লক্ষ্য সংসদ। পোস্টারেও সে বার্তাই দিচ্ছেন জয়ললিতা। চেন্নাইয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
তামিলদের প্রাচীন প্রবাদ, ‘যে তোমাকে অন্ন জুগিয়েছে, তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থেকো।’
আম্মা শুধু খাওয়াচ্ছেন না। জল তেষ্টা মেটাচ্ছেন। এমনকী সস্তায় সিনেমা দেখানোরও ব্যবস্থা করছেন!
আম্মা কি মনের কথা পড়তে পারেন? তামিলনাড়ুর ‘আম্মা উনাভগম’ বা আম্মা ক্যান্টিনে ঢুকলে তেমনটাই মনে হয়। সকালে এক টাকা করে ইডলি-সম্বর, দুপুরে ভাতের সঙ্গে দই, সম্বর বা সবজি পাঁচ টাকা, রাতে তিন টাকায় ডাল-রুটি। কোথায় এমন সস্তায় পুষ্টিকর খাবার পাওয়া হয়, তা খুঁজতেও হবে না। মোবাইলে নির্দিষ্ট নম্বরে এসএমএস পাঠালেই সব থেকে কাছের আম্মা ক্যান্টিনের ঠিকানা চলে আসবে। চেন্নাইয়ের বহু এলাকায় জলের অভাব। রাস্তার ধারে লাল-নীল-হলুদ-কমলা রঙের ফাইবারের কলসির লম্বা লাইন। কিন্তু পকেটে দশ টাকা থাকলেই মিলবে ‘আম্মা কুডিনীড়’। আম্মার ছবিতে মোড়া জলের বোতল। গরিবদের জন্য মাসে ২০ কেজি বিনা মূল্যের চাল, ফ্যান, পড়ুয়াদের জন্য সাইকেল সবই আম্মার উপহার। চেন্নাইয়ের গাঁধীনগরে আম্মা ক্যান্টিনে পাঁচ টাকায় এক থালা পোঙ্গল সাবাড় করতে করতে বছর তিরিশের কার্তিক মারিয়প্পনের জবাব, “উনি সকলের মা। সকলের চাহিদাই বোঝেন।”
আম্মা অবশ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। বিরাট বুলেটপ্রুফ ভ্যানে চেপে প্রচারে বেরোন। ভ্যান থেকেই মুখ বের করে বক্তৃতা করেন। তাঁর পোয়েজ গার্ডেনের বাংলোর ত্রিসীমানায় যাওয়া মুশকিল। মাঝেমধ্যেই উটির কাছে কোডানাড়ুর বিরাট এস্টেটে চলে যান। শরীর সুস্থ রাখতে সেখানেই না কি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করান। শরীর সুস্থ রাখতে হবে তো। আম্মা যে নিজের জন্য বড় লক্ষ্য স্থির করেছেন।
কী সেই লক্ষ্য, বুঝতে মাথা ঘামাতে হয় না। তামিলনাড়ু জুড়ে এডিএমকে-র হোর্ডিংয়ে যেখানেই জয়ললিতার মুখ, সেখানেই পিছনে দিল্লির সংসদ ভবনের ছবি। এডিএমকে-র লোকসভা ভোটের ইস্তাহারেও সেই একই ছবি। মোট ৪৩ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ১১টা তামিলনাড়ুর জন্য। বাকি ৩২টা গোটা দেশের জন্য। জয়ললিতা বলছেন, “ভারতের পুনরুত্থানের জন্য আমার নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা তৈরি রয়েছে। ওটাই আমার ভিশন-২০২৩।” চেন্নাইয়ের আশেপাশে দু’একটা হোর্ডিং দেখে মনে হয় ঠিক দেখছি তো? জয়ললিতার সামনে বারাক ওবামা থেকে শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে তাবড় রাষ্ট্রনায়করা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে! হোর্ডিংয়ে ঘোষণা, ‘জয়ললিতা তামিলনাড়ুর চিরস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ কথাটা বলতেই হেসে উঠলেন ডিএমকে-র সাংসদ টি কে এস এলঙ্গোভান, “প্রধানমন্ত্রী হতে তো ২৭২ জন সাংসদ দরকার। তামিলনাড়ুতে তো আসনই ৪০টা!” বাংলা কাগজের সাংবাদিক বলেই কি না জানি না, এর পরেই কটাক্ষের সুরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “ওঁকে প্রধানমন্ত্রী করছেন কে? আপনাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?”
