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে।” সে সময়ে সরকার থেকে বেরিয়ে না আসলে লোকসভায় শুধু দিল্লি নয় অন্য রাজ্যেও আরও ভাল ফল করত দল। আপের একটি বড় অংশ মনে করে, আপের উচিত সবার আগে দিল্লিতে ক্ষমতা দখল করে সুষ্ঠু প্রশাসনের নজির সৃষ্টি করা। দল যদি দিল্লিতে সফল হয় তাহলে সেই কাজের উদাহরণ তুলে অন্য রাজ্যেও ভাল ফল করতে পারবে। তাই আপাতত দিল্লির নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে রাজধানীর ক্ষমতা দখলে কেজরীবালের নেতৃত্বে ঘুঁটি সাজাতে আজ থেকে তৎপরতা শুরু করে দিল আপ নেতৃত্ব।