মালিক
রোহিত বড়াপাও, রোহিত নমকিন ভাণ্ডার, রোহিত জ্যুস সেন্টার, রোহিত পান মন্দির, পাশাপাশি এই সব দোকান দেখে স্বাভাবিক ভাবে যে প্রশ্ন মাথায় আসা উচিত, আমারও তাই এল। এই রোহিতবাবু লোকটি আসলে কে ছিলেন? নিঃসন্দেহে খুব বড় ভোজনরসিক, নইলে বাজারের মুখেই গমগমে এই রকম দোকান তাঁর নামে সমর্পিত কেন? আশ্চর্য, এই শহরে থেকেও এই রকম একটি মানুষের নাম শুনিনি! নিজের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মায় আমার।
আচ্ছা, ওঁর পুরো নাম কী ছিল? রোহিত দত্ত, রোহিত মুখোপাধ্যায়, রোহিত চৌহান নাকি রোহিত পণ্ডা? ভোজনরসিক যখন, চেহারাও নিশ্চয়ই বেশ গোলগাল ছিল। ফর্সা রং, মুখে অমায়িক হাসি। এই রকম চেহারার সঙ্গে ঢিলেঢালা পাজামা আর প্রিন্টের পাঞ্জাবিই মানায় ভাল।
চাকরি মানে তো অন্যের তাঁবেদারি। এই রকম একজন সুখী মানুষ চাকরি করবেন কোন দুঃখে? বরং অন্য পাঁচপাঁচি লোকেরা সব অফিসটফিস চলে গেলে এগারোটা, সাড়ে এগারোটার সময় চপ্পল পায়ে আরাম করে বাড়ি থেকে বের হতেন নিশ্চয়ই। আচ্ছা প্রথমেই কি উনি খানিকটা জ্যুস খেয়ে নিতেন অ্যাপেটাইজার হিসেবে? নানা রকম জ্যুস পাওয়া যাচ্ছে দোকানে। আঙুর থেকে কমলালেবু, আনারস, লেখা আছে গরমে আম। সঙ্গে স্টার্টারের মতো কিছুটা নমকিন? হতেই পারে। নানা রকম চানাচুর, মুঁগফলি, ব্যসনে ডুবিয়ে ভাজা মঁুগফলি পাওয়া যাচ্ছে। এক এক দিন একটা খেতেন হয়তো। কিংবা কয়েকটা চেখে দেখতেন।
ইতিমধ্যে ওঁর বন্ধুরা সব জুটতেন একে একে। কী রে তুই কী খাবি? তুই? তোর আবার কী হল? এই সব সেরে বড়া পাওয়ের দোকানের সামনের টেবিল আলো করে গোল হয়ে বসতেন সকলে। কেউ বড়া পাও, কেউ দভেলি, কেউ পাওভাজি। সেই সঙ্গে মার-মার আড্ডা চলত ঘণ্টা দুয়েক। তার পর পান মন্দিরের দিকটায় সরে আসতেন সকলে। কেউ জর্দা, কেউ কিমাম, কেউ মিঠা। কেই আবার পান খেয়ে সিগারেট ধরাতেন। কেন জানি না আমার মনে হল, রোহিতবাবু নিজে প্রথমে পানের রসে গলা ভিজিয়ে তার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে হু হু করে টান দিতেন। দেখতে দেখতে এবং ভাবতে ভাবতে কৌতূহল ঘন হয়ে আসায় আমি পানের দোকানের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এই রোহিতবাবু কে ছিলেন?
লোকটি কানে শুনতে পেলেও কথা বলতে পারে না বোধহয়। আমার প্রশ্ন শুনে নির্বাক চোখ দুটি আমার দিকে তুলে নমস্কার করল শুধু। আরে, রোহিতবাবু লোকটি দেখা যাচ্ছে শুধু ভোজনরসিকই নয়, অত্যন্ত দয়ালুও ছিলেন। বোবা লোকদের জন্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন। আমার মনে রোহিতবাবু সম্বন্ধে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। আমি জ্যুস সেন্টারের কাছে গিয়ে বললাম, আচ্ছা এই রোহিতবাবু কে ছিলেন বলতে পারবেন?
ছিলেন কী মশাই, লোকটি প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বলল, আছেন।
ওহ, সরি, তা উনি কে?
