মুখের হাসি চওড়া হওয়ার কথা ছিল মনমোহন সিংহ-চিদম্বরমের। কিন্তু কৃতিত্ব পেয়ে যাচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বী নরেন্দ্র মোদী। নতুন এই আপদের মুখোমুখি হয়ে অবশেষে মুখ খুলেছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
দেশের অর্থনীতিতে বিদেশি লগ্নির ভাটা কেটে গিয়ে এখন ফের জোয়ার আসার ইঙ্গিত। মূল্যবৃদ্ধির হারও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সর্বোপরি শেয়ার বাজারের সূচক ২২ হাজারে পৌঁছে রেকর্ড করেছে। লোকসভা ভোটের আগে তো এটাই কাম্য ছিল ইউপিএ সরকারের। কিন্তু ইচ্ছেপূরণ হলেও কৃতিত্ব মিলছে না। শেয়ার বাজারের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে স্থায়ী সরকার গঠনের আশাতেই লাফিয়ে বেড়েছে সূচক।
বিশেষজ্ঞদের এই যুক্তি শুনেই চটেছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। চিদম্বরমের দাবি, স্থায়ী সরকারের আশায় নয়, গত ১৮ মাসে অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে ইউপিএ সরকার যে সব পদক্ষেপ করছে, তাতে ভর করেই নতুন লগ্নি আসছে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম বাড়ছে। শেয়ার বাজারও তেজি হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তা মজা করে বলছেন, “চিদম্বরমের অবস্থা এখন অনেকটা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো!” কেন? ওই আমলার বক্তব্য, “রাহুল দ্রাবিড় দিনের পর দিন ইনিংস গড়তেন, ভারতের হয়ে ম্যাচ বাঁচাতেন। কিন্তু চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং করে ম্যাচের সেরার ট্রফিটা নিয়ে যেতেন সচিন, সৌরভ বা অন্য কেউ। অর্থমন্ত্রীর অবস্থাটা এখন সেই রকমই। নতুন করে ফের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরেই ঘাটতিকে লাগাম পরানোকে পাখির চোখ করেছেন উনি। বিদেশি লগ্নি টানতে সব থেকে বেশি জোর দিয়েছেন। এখন তার ফল মিললেও কৃতিত্ব চলে যাচ্ছে মোদীর ঝোলায়।”
এমনিতেই এ বারের লোকসভা ভোটে প্রার্থী না হওয়ায় বিজেপির আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল চিদম্বরমকে। তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা কেন্দ্রে এবার নিজে প্রার্থী না হয়ে পুত্র কার্তি চিদম্বরমকে প্রার্থী করেছেন তিনি। বিজেপি নেতৃত্বের কটাক্ষ, দেশের অর্থনীতিকে ডুবিয়ে দিয়ে চিদম্বরম এখন অবসর নিতে চাইছেন। ভোটে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও নেই। বিজেপির অভিযোগ নিয়ে চিদম্বরম অবশ্য মুখ খোলেননি। তাঁর বদলে পুত্র কার্তির হয়ে শিবগঙ্গায় প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন চিদম্বরম। কিন্তু অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কৃতিত্বও মোদী পেয়ে যাচ্ছেন দেখে আজ মুখ খুলেছেন চিদম্বরম। চিদম্বরমের মন্তব্য, “এটা শুনে আমি বিস্মিত যে স্থায়ী সরকারের আশায় বিনিয়োগ আসছে, শেয়ার বাজার চাঙ্গা হচ্ছে আর টাকার দাম বাড়ছে। কোনও আশা নয়, বাস্তব তথ্য হল ইউপিএ এত দিন দেশকে স্থায়ী সরকার দিয়েছে। অর্থনীতিকে স্থায়িত্ব দিতে ও শক্তিশালী করতে গত ১৮ মাসে অসংখ্য পদক্ষেপ করেছে। এ তো তারই সুফল।”
চিদম্বরম নরেন্দ্র মোদীকে কোনও কৃতিত্ব দিতে না চাইলেও দেশি-বিদেশি সংস্থার বিশেষজ্ঞরা কিন্তু মনে করছেন, শেয়ার বাজার তেজি হওয়ার প্রধান কারণ মোদী-সরকার তৈরি হওয়ার আশা। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘বিএনপি পারিবাস’-এর কর্তা উইলিয়াম ডি ভিল্ডার মন্তব্য করেছেন, “আগামী দিনে নরেন্দ্র মোদী ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন বলে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, শেয়ার বাজারে অবশ্যই তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যদি তিনিই নির্বাচনের পরে উঠে আসেন, তা হলে প্রথম একশো দিনের মধুচন্দ্রিমার সময়কালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।” উইলিয়ামের ব্যাখ্যা, যখন শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীদের মধ্যে আশা তৈরি হয়, তখন সেই আশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণও জরুরি। ওই সব সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়াটাও দরকার। ‘আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজ’-এর রবি মুথুকৃষ্ণণের মত, স্থায়ী সরকারের আশাতেই শেয়ার বাজার চাঙ্গা হচ্ছে। একই মত ‘ডেস্টিমানি সিকিউরিটিজ’-এর প্রেসিডেন্ট সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।
চিদম্বরম অবশ্য মানতে নারাজ যে সবটাই মোদী-সরকারের আশার ফল। তাঁর বক্তব্য, “যদি কোনও আশার ওপর ভর করে শেয়ার বাজার তেজি হয়ে থাকে, তা হলসেই আশাটা হল নতুন ইউপিএ সরকার, যারা আমার বাজেটে ঘোষিত দশ দফা কর্মসূচি অনুসরণ করবে।” ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে দশ দফা কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিলেন চিদম্বরম। যাতে রাজকোষ ঘাটতিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় কমিয়ে আনা, মূল্যবৃদ্ধিকে লাগাম পরানো, পরিকাঠামো, কারখানা নির্মাণে জোর ও আর্থিক ক্ষেত্রের সংস্কারের কথা ছিল। চিদম্বরম বলেন, “আমি লগ্নিকারীদের এই প্রতিশ্রুতিটুকু দিতে পারি যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার এই দশ দফা কর্মসূচি মন দিয়ে পালন করবে।” অর্থনীতিবিদরা অবশ্য মানছেন, চিদম্বরমের চেষ্টাতেই বিদেশি লগ্নি ফিরতে শুরু করেছে। তার ফলে ডলারের জোগান বেড়েছে। বেড়েছে টাকার দাম। মূল্যবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের নীচে চলে আসায় সুদের হার কমার আশাও জেগেছে। রফতানি না বাড়লেও কমেছে আমদানি। মার্কিন সরকার আর্থিক ত্রাণ কমাতে শুরু করলেও মুম্বইয়ের শেয়ার বাজারে তার ধাক্কা লাগেনি। বিদেশি মূল্যায়নকারী সংস্থাগুলিও এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশার বাণী শোনাচ্ছে। চিদম্বরম ঠিক এই সব লক্ষ্যগুলি পূরণেরই চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু সমস্যা সেই রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই। চিদম্বরম নিজের কাজ করলেও মনমোহন সরকারের শেষ বেলায় কৃতিত্ব যাচ্ছে অন্য কারও ঝোলাতেই। যিনি আবার সরকারের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।