দুটো-দশটার শিফ্ট। রাত ন’টার মধ্যেই হৃষীদা প্যাক আপ করে দিলেন। সেটের মধ্যে, শ্যুটিঙের সময় তেমন টের পাইনি। দু’নম্বর স্টুডিও থেকে বেরোতেই দেখি, ফিসফিস শব্দে বৃষ্টি পড়ছে। ছেলেবেলায় কয়েকটি ছাতা হারাবার ফলে গুরুজনের হাতে তাঁর বা তাঁদের নিজস্ব ছাতার বাড়ি খেয়েও আবার ওই বস্তুই ফের হারাবার ফলে, ছাতা আর রাখি না সঙ্গে। অন্য ছত্রধারীর সঙ্গে মাথা বাঁচিয়ে চলি। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। স্টুডিও থেকে যে ছাতা নিয়ে বেরোচ্ছে, তাঁর সঙ্গে জুটে, তাঁরই কাঁধে হাত রেখে বললুম, “ব্যস! ও হি ক্যান্টিনমে ছোড় দিজিয়ে....গেটকে পাস।”
আসলে দুপুর থেকে সারাদিন— এই সন্ধে অবধি ক্যান্টিনের ছেলেদের কোনও পাত্তা নেই। চা-জলখাবার দিতে একবারও আসতে দেখিনি। তাই, নারানের কী হল জানতে একবার ভাবলুম ক্যান্টিনে ঢুঁ মারি। গতকাল ‘লুকিয়ে কাঁদছিলে কেন? কী হয়েছে’ জানতে চেয়েছিলুম। অত হাসিখুশি কিশোর বা প্রাণবন্ত যুবককে আড়ালে কাঁদতে দেখলে মন খারাপ হতেই পারে। কোনও রকমে এড়িয়ে গেছে নারান। দ্রুত সরে যেতে যেতে বলে গিয়েছিল, “উও কুছু না, শেঠজি।”
খুব বড়সড় ক্যান্টিন নয়। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে ডান দিকে। দু’তিনটে ধাপ ছোট সিঁড়ি। কোমর অবধি দেওয়াল পেরোলে মোটামুটি খানিকটা বসার জায়গা। দু’তিনটে টেবিল। তাদের ঘিরে টিনের চেয়ার। দুটো লম্বা টেবিলের দু’পাশে লম্বা বেঞ্চি। বেশ চওড়া। বসাও যায়, শোয়াও। একমাত্র দু’নম্বরে শ্যুটিং ছিল। এক আর তিন নম্বরে কোনও শ্যুটিং না থাকায় ক্যান্টিন প্রায় ছুটির মেজাজে।
জোরালো আলো সব নেভানো। শুধু ক্যাশ কাউন্টারের বাতিটি জ্বলছে। নারানের মামাজি জয় বাহাদুর বোধহয় হিসেবনিকেশ নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে খেয়াল করেনি। ডাকলুম, “বাহাদুরজি?”
চোখ না তুলেই বললে, “বন্ধ হো গিয়া ভাই।” বলতে বলতে মুখ তুলে আমাকে দেখেই আপ্যায়নের গলায় বললে, “আইয়ে শেঠজি।”
এগিয়ে ওর কাউন্টারের কাছের টেবিলটায় বসলুম। জিজ্ঞেস করলুম “সারাদিন নারানকে সেটে একবারও আসতে দেখিনি কিনা! তাই ভাবলুম খবর নিই একটু।”
বাহাদুরও উঠে এসে মুখোমুখি বসল।— “কাল থেকে জ্বরে পড়েছে” বলে ক্যান্টিন-লাগোয়া ওদের আবাস দেখাল।
বললে, “সকালে ওষুধ পড়েছে ডাক্তারের। শুয়ে আছে। ডাকব?”
“না না। এমনিতেই খবর নিচ্ছিলুম।”
“বিকেল থেকে জ্বর একটু কমেছে। কাল সারারাত্তির ঘুমোয়নি। জ্বরের ঘোরে ভুল বকেছে।”
ওর লুকিয়ে কান্নার কথা বলব কি বলব না— ঠাহর পাচ্ছিলুম না। অথচ নারানের মামা ছাড়া এখানে আর কেউ আছে বলে তো জানা নেই। মামা নিজে থেকেই বললে, “ক’দিন ধরেই নারানের মন ভাল নেই।”
ভরসা পেয়ে বলেই ফেললুম, “কাল সেটের অন্ধকারে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কেন? কী হয়েছে বলতে পারেন? অত হাসিখুশি ছেলে ....”