আমাকে আপাদমস্তক দেখে লোকটি বলল, এ পাড়ায় নতুন এসেছেন? যাক সময় হয়ে এসেছে, আর একটু দাঁড়ালেই বুঝতে পারবেন। বলতে বলতে রাস্তার একটি বিশেষ জায়গার দিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। সে দিক তাকিয়ে দেখি ঢাউস একটা গাড়ি থেকে নেমে ভীষণ সাজগোজ করা এক ভদ্রমহিলা এ দিকেই আসছেন। সঙ্গে লালফিতে বাঁধা কুচকুচে কালো একটি পমেরিয়ান কুকুর।
আমি অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী, ওই ভদ্রমহিলার নাম রোহিত?
আঃ! ভদ্রমহিলার কথা উঠছে কেন? এই সব প্রপার্টি হচ্ছে ওই লাল ফিতে বাঁধা ইয়ে মানে—
মানে ওই কুকুরটির না—
আস্তে! ও দিক থেকে চোখ না সরিয়ে লোকটি বলল, বুঝেছেন ঠিকই, তবে গলার স্বর এ সব ক্ষেত্রে আরও নীচে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
সময়
ঘি রং-এর গোল গোল গায়ে একটু কালচে ছোপ ধরা বাদামগুলোর স্বাদ বেশি। গোটা কয়েক মুখে ফেলে চেবাতে চেবাতে অপু বলল, ঝাল-নুন কী করে বানায় রে দিদি?
এ বিষয়ে দুর্গার জ্ঞানও সীমিত। কিন্তু সে কথা ছোট ভাইয়ের কাছে স্বীকার করা চলে না। কাজেই বিজ্ঞের মতো বলল, কেন, নুন, বিটনুন আর গোলমরিচ গুঁড়ো মিশিয়ে!
যাঃ এই রকম হয়?
কেন হবে না, সেই যে আমি এক বার বানিয়েছিলাম, মনে নেই?
মাথা নেড়ে অপু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। সেই যে মা তোকে খুব বকেছিল।
ঝাল-নুন বানানোর জন্যে মোটেই বকেনি। আমার হাত থেকে অনেকখানি নুন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সাত দিন জ্বরে ভুগে গতকাল পথ্য করেছে অপু। এখন ওর জন্যে বাদাম ভাজা কিংবা ঝাল-নুন বিষ। দুর্গা স্কুল থেকে ফেরার পর, মা পাশের বাড়ি গেছে ওদের মেয়ের বিয়ের তত্ত্ব দেখতে। সেই সুযোগে বাদাম ভাজার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে অপু। খোসা ছাড়িয়ে আরও কয়েকটা বাদাম মুখে ফেলে অপু বলল, পিন্টুও বাদাম ভাজা খেতে খুব ভালবাসে জানিস।
হ্যাঁ, আজ তো ওর দিদি কিনল দেখলাম, এক টাকার বাদামভাজা।
এক টাকার! আর ঝাল-নুন কত টাকার?
ভাইয়ের অজ্ঞতায় দুর্গা হাসে। ঝাল-নুন কিনতে হয় না বোকা, বাদাম কিনলে ঝাল-নুন এমনিই দেয়।
এমনিই! চার আনার কিনলেও? অপু অবাক।
হ্যাঁ, চার আনার কিনলেও।
দিদি, কাল স্কুল থেকে ফেরার সময় আবার আনবি?
কাল-ই?
ইংরিজি বইয়ের পিছনে আলমারির গোপন অন্ধকারে দুটো সিকি আছে। আরও দুটো হলে, সোমবারই মেলা থেকে প্লাস্টিকের ‘প্রজাপতি উড়ছে’ চুলের ক্লিপ কেনার সাধ দুর্গার বহুকালের। একটা সিকি গেলে, সেই ক্লিপের প্রতীক্ষা দীর্ঘতর হবে। মাথার চুল তো আর ছোট হয়ে যাচ্ছে না, আর প্রজাপতি হলেও ক্লিপ উড়ে পালিয়ে যাবে না। বরং জ্বরে ভোগা রোগা বোকা ভাইটা দুম করে একদিন বড় হয়ে যাবে। তখন আর বাদামভাজা খেতে চাইবে না। সময়ের এই জটিল অঙ্ক কষে উঠে দাঁড়ায় দুর্গা। অপুর নাক টিপে দিয়ে বলে, মা ফিরে আসার আগে তাড়াতাড়ি শেষ করেনে। কালকেরটা কাল ভাবিস।
পৃথক
সেই একই রকম, হাল্কা রং-এর ফুলহাতা শার্ট, সেই কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। সামনের চুল পাতলা হয়েছে কি? আধা অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না।
জয়ন্তী না? রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে, উল্টো দিকে হন হন করে হেঁটে গেলেন যিনি, জয়ন্তীই। ও এখনও এখানেই আছে? অবশ্য ও তো চিরদিনই ট্রান্সফারের ব্যাপারে বেশ জোগাড়যন্ত্র করে নেয়।
ইটের মতো ভাবলেশহীন উদাস মুখ, সামনে চোখ। কী দেখল, কী দেখল না, বোঝা যায় না কোনও দিনই।
বেশ মোটা হয়ে গেছে জয়ন্তী। লাল-হলুদ-কমলাটমলা একটা জংলা প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ। ওই দোষ, নিজের বয়েসের সমবয়েসি থাকতে চায় না কিছুতেই।
অংশুমানের চাকরি আরও প্রায় দেড় বছর আছে। তার মানে এটাই ওর লাস্ট পোস্টিং। কোথায় সেটল করবে কে জানে। ফ্ল্যাটট্যাট কিছু বুক করেছে কি? মনে হয় না। যা ইমপ্র্যাক্টিক্যাল লোক!