এলঙ্গোভান যা-ই বলুন, জয়ললিতা কিন্তু স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তামিল প্রধানমন্ত্রীর। প্রশ্ন তুলছেন, তামিল মৎস্যজীবীদের শ্রীলঙ্কার সেনা ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে কেন? প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কেন রাজাপক্ষেকে কড়া জবাব দেন না? চিরকাল এলটিটিই-র কঠোর সমালোচক জয়ললিতা কিন্তু তামিল আবেগের অঙ্ক মাথায় রেখেই ভোটের ঠিক আগে রাজীব গাঁধীর হত্যাকাণ্ডে সাত জন অপরাধীকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। করুণানিধি নিজেই দলীয় মুখপত্রে এই দাবি তুলে তামিল ভাবাবেগ নিজের দিকে টানতে চাইছিলেন। কিন্তু জয়ললিতা যে তাঁর দেখানো পথ ধরেই বাজিমাত করে বেরিয়ে যাবেন, টেরও পাননি ‘কলাইনার’! টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি নিয়ে করুণানিধি আর তাঁর দলের মন্ত্রীদের রোজ আক্রমণ করছেন আম্মা। বলছেন, দয়ানিধি মারান স্পেকট্রাম দুর্নীতির ভিত তৈরি করেছিলেন। এ রাজা সেই ভিতেই দুর্নীতির প্রাসাদ গড়েছেন। দয়ানিধির নিজের সংসদীয় এলাকা, মধ্য চেন্নাইয়ে প্রচারে গিয়ে আমজনতাকে বলছেন, “দয়ানিধিকে দেখলেই তাড়া করে চাবুক পেটা করুন!”
এডিএমকে নেতারা বুক বাজিয়ে বলছেন, এ বার ৪০টা আসনের মধ্যে ৪০টাই পাব। কিন্তু জয়ললিতা জানেন, অঙ্ক এতটা সোজা নয়। ডিএমকে মুসলমান, সংখ্যালঘু দলগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধেছে। অন্য দিকে বিজেপি-র সঙ্গে এস রামডসের পিএমকে, ক্যাপ্টেন বিজয়কান্তের ডিএমডিকে, ভাইকো-র এমডিএমকে-র রামধনু জোট। আঞ্চলিক দলগুলোর নিজস্ব ভোট কোথায়, জয়ললিতার জানা। কিন্তু বিজেপি কোন দিকের ভোট কাটবে, কেউ জানে না।
এখানেই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তামিলনাড়ুর মিল। জয়ললিতা আশা করছেন, বিজেপি-র ভোট বাড়লে বিরোধী ভোট টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাঁরই সুবিধা। ডিএমকে ভাবছে, শাসক দল এডিএমকে-রই ভোট কাটবে বিজেপি। জয়ললিতার নিজেরও সেই আশঙ্কা রয়েছে। তামিলনাড়ুতে মোদী ঝড় আটকাতে তিনি গুজরাতের সঙ্গে নিজের রাজ্যের উন্নয়নের বিচার করে দেখাচ্ছেন, এগিয়ে তামিলনাড়ুই। কিন্তু মোদী-চিন্তা তাড়াতে পারছেন কই! মোদীর প্রচারে তাঁর বক্তৃতা তামিলে অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের সংখ্যালঘু সেলের নেত্রী মুনাভরি বেগমকে। তার পাশাপাশিই মোদীও কখনও মেগাস্টার রজনীকান্ত, কখনও তামিল সিনেমার এখনকার হার্টথ্রব বিজয়ের সঙ্গে হাত মেলাতে ছুটছেন। তামিল জনতা যে ইডলি-ধোসার সঙ্গে সিনেমাটাও গোগ্রাসে গেলে, আর রূপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকাদের ভগবানের আসনে বসিয়ে পুজো করে, সেটা মোটেই অজানা নয় মোদীর।
তাঁর বহু হিট সিনেমার নায়ক এম জি রামচন্দ্রনের হাত ধরে যিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন, সেই জয়ললিতারও কি জানা নেই অঙ্কটা? যিনি সব বোঝেন, তিনি এটুকু বুঝবেন না? ভোটের ঠিক আগেই তাই নতুন চমক। আসিতেছে! আসিতেছে! আম্মা ক্যান্টিন, আম্মা মিনারেল ওয়াটারের পর আম্মা সিনেমা হল! মাল্টিপ্লেক্সের দশ ভাগের এক ভাগ খরচায় সিনেমা দেখার বন্দোবস্ত। রজনীকান্ত, কমল হাসন, বিজয় কিংবা শাহরুখ খান, আম্মার দাক্ষিণ্যে মাত্র ২৫ টাকাতেই লুঙ্গি ডান্স, লুঙ্গি ডান্স, লুঙ্গি ডান্স...।