..যে কথা হচ্ছিল আগের বার। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির জগৎ নিয়ে। আপনারা অবিশ্যি ছড়া কেটে বলতেই পারেন,
“হাতি-ঘোড়া গেল তল
ছুঁচো বলে, কতো জল?”
তা, এ ক্ষেত্রে আমার ‘ছুঁচো’ হতেও আপত্তি নেই। ঝাঁপিয়ে পড়ব জলে—যদ্দুর পারি সাঁতরে-হাতড়ে এগোবো। ডুবে গেলেও দুঃখ নেই—মহামানবকে অন্তত বুঝতে চেষ্টা তো করেছিলুম! বিধবা দিদিমার পুরীতে সমুদ্র-স্নান করতে যাবার মতোন। নুলিয়ার হাত ধরে মস্ত মস্ত ঢেউ ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলেন দিদিমা। আমায় ঝিনুক কুড়োতে বলে, ঘোষণা করলেন,
“আহা, জগন্নাথ ঠাকুরকে দর্শন করতে আইছি, সাগরে একখান্ ডুব দিয়া আসুম না!”
দু’একটা ছোট মাঝারি ঢেউ পেরোতে দেখলুম ওঁকে। হঠাৎ নেই। মাথায় ‘টোপর’ পরা সব নুলিয়াকেই দুর থেকে জলে দেখলে এক মনে হয়। আমাদের কোনটি? সাদা থান পরা দিদিমারও কোনও চিহ্ন নেই। কোথায়? কোথায়? তলিয়ে গেল নাকি? ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠছি।
তখনই প্রকাণ্ড অজগরের মতো ফণা তুলে একটা বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ল চোখের সামনে, বালিতে। সঙ্গে সঙ্গে যে দৃশ্য চোখে দেখলুম তা এক জীবনে ভোলবার নয়। দেখে, কাঁদব না হাসব, নাকি চেঁচিয়ে উঠব— বুঝতে পারলুম না।
বালির বুক থেকে ঢেউয়ের জল নেমে যাচ্ছে। জলের সীমারেখার কাছেই উপুড় হয়ে পড়েছিলেন দিদিমা। পেছনে আরও ঢেউ উঠছে। ধেয়ে আসছে এ দিকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ। নতুন নতুন এক একটি মস্ত মস্ত সাপের ফণা। বিরামবিহীন। পুরোপুরি আলুথালু থান কাপড়, কোনও রকমে দু’হাতে গোছাবার চেষ্টা করতে করতে চার হাতেপায়ে উঠে আসছেন দিদিমা। উঠতে-পড়তে, হামা দিয়ে, ছেঁচড়ে। পাগলিনীর মতোন সাদা চুল এলোপাথারি উড়ছে। প্রায় ‘পড়ি-কি-মরি’ ভঙ্গিতে উঠে আসতে আসতে ওরই মধ্যে বারবার পেছন ফিরে জোড় হাতে দ্রুত ‘পেন্নাম’ করছেন সমুদ্রকে আর অসংবৃত স্খলিত পায়ে যতটা সম্ভব ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠে আসছেন। বিড়বিড় করে কী যে বলছেন শোনা যাচ্ছে না। মহাসাগরকে চিরতরে ‘বিদায়-প্রণাম’ জানাচ্ছেন? নাকি, মনে মনে বাপান্ত করছেন।
পরে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনার শেষ দিকে বলেছিলেন, “জল তো আর কমেই না, চক্ষু জ্বালা, কিছুই দেখতে পাই না। যত উপরে ওঠার চেষ্টা করি ততই জলের মধ্যে উথালিপাথালি ডিগবাজি খাই। শ্বাস পাই না, নাকে-মুখে জল ঢুকতে আছে, বালি-লবণ।”
আমরা শুধোই, “তার পর—তার পর?”
জোরে নিশ্বাস টেনে বললেন, “পরে আবার কি? পরান যায়-যায়—তখন খাইতে আরম্ভ করলাম।”
“কী?” সমস্বরে জিগ্যেস করি। মুখ ভেংচে দিদিমার জবাব, “কী আবার? জল! হুঁশ প্রায় যায় যায় তো—ভাবলাম দুর ছাতা, দেখি খাইয়া কমানো যায় কি না?”
আলোচ্য ক্ষেত্রে অবিশ্যি ‘খেয়ে’ কমানো যাবে না। তবে, কবি ঠাকুরকে জানার চেষ্টায় তাঁর অগণন সৃষ্টির প্রাচুর্য তো বলতে গেলে সমুদ্রসমান। আপনারা একমত না হলেও, আমার অন্তত তাই মনে হয়। সেই সাগরপারি দেওয়ার চেষ্টায়, সাঁতার দিয়ে, ডুবুরির মতোই যতটুকুই যাওয়া যায় এক জীবনে, ততখানিই তো লাভ। কবি, নাট্যকার, উপন্যাস-রচয়িতা, ছোট গল্পকার, সঙ্গীতের সুরশ্রষ্টা, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ বা শিক্ষাসংস্কারক, প্রবন্ধকার এবং শিল্পী। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিগ্রির মানপত্রে লেখা কথা ক’টি অক্ষরে খাঁটি : “যে বিষয়েই উনি হাত রেখেছেন, তাকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন।”
তা, সেই বালাই ষাট পেরোনো পরিপূর্ণ বয়েসে তো তাঁর ছবি আঁকা আরম্ভ হল। নানাবিধ সৃষ্টির মধ্যে, লেখা কাটা-ছেঁড়ার পর, লেখা-পৃষ্ঠাকে নয়ননন্দন করার জন্য যে সব ফুল-পাতা, আলপনার ডিজাইন, সব লেখার অলংকরণ হয়ে উঠতে লাগল—কালক্রমে সেখান থেকেই শিল্পী রবীন্দ্রনাথের নবরূপে প্রকাশ।
১৯২৪ সালে ছবি আঁকা শুরু করে পাঁচ ছয় বছরের মধ্যেই প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন, মস্কো এবং নিউইয়র্কে একক প্রদর্শনী করে ফেললেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন কোনও শিল্পীর নাম খুঁজে পাবেন না যিনি ছবি আঁকা শুরুর বছর পাঁচ ছয়ের মধ্যেই বিশ্বময় প্রদর্শনী করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। ওপরে উল্লিখিত যে কোনও একটি শহরে প্রদর্শনী করবার সুযোগ পেলে যে কোনও নব্য-শিল্পী বর্তে যাবেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এমনটি সম্ভব হয়েছিল, কারণ কবি-লেখক হিসেবে তত দিনে তিনি রীতিমতন বিশ্ববিখ্যাত। সেই থেকেই বিশ্ববাসী গুরুদেবকে একজন বেশ গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক, ভিন্ন ধারার চিত্রশিল্পী হিসেবে আবিষ্কার করল।
প্রথাগত চিত্রাঙ্কন শিক্ষার অভাব রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল একটি অন্য ধরনের বিশেষ সুবিধায়। ‘রেখাঙ্কন’ এবং রঙের সংযত ব্যবহারে তিনি নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন। লেখার মতনই কবি ঠাকুরের চিত্রসৃষ্টির পরিমাণও বিশাল। মাত্র এক দশকে তাঁর চিত্রসংখ্যা আড়াই হাজার অতিক্রম করে যায়। তাঁর আঁকার দেড় হাজারের কিছু বেশি ছবি রয়েছে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনে ও কলাভবনে।
কবি ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ কবিতা ও গানের মাধ্যমে যা প্রকাশ করেছেন, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ রেখা ও রঙে, দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে, তা ছাড়াও অন্য কিছু বলতে চেয়েছেন। অতি নগণ্য আপন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত বোধ থেকেই বলার দুঃসাহস প্রকাশ করছি, যে কথা, যে ভাবনা, অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে প্রকাশ করার প্রয়াস পাওয়া যায়, তার থেকে অন্য কোনও ভাবনা, ভিন্ন কিছু কথা, যা কিনা শব্দ, অক্ষর বা ধ্বনির মাধ্যমে ব্যক্ত করা বা বোঝানো যায় না— সেখানেই ছবি বা দৃশ্যকল্প বা রেখাংকনের মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা বা সার্থকতা।
বিশ্বকবির কবিতা ও গান যদি আলো ও শান্তির সন্ধান করে থাকে, তাহলে, তাঁর ছবি হয়তো প্রায়ই এক অন্ধকার রহস্যময় জগতের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যত দিন যাচ্ছে, শিল্প-রসিক সমালোচকরা এই সব ‘রেখার কবিতা’র মধ্যে একেবারে অন্য এক আধুনিক এবং অশান্ত, অতৃপ্ত রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাচ্ছেন—যাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি এবং যায় না।
তবে, এই সব ছবির বিষয়ে কিছু উন্নাসিক বোদ্ধা আছেন—তাঁদের বক্তব্য আবার কিঞ্চিৎ লবণ তথা নিমপাতার (রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ভোরবেলার সুবৃহৎ সবুজ শরবতের গেলাসটি মনে পড়ে) রসাসক্ত। ঠোঁট বেঁকিয়ে তাঁরা বলেন, “আহা”! ওঁর তো কোনও দোষ নেই। আসলে বেসিক ড্রয়িং বা অ্যানাটমি তো শেখেননি কিনা! অনেকটা সেই ব্যাকরণের ‘ব্যা’-টুকুও না শিখে গদ্য-পদ্য-টদ্য-গদ্য লিখতে গেলে যেমন হয়, তেমনই কাঁচা হাতের কাজ! তবে, রেখার টানে ডিজাইন-টিজাইন-আলপনা-টাইপ কাজ খারাপ নয়। আর, রঙের ব্যবহার দেখলে মনে হয় উনি হয়তো বর্ণান্ধ বা রং-কানা অর্থাৎ ‘কালার ব্লাইন্ড’ ছিলেন। যার ফলে, বেশির ভাগই ওই লালচে, কমলা, গেরুয়া বা গাঢ় রং দিয়ে লেবড়ে ফেলতেন। ফলে, মনে পড়ে যায়, সেই ছোট্ট বেলার ছড়া—
“খুকুমণি! খুকুমণি! করছো তুমি কি? এই দ্যাখো না কেমন আমি ছবি এঁকেছি!”
আমরা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভক্তরা, বলতে পারি, জীবন’ভর ঈর্ষাপরায়ণ নিন্দুকদের কথায় কান দিলে— এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হতেন না ! তাঁকে সহস্র প্রণাম।