কেমন আছে জয়ন্তী? শুভ্র তো ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পর ইউকে গেছে ম্যানেজমেন্ট করতে। অফিসের মেল আই ডি-তে মেল করে জানিয়েছে। সেই মেল আই ডি পেয়েছে অফিসের ওয়েবসাইটে। প্রফেশনাল মেল। বাবার সম্বন্ধে শুকনো জিজ্ঞাসা আছে। মার কোনও খবর নেই।
শুভ্রকে অন্তত পাঁচ বার বলা হয়েছিল মেল করতে। করেছে কিনা কে জানে! যেমন বাপ তার তেমনই ছেলে। কী ভাবে, কী করে বোঝার উপায় নেই। হোপলেসলি ইনট্রোভার্ট!
তাও ভাল, ছেলেটা হয়তো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ওকে নিয়েই তো ছিল যত দুশ্চিন্তা। অফিস ট্যুর, কলিগ, ক্লাব, পার্টি সামলে জয়ন্তী এক মিনিট সময় দিতে পারত না ছেলের জন্যে।
মেল করুক-না করুক, অংশুমানের আর কী! দিব্যি তো ছেলে মানুষ করার দায়িত্ব জয়ন্তীর ঘাড়ে চাপিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। দেখুন অংশুমান, জয়ন্তী পেরেছে কি না। এই ছেলে মানুষ করা নিয়েই শেষ পর্যন্ত সম্পর্কে ফাটল দেখা গেল। এ ওর খঁুত ধরা, সে তার ভুল খোঁজা। বেসুরে বাঁধা তারের কর্কশ ঝালা বেজেছিল কিছু দিন। তার পর, যা হয়, ফাটল বড় হতে হতে একদিন দেওয়াল ধসে পড়ল, আর গাঁথা হল না। হুঃ, দুশ্চিন্তা শুধু করলেই হয় না, দুশ্চিন্তা যে সমস্যা থেকে আসছে, সেটার সমাধান করতে হয়। পালিয়ে গেলে চলে না। যাক, যে যেমন।
মাঝে মাঝে মনে হয় এ সবই আসলে উপলক্ষ মাত্র। দশ বছরের তৈরি দেওয়াল আসলে মজবুত ছিল না তেমন। যাক এত দিন পর এ সব ভেবেই বা কী লাভ।
তা, অংশুমান কি এখন থেকে রোজ সন্ধেবেলায় এখানে হাঁটতে আসবে নাকি? তা হলে জয়ন্তীকে সকালে আসতে হয়। দূর, এটা মোটেই ভাল হল না। এখানে আসা হয়ে গেল চার পাঁচ দিন, হাঁটতে বেরোনো আজই প্রথম। প্রথম দিনেই জয়ন্তীর সঙ্গে দেখা। শহরে হাঁটার জায়গা কি একটা। কাল থেকে অন্য কোথাও যেতে হবে।
একটা সময় ছিল, তখন একে অন্যের থেকে দূরে থাকার কষ্টকর প্রচেষ্টায় নিরত এই দুটি মানুষের জীবন ছিল একেবারেই অন্য রকম। তখন আকাশে চাঁদ তারা ছিল, গাছের পাতায় শিরশিরে বাতাস ছিল। বলার ও শোনার মতো অনেক কথা ছিল। সন্ধেবেলায় এই রাস্তাটায় এক ঘণ্টা হাঁটা ছিল প্রাত্যহিক। বৃষ্টির দিনে কখনও একই ছাতার নীচে। তখনও আড়ি তাদের দু’জনকে দুটি পৃথক গ্রহের প্রাণী করে দেয়নি।