“কী করব বলুন শেঠজি। চতুর্দিক থেকে নানা রকম খবর আসছে।”
“কীসের খবর?”
“আমাদের ওদিককার পাহাড়ের গ্রামগঞ্জ, মানুষজন, সব কিছু মন্দাকিনীর ভয়ংকর বন্যায় ভেসে গেছে।”
কোনও রকমেই ঘুণাক্ষরেও খেয়াল হয়নি যে, নারান, ওর মামা, এ রকম অনেক পাহাড়িয়া মানুষ সমতলে এসে, এই ‘বম্বে টকিজে’ নানা ধরনের পেশায় লেগে গিয়ে কেউ স্থায়ী, কেউ অস্থায়ী ভাবে বসত গেড়ে নিয়েছে। বাহাদুর বা নারানের মতো অনেকেই হয়তো আদি বাসভূমি ছেড়ে এসেছে। ‘নেপালি বাহাদুর’ কথাটাই অবচেতনে কাজ করেছে। ওদের বর্তমান— ফেলে-আসা গ্রাম গুপ্তকাশী বা কুণ্ড-চট্টির কথা এই প্রসঙ্গে মনেও আসেনি।
‘পাওয়ার সেভার’ বাল্বের আলো খুব একটা জোরালো নয়। কয়েকটা রাতকানা মাছি ঘুরছে। বাহাদুরের দিকে চেয়ে রইলুম। মাথার চুল বেশির ভাগই উঠে গেছে। মাথার দু’পাশে আর কপালের ওপরে যে চুল রয়েছে, সবই প্রায় সাদা। রোগা মানুষটির গাল ভাঙা। মনে হল বেশ ক’দিন দাড়ি কামাননি। হাফহাতা ফতুয়ার থেকে শিরা-ওঠা পাহাড়ি মজবুত হাতের চেটোয় মাথা রেখে কী যেন ভাবছে।
জিজ্ঞেস করলুম, “উত্তরাখন্ড তো আর আপনাদের দেশ নয়। আপনারা নেপাল থেকে এসেছেন।”
বাধা দিল বাহাদুর। ম্লান হেসে বলল, “আরে শেঠজি! ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার কত পুরুষ আগে যে গুপ্তকাশীতে এসেছিল আমার পূর্বপুরুষ, তাও তো জানি না আমরা। আর জন্মে দেখিনি নেপাল। তাই আমরা এখন গাড়োয়ালিই হয়ে গেছি মনেপ্রাণে। তাও তো আজ প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বচ্ছর কোনও যোগাযোগ নেই।”
“তা হলে অত মন খারাপ হবার কী আছে!”
কথা ক’টি বললুম বটে বাহাদুরকে তবে মনে ভাসছে ফুর্তিবাজ ছেলে নারানের হাঁটু মুড়ে, মুখ লুকিয়ে কান্নার দৃশ্যটি। ওর চোখ, দুই গাল জলে ভেজা।
বাহাদুর বললে, “না। ওদিককার পাট আমার চুকেবুকে গেছে সেই কবে! ভুলেও গেছি। কাছে-দূরের আত্মীয়স্বজনরা কে কোথায় আছে, তারও খবর রাখি না কত্তগুলো বছর। কোনও আক্ষেপও নেই। এখানেই সব। বৌ আর তিন বছরের কচি মেয়েটাকে নিয়েই আছি, শেঠজি। আর আমার এই ক্যান্টিন।”
“তাহলে আর গুপ্তকাশী বা দেবভূমির জন্য মন খারাপ করছ কেন?”
জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করল বাহাদুর। বললে, “বাবা কেদারনাথ মহারাজের দয়া ছাড়া তো কিছুই হবার নয়। তাই মনটা কেমন আলগা হয়ে গেছে।”
থেমে, চট করে মাথা ঘুরিয়ে, একবার ঘরের দিকে দেখে নিয়ে, গলার আওয়াজ খাটো করে বললে, “আমার অতটা টান নেই। কিন্তু নারানের তো আছে! ওরই মন ভেঙেছে বেশি। শিশুকালের পাহাড়, ঝরনা-চড়াই-উতরাই-জঙ্গল... তার ওপরে ইস্কুলের ক’বছর... সব ভুলবে কী করে? তা ছাড়া সবচেয়ে আপন বা সবচেয়ে কাছে পেয়েছে ওর বাবাকে ওর জন্ম থেকে। জামাইবাবুর যেমন ছিল ছেলে-অন্ত-প্রাণ, ওরও তেমনি। গোটা শৈশব ও বাল্যকাল ওর কেটেছে বাবাকে ঘিরেই।”
“তাহলে বাবা আপন ছেলেকে এখানে, মানে নিজের কাছ থেকে এত দূরে ভিন্ দেশে পাঠাল কী করে?”
“জামাইবাবুরই দোষ। অমন দজ্জাল একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনা খুবই ভুল হয়েছে। একমাত্র ছেলে নারানের উঠতি বয়েস.. বড়জোর পাঁচ-ছ’ বছর। প্রথম প্রথম বেশ ছিল। যেই ওর নিজের কোলে...যাকগে শেঠজি। ওসব পুরনো কাসুন্দি। ঘেঁটে লাভ নেই।” কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বাহাদুর জিজ্ঞেস করলে, “আপনি তো এত্ত পড়াশুনা-দুনিয়া দেখা-হুয়া বুজুর্গ হ্যয়। আপনিই বলুন এই পাগল ছেলেকে নিয়ে কী করি?”
“জ্বরে পড়েছে। ডাক্তার দেখিয়েছেন। ওষুধও চলছে। চিন্তার কিছু নেই। দু’দিনে ঠিক হয়ে যাবে।”
বাধা দিল বাহাদুর। “ওর ঠিক জ্বর শুধু নয়। টিভিতে, খবরের কাগজে সব উত্তরাখন্ডের প্রলয়ের খবর। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কত্ত যে বানের জলে ভেসে গেছে, পাহাড়-ভাঙা ধসে চাপা পড়ে...”
সহসা নজরে পড়ল গরম চাদর মুড়ি দিয়ে কখন যে চুপচাপ আধো-অন্ধকারে নারান এসে দাঁড়িয়েছে...আমাদের মোটেই খেয়াল হয়নি। ওর কাঁপা কণ্ঠস্বর শুনে তাকালুম, “কোথায় পাহাড় ভেঙেছে? গুপ্তকাশীতে?”
কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, “এসো, বোসো নারান। কেমন লাগছে এখন?”
জবাব দিল পাল্টা প্রশ্ন করে, যেন ঘোরের মধ্যে, “কিন্তু বাপুজি কেমন আছে? মামুজি, কোই ফোন আয়া?”
“নেহি বেটা। ওই ঝড়-জল-বন্যায় লাইনই তো খারাপ হয়ে গেছে। আমিও তিন-চার বার ফোন লাগিয়েছি। বলছে, সবহি লাইন খারাব হ্যায়... বাদমে...”
নারান মামাকে বললে, বলতে বলতে ওর কাঁপা দুর্বল গলা কেমন ভাঙতে শুরু করল, “পরশু থেকে বলছি আমি যাই, বাপুকে আমি ঠিক খুঁজে...” বলতে বলতে কান্না চাপতে চেষ্টা করল হয়তো। গলা ধরে এল।
বাহাদুর ওর গায়ে, মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে যেন বললে, “দেখুন দিকি শেঠজি ছেলের আবদার। পাগলের কাণ্ড। কোথায় সব গ্রামের মানুষ, তীর্থযাত্রী কোনও রকমে ভাঙা পাহাড়, মন্দাকিনীর তাণ্ডব থেকে বেঁচে, নীচে সমতলে আসতে চাইছে... নারান উল্টে ওই প্রলয় কাণ্ডের মধ্যে পাহাড়ে উঠতে চাইছে।” তারপর চওড়া বেঞ্চিতে বসে নারানকে শুইয়ে দিল। হাঁটু মুড়ে মামার কোলে মাথা দিয়ে পাহাড়ের কিশোর শুয়ে পড়ল। বাহাদুর ওর গায়ে-মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললে, “তাছাড়া তোর বাবা তো খেটে খায়। গুপ্তকাশীতে গেলেও হয়তো পাবি না। কোন যাত্রীর সঙ্গে মালপত্তর বয়ে কেদারনাথ, রামওয়াড়া, গৌরীকুণ্ড, না ফাটা চট্টির দিকে গেছে, আমরা এখানে বসে জানব কী করে? কোথায় কোথায় খুঁজব আমরা বল?”
সত্যিই তো! সকালের কাগজে, নিউজ চ্যানেলে যে সব ভয়ংকর বিপর্যয়ে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার খবর পাচ্ছি বা দেখছি, তারপর ঘরের চেনাজানা ছেলেকে ওই সব অঞ্চলে পাঠাতেই সাহস পায় না মানুষ। বুক কাঁপে। যাকে খুঁজবে তাকে আদৌ হয়তো পাবে না। উল্টে নিজেই ওর মধ্যে হারিয়ে যাবে। প্রায় মাসখানেকের ওপর হয়ে গেল দেবভূমির এই বিধ্বংসী ভয়ানক রূপের তাণ্ডবে সমস্ত পাহাড়ি গ্রামের পর গ্রাম ভেসে গেছে, ধসের তলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত বারো-পনেরো হাজার মৃতদেহের খবর জোগাড় হয়েছে। লাগাতার বৃষ্টির ফলে কয়েকশো চিতা জ্বলছে-নিভছে। পাঁচ হাজার ঘোড়া বা খচ্চর এবং তাদের সহিসদের কোনও খবর নেই। কত গ্রামবাসী যে কোথায় হারিয়েছে, তার হদিশ কে দেবে?
এই সব ভাবলেও আতঙ্ক হয়। গণ্ডগোল তালগোলে উত্তরাখন্ডের কাছাকাছিও যে তার ভাগনেকে যেতে বা ছেড়ে দেয়নি, সেটা অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছে বাহাদুর।
শুয়ে থাকা নারানের চাদর-মুড়ি দেওয়া শরীর মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে। জ্বরের কারণেও হতে পারে, ফুঁপিয়ে কান্নাও হতে পারে। বাহাদুর গায়ে-মাথায় পরম স্নেহে হাত বোলাচ্ছে। মামা-ভাগনের এই মধুর সম্পর্কের মধ্যে উটকো মনে হল নিজেকে। ইশারায় বিদায় নিয়ে উঠে পড়লুম। মুম্বইয়ের বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে।
দু’তিন দিন বাদে শ্যুটিঙের ডাক পেয়ে দুপুরবেলা ফিল্মালয় স্টুডিওতে গেলুম নারানের খবর নেব বলে। ক্যান্টিনে ঢুকেছি। জয় বাহাদুর ক্যাশ কাউন্টারে বসেই হাত তুলে নমস্কার জানালেন। দু’তিনজন খদ্দের টেবিলে বসে খাচ্ছে। বাহাদুরের কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই, লাগোয়া রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এল নারান। খুশি হলুম। জ্বর ওর ছেড়ে গেছে। মুখে ফিরে এসেছে সেই চিরন্তন হাসিটি। দুটি জলখাবারের প্লেট খদ্দেরদের দিতে দিতেই বলল, “নমস্তে শেঠজি!”
“বাহ্! তোমার শরীর তো মনে হচ্ছে ফিট এখন। জ্বরজারি নেই তো!”
একগাল হাসি দিয়ে বললে, “নেহি শেঠজি।”
“খুব ভাল। সেটে চা নিয়ে আসবে তো আজ?” হেসেই জিজ্ঞেস করলুম।
“জরুর”। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা খামের মতো কী বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল।
টেলিগ্রাম। হয়তো এ দেশের এই শেষ টেলিগ্রাম। অনেক দিন পরে একটা টেলিগ্রাম— বাঃ! নাম লেখা যথারীতি ইংরেজিতে। ‘নারায়ণ থাপা’। ভেতরে টাইপ করা : “আই অ্যাম ওকে। ডোন্ট ওয়ারি। গড ব্লেস ইউ। ফাদার।”
“তুমি পড়তে পারো নারান?”
“ইংরেজি একটু একটু। ‘নারান’ পড়তে পারি।”
বাঃ! কোত্থেকে এল? গুপ্তকাশী, না পাহাড়ের নীচে হরিদ্বার-ঋষীকেশ থেকে?
উল্টে দেখলুম, পোস্ট অফিসের আবছা স্ট্যাম্প রয়েছে। ‘সান্তাক্রুজ-মুম্বই’। মুখ তুলে জয় বাহাদুরকে দেখলুম। হাতের কাজ ফেলে ও আমার মুখের দিকে দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল মামা আস্তে আস্তে। ভাগনের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে সেটের দিকে হাঁটতে লাগলুম।
ভুল করলাম?