এক মাঠ মুখ্যমন্ত্রী, গান ধরলেন তিনি

এক মাঠ মুখ্যমন্ত্রী! আর মঞ্চ থেকে যিনি তাঁদের গান শোনালেন, তিনিও মুখ্যমন্ত্রী! এমন মুখ্যমন্ত্রী আর কে আছে? নিজে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন একটু আগে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, রামলীলা ময়দানে আজ যাঁরা এসেছেন বা আসেননি, দিল্লির সকলেই আজ থেকে মুখ্যমন্ত্রী! এর পরে বন্দেমাতরম দিয়ে শুরু করে যে বক্তব্য তিনি রাখলেন, সেগুলি তাঁর আম আদমি পার্টির ঘোষিত নীতিই।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:১৬
Share:

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। শনিবার নয়াদিল্লির রামলীলা ময়দানে। ছবি:রমাকান্ত কুশওয়াহা

এক মাঠ মুখ্যমন্ত্রী! আর মঞ্চ থেকে যিনি তাঁদের গান শোনালেন, তিনিও মুখ্যমন্ত্রী!

Advertisement

এমন মুখ্যমন্ত্রী আর কে আছে?

নিজে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন একটু আগে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, রামলীলা ময়দানে আজ যাঁরা এসেছেন বা আসেননি, দিল্লির সকলেই আজ থেকে মুখ্যমন্ত্রী!

Advertisement

এর পরে বন্দেমাতরম দিয়ে শুরু করে যে বক্তব্য তিনি রাখলেন, সেগুলি তাঁর আম আদমি পার্টির ঘোষিত নীতিই। খুব নতুন কিছু নয়। কিন্ত শেষে এসে চমকে দিলেন গান গেয়ে। রাজনীতিতে হয়তো আগের চেয়ে ঢের বেশি পরিণত। কিন্তু যেগুলি তিনি করতে চান, তার জন্য আবেগের তাড়না কি তবে একই রকম রয়ে গিয়েছে এক বছর পরেও!

না, গান শেখেন না মাফলারম্যান। আজ সদাসঙ্গী ওই গলার বন্ধনী ছিল না তাঁর। জ্বর কমানোর ওষুধ খেয়ে এসেছেন, গলাটাও মোটে সুবিধের নয়। এই সব জানিয়েও গান ধরলেন কেজরীবাল। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গাইতেও বললেন সকলকে! সে গানের সুরতাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা বৃথা। শপথবাক্য যদি হয় মন্ত্র, তবে ওটা তাঁর প্রাণের গান। যে গান মানুষকে ভালবাসার কথা বলে। সকলকে নিয়ে চলার কথা বলে।

ভোটের আগের প্রতিপক্ষ কিরণ বেদীকে তিনি দিদি বলে ডেকে জানান, পরামর্শ নেবেন তাঁর। পুলিশ প্রশাসনে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে এই দিদির। নীতি নির্ধারণে পরামর্শ নেবেন বিধানসভায় শূন্যে নেমে আসা কংগ্রেসের নেতা অজয় মাকেনেরও। এমনকী, বিধানসভায় বিজেপির যে তিন মূর্তি একটি অটোরিকশাতেই (দিল্লিতে যা স্কুটার) এঁটে যাবে বলে ভোটের ফল বেরনোর পর থেকে ঠাট্টা-মস্করা চলছে এ ক’দিন, আজ কিন্তু সরকারের কর্মযজ্ঞে তাঁদেরও সামিল করে নেওয়ার কথাই ঘোষণা করেছেন ঢের পরিণত আপ নেতা।

দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে শপথের মঞ্চ থেকেই কেজরীবাল বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি শেখেন। অন্যের ভুল থেকে শুধু নয়। নিজের ভুল থেকেও। এবং ভুল থেকে শেখার কথা অকপটে স্বীকার করতেও তাঁর বাধে না। আর অন্য ঘরানার এই রাজনীতিতেই তিনি আলাদা। তাতেই তিনি ৭০-এ ৬৭! জেদের বশে সরকার ছেড়ে

