নেতৃত্বের ভুলেই ভরাডুবি, অবশেষে মানলেন কারাট

লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের মুখ থুবড়ে পড়ার দায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই। প্রকাশ কারাট এই প্রথম সে কথা কবুল করে নিলেন। তিন দিনের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে প্রকাশ কারাট তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। রাজনৈতিক রণকৌশলের ভুলেই একের পর এক লোকসভা নির্বাচনে সংসদে সিপিএমের শক্তি কমছে বলে মুখর হয়েছেন দলের নেতারা।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের মুখ থুবড়ে পড়ার দায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই। প্রকাশ কারাট এই প্রথম সে কথা কবুল করে নিলেন।

Advertisement

তিন দিনের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে প্রকাশ কারাট তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে। রাজনৈতিক রণকৌশলের ভুলেই একের পর এক লোকসভা নির্বাচনে সংসদে সিপিএমের শক্তি কমছে বলে মুখর হয়েছেন দলের নেতারা। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, লোকসভা নির্বাচনে দলের ভরাডুবির দায় সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এড়াতে পারেন না।

গত ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের দুর্গ পতনের দায় কার, তা নিয়ে দলে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। সে সময় রাজ্যের খারাপ ফলের দায় পুরোপুরিই রাজ্য নেতৃত্বের উপরে চাপিয়েছিলেন কারাট। বলা হয়েছিল, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভুলভ্রান্তির ফলেই পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে। এ বারের লোকসভা নির্বাচনের পর্যালোচনায় পশ্চিমবঙ্গের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা বলা হলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক কৌশলেরও যে দায় রয়েছে, তা মেনে নেওয়া হয়েছে।

Advertisement

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা এটাকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই দাবি করছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই দায় স্বীকার কার্যত কারাটের নিজের ভুল স্বীকার। সিপিএমে ব্যক্তিবিশেষকে দায় নিতে হয় না। কাজেই কারাটকেও ব্যক্তিগত ভাবে দায় নিতে হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুলের অর্থ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক লাইনের ভুল। পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহার, মায়াবতীকে সামনে রেখে তৃতীয় ফ্রন্টের সরকার গঠনের ডাক থেকে সেই ভুলের শুরু। গত পাঁচ বছরে তারই মাসুল দিতে হচ্ছে দলকে। নরেন্দ্র মোদীর উত্থান মোকাবিলারও কোনও রাস্তা খুঁজে পাননি কারাট।

লোকসভার ভোটের পর্যালোচনা করতে বসে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে বিজেপির উত্থান নিয়েই সব থেকে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ১১টি দলকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন কারাট। তাতে ছিলেন মুলায়ম সিংহ যাদব, জয়ললিতা, নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়করা। কিন্তু তাঁদের সঙ্গেই রাজ্য স্তরে জোট বা আসন সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি কারাট। ওড়িশা, বিহার, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ বা অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে ঠিকমতো আসন সমঝোতা বা জোট তৈরি করতে না পারার জন্যও কারাটকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এবং সে কারণেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায় মেনে নিয়েছেন কারাট।

বারাণসীতে মোদীর বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী দেওয়াও ঠিক হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন কারাট। তিনি নিজে সেখানে দলীয় প্রার্থী হীরালাল যাদবের হয়ে সভা করেছিলেন। এতে ধর্মনিরপেক্ষ ভোটেরই বিভাজন হয়েছে। অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে একজোট করে কোনও প্রার্থীকে সমর্থন করা উচিত ছিল বলে যুক্তি এসেছে। প্রয়োজনে আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিবালকেও সমর্থন করা যেত বলে অনেকে যুক্তি দিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায় স্বীকার করলেও, নিজে ব্যক্তিগত ভাবে দায় নিচ্ছেন না বলে অন্য কাউকেও দায় নিতে দিচ্ছেন না কারাট। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরেই দিল্লিতে পলিটব্যুরো বৈঠকে এসে পশ্চিমবঙ্গে খারাপ ফলের দায় নিতে চেয়েছিলেন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। তাঁকে সেই দায় নিতে দেওয়া হয়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকতে চান না। একই ভাবে সীতারাম ইয়েচুরিও জানিয়ে দিয়েছেন, খারাপ ফলের দায় নিয়ে তিনি পলিটব্যুরো থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি আছেন। আর এক পলিটব্যুরো সদস্য, কেরলের এম এ বেবিও রাজ্যের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। যাবতীয় পদত্যাগের প্রস্তাবই খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরো। কেন্দ্রীয় কমিটিও তাতেই সিলমোহর বসিয়েছে।

কিন্তু দলের মধ্যে যে নেতৃত্বের মুখবদলের দাবি উঠছে, তাকেও অস্বীকার করতে পারছেন না সিপিএম নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বৃদ্ধ ভি এস অচ্যুতানন্দনও আজ দাবি তোলেন, সাংগঠনিক স্তরে ব্যাপক রদবদল করে নতুন রক্তের আমদানি প্রয়োজ। কেরলের রাজ্য নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করার পাশাপাশি তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে কী ভাবে দল ঘুরে দাঁড়াবে, তা রাজ্য নেতৃত্বকেই ঠিক করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এ বার কেরলে দলের ফল ভাল হয়েছে। ২০টির মধ্যে ৮টি আসন জিতেছেন বামেরা। কিন্তু সিপিএমের আশা ছিল, ১০ থেকে ১৪টি আসন ঝুলিতে আসবে। কিন্তু কোল্লম আসনে সিপিএম পলিটব্যুরোর এম এ বেবিকে প্রার্থী করায় বাম জোট ছেড়ে কংগ্রেসের জোটে চলে যায় আরএসপি। ওই আসনে আরএসপি-র নেতা এন কে প্রেমচন্দ্রনই বেবিকে হারিয়েছেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন প্রেমচন্দ্রনকে ‘স্কাউন্ড্রেল’ বলে আক্রমণ করেছিলেন। বিজয়নের ওই মন্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেছেন অচ্যুতানন্দন।

ঠিক হয়েছে, আগামী ৮ থেকে ১০ অগস্ট পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসবে। সেখানেই নেতৃত্বের মুখবদল কী ভাবে করা যায়, তার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে। সেই অনুযায়ীই পার্টি কংগ্রেসের সম্মেলন পর্বের মাধ্যমে ধাপে ধাপে নিচু তলা থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হয়ে একেবারে এ কে গোপালন ভবন পর্যন্ত নেতৃত্বের মুখ বদলের চেষ্টা হবে। পার্টি কংগ্রেসের দিনক্ষণও ওই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই ঠিক হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement