কাজকে ভালবাসতে হবে। চেনা ছকের বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা প্রয়োজন।
নিজেদের জীবনের গল্প বলে এই কথাগুলোই বোঝাচ্ছেন চেতন ভগত। যিনি বিদেশি ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে উপন্যাস লিখে চূড়ান্ত সফল।
‘ইউ ক্যান উইন’-এর লেখক শিব খেরা আবার বলছেন, ইতিবাচক মনোভাব চাই। তা হলেই সাফল্য মিলবে। একের পর এক সফল পেশাদারদের উদাহরণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি।
শ্রোতাদের আসনে কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কর্পোরেট জগতের পন্থা বেছে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রীরা আমলাদের ‘ভোকাল টনিক’ দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। গত সোমবার বিদ্যুৎ মন্ত্রী পীযূষ গয়াল তাঁর মন্ত্রকে চেতন ভগতকে নিয়ে এসেছিলেন। শুক্রবার পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের আহ্বানে শিব খেরা হাজির হয়েছিলেন পরিবেশ মন্ত্রকে। সেখানে আন্ডার সেক্রেটারি থেকে শুরু করে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত সমস্ত আমলার সামনে বক্তব্য রাখেন তিনি।
কর্পোরেট জগতে এমনটা আকছার দেখা যায়। এমনকী ক্রিকেট বা ফুটবলেও খেলোয়াড়দের মনোবল বাড়াতেও এই ধরনের বক্তাদের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি স্তরে এত দিন এমন উদ্যোগের দেখা মেলেনি। কেন্দ্রের এক মন্ত্রীর বক্তব্য, “এই সবই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পরিকল্পনা। প্রথম দিনেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি আমলাদের চাঙ্গা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মনমোহন জমানায় আমলারা সিদ্ধান্ত নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ উঠেছিল। সরকারি কাজে গতি এনে সেই হাল শোধরাতে চাইছেন মোদী।”
মোদীর মতে, আমলাদের রদবদল করে পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয়। মন্ত্রিসভার সদস্যদের সামনে গুজরাতের উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, আগে সেখানেও সমস্যা ছিল। আমলাদের অনেকেই কাজ করতেন না, নতুন চিন্তাভাবনা করতেন না। এখন সেই গুজরাতেই কর্পোরেট জগতের মতো মসৃণ গতিতে কাজ হচ্ছে। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই ভাবেই তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকেও সেটাই করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবদের সঙ্গে বৈঠকের সময় মোদী বলেছেন, নির্ভয়ে কাজ করুন। কোনও সমস্যা হলে তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করারও নির্দেশ দেন তিনি। পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেন, “কাজে গতি আসলে সরকারি পরিষেবা নিয়ে মানুষের অভাব-অভিযোগও থাকবে না। তার জন্য আমলাদের আবেগ, বিশ্বাস এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।”
কাজের ক্ষেত্রে এই আবেগ আর ইতিবাচক মনোভাব ফিরিয়ে আনতেই মোদী সরকার চেতন ভগত, শিব খেরার মতো বক্তাদের সাহায্য নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। নতুন সরকার কর্পোরেট জগৎকে অনুকরণ করছে দেখে খুশি শিল্পমহলও। জে কে গোষ্ঠীর কর্ণধার, শিল্পপতি হর্ষপতি সিঙ্ঘানিয়া বলেন, “এটা ইতিবাচক মনোভাব কারণ সময়ে সময়ে আমাদের সকলের মস্তিষ্কেই নতুন প্রাণ সঞ্চারের প্রয়োজন হয়। কর্পোরেট জগতে নিয়মিত ভাবে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সব সময়ই এতে নতুন চিন্তাভাবনা আসে, আরও দক্ষতা বাড়ে।”
চিরাচরিত পাঁচ দিনের কাজ, দু’দিনের ছু’টির নিয়মও বদলাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। এখন সপ্তাহে পাঁচ দিন সরকারি দফতর খোলা থাকে। অফিসাররা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন। শনি-রবিবার ছুটি থাকে। এ বার সপ্তাহে ছ’দিন সরকারি দফতর খোলা রাখা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। অথবা এক সপ্তাহ অন্তর শনিবার কাজের দিন হিসেবে নির্ধারিত রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে। বেশি কাজ, বেশি সময় অফিসে থাকার বিষয়েও আমলাদের উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে মোদী সরকার।
প্রশ্ন উঠেছে, কর্পোরেট জগতের সঙ্গে সরকারি কাজের ধরনধারণ সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারি কাজের সঙ্গে বহু নীতিগত ও রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িত থাকে। সেখানে এই উদ্যোগে কতখানি লাভ মিলবে? মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কোনও শিল্পসংস্থার সিইও-র থেকে সরকারি সচিবরা মেধা বা পড়াশোনাতে কোনও ভাবেই পিছিয়ে নন। কাজেই এতে লাভ না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ বীর্যেন্দু গুপ্তের মন্তব্য, “সরকারি আমলাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য যাঁদের ডাকা হচ্ছে তাঁদের যদি সরকারি কাজকর্মের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকে, আমলাদের সীমাবদ্ধতা জানা থাকে, তা হলে সেই অনুযায়ীই তাঁরা গল্প বলে উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন।” এই প্রচেষ্টা যে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য, তা-ও মানছেন বীর্যেন্দু।
মোদী চাইছেন, আমলারা সিংহভাগ সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিন। তার জন্য মন্ত্রীদের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই। মন্ত্রিসভায় নীতি তৈরি হবে। সেই নীতি কার্যকর করবেন আমলারা। খুবই স্পর্শকাতর বিষয় বা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
লোকসভার নতুন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনও জানিয়েছেন, তিনিও সংসদের কাজে গতি আনতে নতুন চিন্তাভাবনা করছেন।