আবার ফিরে আসার বৃত্তটি পূর্ণ করতে সময় নিলেন ঠিক ৩৬৫ দিন। যাওয়া আসা দু’টি ঘটল ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে। ভালবাসার দিনে। সেটাকে অবশ্য সমাপতন হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু কেউ কেউ যে বলছেন, বসন্ত এসে গেছে! আরব দেশগুলিতে গণতন্ত্রকামী অভ্যুত্থানকে যে ভাবে আরব-বসন্ত বলে থাকেন অনেকে, আপ-অত্যুৎসাহীদের কারও চোখে কেজরীবালের এই উত্থানও বুঝি তেমনই দিল্লি-বসন্ত! এ বার গোটা দেশের রাজনীতির খোলনলচে বদলে দেওয়ার কথাও বলতে শুরু করেছেন অনেক আপ নেতা। বলছেন, এ বার আমরা অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ব। লড়ব ভোটে। কেজরীবাল কিন্তু এঁদের উল্টো পথে। সাফ জানিয়েছেন, ভিন্ রাজ্যে নজর দেওয়ার মধ্যেও আসলে ৭০-৬৭-র অহঙ্কার। আপকে এই অহঙ্কার থেকে দূরে থাকার কথা বলে দিয়েছেন তিনি। জানিয়ে দিয়েছেন, আগের বিধানসভা ভোটের ফলে অতি-উৎসাহী হয়ে লোকসভা ভোটে ঝাঁপ দেওয়াটা ছিল ভুল। সেই ভুল আর নয়। আগামী পাঁচটা বছর তাঁরা শুধুই দিল্লির সেবক হয়ে থাকবেন।

কেজরীবাল-সহ সাত সদস্যের মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে এ দিন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে কোনও মন্ত্রক হাতে রাখেননি। এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ বলেই ব্যাখ্যা করছে রাজনৈতিক মহল। তাদের মতে, এতে দৈনন্দিন রুটিন কাজ আর ফাইলে ডুবে থাকবেন না মুখ্যমন্ত্রী। সরকারের কাজে সার্বিক নজরদারি রাখার সুযোগ পাবেন। যে কাজে তাঁকে সাহায্য করবে শীর্ষ আপ নেতাদের নিয়ে তৈরি একটি কমিটি। অতীতের বিশৃঙ্খলার কথা মাথা রেখে এ বার জনতা-দরবারের ব্যবস্থাও থাকছে না।

গত মঙ্গলবার ফল প্রকাশ থেকে আজকের শপথগ্রহণ মাত্র পাঁচ দিনেই তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিশানির্দেশ, তাঁর মন্ত্রকহীন মুখ্যমন্ত্রিত্বের কৌশল সমীহ কুড়োতে শুরু করেছে বিরোধী শিবিরের। কংগ্রেসের অজয় মাকেন টুইট করেছেন, “শুরুটা ইতিবাচক ভাবেই শুরু করলেন কেজরীবাল ও তাঁর দল।” কিরণ বেদীও বলেছেন, “এমন আনন্দের দিনে ভারতই আসল জয়ী।”

তবে সন্দেহ নেই কেজরীবালের এই পরিণত বোধ সবাইকে খুশি করেনি। হয়তো তিনি আশাভঙ্গ করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীতীশ কুমারের মতো বিরোধী নেতা-নেত্রীদের। হতাশ বিজেপির অন্দরে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের বিরোধী শিবিরও। তাঁদের প্রত্যাশা ছিল কেজরীবাল যে রকম একগুঁয়ে, তাতে জেতার পরেই হয়তো বিজেপি ও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন তিনি। রাজস্ব দফতরের আমলা হিসেবে ও গত ৪৯ দিনের সরকারের অভিজ্ঞতায় জারিত কেজরীবাল সেই ভুল আর করেননি। কৌশলী হয়েছেন তিনি। গত দেড় দশক ধরে দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিজেপি তাদের ইস্তাহারেই বলে এসেছে। নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই তিনি কার্যোদ্ধার করতে চাইছেন এ বার। জানিয়েছেন, তাঁর পাখির চোখ হবে দিল্লির উন্নয়ন। তার জন্য কেন্দ্রের সাহায্য চাইতে দ্বিধাবোধ করবেন না। দিল্লিকে দুর্নীতিমুক্ত রাজ্য করার কর্মসূচি থেকেও নড়ছেন না। গত দফায় বলছেন, ঘুষ চাইলে সেটিং করে নিন। শুধু কথা ফোন করে জানিয়ে দিন আমাদের। আজ তিনি সতর্ক। জানেন বিক্ষোভ-তরজায় এ সব মেটার নয়। চাই প্রমাণ। তাই আজ বলেছেন, ঘুষ চাইলে আপত্তি করবেন না। শুধু পকেটের মোবাইলে রেকর্ডিং বোতামটা টিপে দিন। সেই প্রমাণ পাঠিয়ে দিন সরকারের কাছে।

লক্ষ্যে অবিচল, তবু এ এক অন্য কেজরীবাল। প্রথম পর্বে যিনি উদ্দাম, অপরিণত, কিছুটা অপরিণামদর্শীও, দ্বিতীয় পর্বে তিনিই ঢের বেশি বাস্তববাদী রাজনৈতিক। সাধ ও সাধ্যের সীমারেখাটা জানেন। জানেন মানুষ তাঁকে শিক্ষা দিয়েও নতুন করে প্রমাণের সুযোগ দিয়েছে। এ বার বেলাইন হলে তৃতীয় সুযোগ মেলার আশা ক্ষীণ।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেই থানায় আটক দলীয় কর্মীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কেজরীবাল কিন্তু ফল ঘোষণার দিনেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অহঙ্কার নয়। ওই একটি মনোভাবই ডুবিয়েছে কংগ্রেস-বিজেপিকে। আজও বারবার সে কথাই বললেন তিনি। আপের টুপি পরে কেউ যদি গুন্ডামি করে, তখনই তাকে হাজতে পোরারও দাওয়াই দিয়েছেন দিল্লির নয়া মুখ্যমন্ত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে ছবি দিল্লির বুকে ধরা পড়ছে তা আটকাতেও তিনি যে বদ্ধপরিকর, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন।

লক্ষ্য পূরণে এ বার সৌজন্যের শক্তিকেও পুরোদমে ব্যবহার করছেন কেজরীবাল। রাজ্যের মর্যাদা, স্কুল-কলেজের জন্য জমি পাওয়া কিংবা জনলোকপাল বা আর্থিক মঞ্জুরি বিভিন্ন ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকছেই। তবু শপথের আগেই নরেন্দ্র মোদী রাজনাথ সিংহদের সঙ্গে দেখা করে এসে বুঝিয়ে দিয়েছেন শুরুটা সৌজন্যের আবহেই করতে চাইছেন তিনি। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় বার করতে উঠতে পারেননি, তখন কেজরীবাল শপথের আগেই তা সেরে ফেলেছেন। শপথে মোদীকে আমন্ত্রণ জানানোর সঙ্গেই রাজনৈতিক ভাবে সহাবস্থানের এক কৌশলী নীতিকে সামনে রাখছেন তিনি। কেজরীবালের কথায়, “আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলি আপনি দেশের কাজে ব্যস্ত থাকুন। বিদেশেও যেতে হয়। আপনি নিশ্চিত থাকুন দিল্লি আমি সামলে নেব।” কেন্দ্রের খবরদারি বরদাস্ত করবেন না, কেজরীবালের প্রচ্ছন্ন বার্তা সেটিও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement