আরও এক আলোর উত্সব পালিত হল। কাগজের ভাষায় সাড়ম্বরে। আবারও সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে সেই সব শব্দগুলো বাতাসে বিষ কিংবা শব্দ দানব। সাব হেডলাইন জানিয়ে দিল গ্রেফতারের সংখ্যাও বিধিভাঙার ফল। বুক ধড়ফড়, নিশ্বাসে কষ্ট, গলা-বুক-চোখ জ্বলার অভিযোগ বাড়ল হাসপাতালের বহির্বিভাগে। ভিড় বাড়ল ডাক্তারবাবুর চেম্বারেও। আমরা যে এতটুকু শুধরালাম না। আমরা কলকাতা কিংবা দিল্লি (এবং অন্যত্র) যেখাানেই থাকি, দূষণ সংক্রান্ত সরকারি বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটগুলি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিল। আবারও একরাশ হতাশা, দোষারোপ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটারে দূষণের পরিমাণগত ও তুলনামূলক চালচিত্র প্রকাশ পেল অভ্যাসগত ভাবে। যে চালচিত্র প্রকাশ পেল অভ্যাসগত ভাবে। যে ধ্বনিটি একই সঙ্গে এ সংশয়ীর মনে উচ্চারিত হতে থাকল তা আসছে বছর আবার হবে।
কালীপুজোর রাত যত বেড়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা ও শহরতলি বিষবাস্পে ততই ভরে উঠেছে। বাতাসে ধূলিকণার সঙ্গে মিশেছে তুবড়ি-রংমশাল-চরকি-ফুলঝুরি জাতীয় আতসবাজি নির্গত সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বনডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনডাই অক্সাইড, পটাসিয়াম নাইট্রেট-এর মতো ক্ষতিকর গ্যাস। প্রাকৃতিক কারণেই আতসবাজির ভারি ধোঁয়া মাটির কাছাকাছিই রয়ে গেছে। জলীয় বাস্প কম ছিল তবুও বিষের চাদরে ছেয়ে গেছে তামাম কলকাতা। এবং মুম্বই-দিল্লিও। বাজির ধোঁয়ায় থাকা ছোট বড় কণা চোখ-গলা-বুক জালিয়ে শরীরে মিশেছে। ফুসফুস, হৃদপিণ্ডকে আরও দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কেমন ছিল দূষণের পরিমাণ? কেন্দ্রীয় দূরষণ পরিষদ দূষণের যে মাত্রা বেঁধে দিয়েছে সেই অনুযায়ী, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পিএম-১০) মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০০ মাইক্রোগ্রাম থাকলে তাকে সহনশীল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কালীপুজোর সকালে অর্থাত্ ২৩ অক্টোবর তা ছিল ১৩৫.১৯ মাইক্রোগ্রাম। ২৪ অক্টোবর সকালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭৪.০৭ মাইক্রোগ্রাম। যা সহনশীল মাত্রার তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।
এ ভাবেই বেড়েছে নাইট্রোজেন ও সালফার ঘটিত যৌগের মাত্রা। উত্তর কলকাতায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পর্ষদের স্থায়ী দূষণমাপক যন্ত্র বলছে, সালফার ডাই অক্সাইডের সহনশীল মাত্রা সেখানে প্রতি ঘনমিটারে ৮০ মাইক্রোগ্রাম থাকার কথা ওই অঞ্চলে, তা বেড়ে পৌঁছে গিয়েছিল ১২২ মাইক্রোগ্রাম। উল্লেখযোগ্য, ২০১৩ সালে কালীপুজোর রাতে শহরের বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ৩৩৯.৯ মাইক্রোগ্রাম। পরদিন তা নেমে আসে ২৩৯ মাইক্রোগ্রামে।
শব্দ দানবের দিকে যদি তাকাই তবে দেখব সেই একই ছবি। কালীপুজোর রাত ছিল ভয়াবহ শব্দদূষণের রাত। ঠিক ২০১৩ সালের মতোই। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে হিসেব প্রকাশ করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, এ বারের দেওয়ালিতে ২৪ ঘণ্টায় গড় শব্দের মাত্রা ছিল ৬৪.৬ ডেসিবেল। গত দেওয়ালিতে যা ছিল ৬৩.৪ ডেসিবেল। দক্ষিণ কলকাতার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল গোলপার্কে ডেসিবেলের মাত্রা ছিল ৭৪। অথচ বসতিপূর্ণ অঞ্চলে সর্বোচ্চ মাত্রা থাকা উচিত দিনে ৫৫ ডেসিবেল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল। শুধু কি তাই? পরিবেশবিদরা অভিযোগ তুলছেন হাসপাতালের মতো ‘সাইলেন্ট জোন’-এও ফি বছরের মতো দেদার ফেটেছে শব্দবাজি। কেন্দ্রীয় দূষণ সংস্থার এস এস কে এম হাসপাতাল এলাকায় মনিটরিং স্টেশন জানাচ্ছে, কালীপুজোর রাতে হাসপাতাল অঞ্চলে শব্দদূষণের মাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ ডেসিবেল বেশি, অর্থাত্ ৬০ ডেসিবেল।
সংস্থার রিপোর্টে চোখ বোলালেই দেখা যাবে, দিল্লি, বেঙ্গালুরু কিংবা লখনউয়ের তুলনায় ডেসিবেল মাত্রা কলকাতায় বেশি ছিল। কম ছিল মুম্বই, চেন্নাই ও হায়দরাবাদের সাপেক্ষে। অথচ অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে সর্বোচ্চ ডেসিবেল মাত্রা ১২৫, সেখানে এ রাজ্যে তা ৯০ ডেসিবেলে বাঁধা।
একই ভয়ঙ্কর পরিবেশ দেশের অন্যান্য শহরেও। রাজধানী দিল্লির পলিউশন কন্ট্রোল কমিটিও জানাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় আহামরি কোনও পরিবর্তন চোখে পড়েনি। শব্দবাজির বিরুদ্ধে টানা কয়েক বছরের সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টার পরও দিওয়ালির রাতে ২৪ অক্টোবর আর কে পুরম, পঞ্জাবিবাদ সিভিল লাইনস ও মন্দির মার্গে দূষণ মাত্রা ছিল ভয়ঙ্কর। রেকর্ড বলছে, সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫) সর্বোচ্চ গড় মাত্রা ছিল সহনশীলতার আটগুণ বেশি। পি এম-১০ গত বছরের তুলনায় সামান্য কম থাকলেও তা ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় আটগুণ। সালফার ডাই অক্সাইড যা দিল্লিতে সাধারণ ভাবে কমই থাকে তাও স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গিয়েছিল। একই চিত্র নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের ক্ষেত্রে।
এই ভয়াবহ দূষণ শরীরে যে বিরূপ ক্রিয়া করে তা আমরা নানা ভাবে টের পাই। কিন্তু মনের উপর শব্দ ও আতসবাজির বিরূপ চাপ সম্পর্কে এখনও আমরা ততটা ওয়াকিবহাল নই। পাশের ঘরের শিশুটির মা যখন জানাল, তার বাচ্চাটি খালি ঘ্যান ঘ্যান করছে আর ঘুমে ঢুলছে তখন আশঙ্কা হয় বই-কি।
কিন্তু, দুধের শিশুর শরীরে বা মনে দূষণের প্রভাব আমরা বুঝব কী করে? চিকিত্সকরা বলছেন, রাতভর বাজির প্রবল শব্দ ও উজ্জ্বল আলোর ছটা নাকি মানসিক রোগ ডেকে আনে। আর তার উদাহরণও রয়েছে নাকি ভূরি ভূরি। সময়ে ঘুম না আসা, প্রিয় বিষয়েও মন না বসা কিংবা মন অস্থির অস্থির করতে থাকা— প্রথম প্রথম এ ভাবেই আলো ও শব্দের দাপটের প্রভাব জানান দেয় মানসিক স্বাস্থ্য ভাল নেই। এখান থেকেই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগের শিকার হতে পারেন কেউ কেউ।
তবে কী এই কানের পর্দা ফাটানো শব্দ, চোখ ঝলসে দেওয়া আলোর হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই? সমস্যাটা যে আরও গভীরে। এত দু’দিনের একটা উত্সবের বিষয় নয়। আমাদের শহরগুলি সারা বছরই যানবাহনের দূষণের শিকার। কলকাতা-দিল্লি-মুম্বই যে দিকেই তাকাই না কেন বার বার ভয়াবহ চিত্রটাই চোখে ধরা পড়ে।
পরিসংখ্যান বলছে দিল্লিতে যেখানে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যার ১৩ জন ক্যান্সারে ভোগেন, সেখানে কলকাতায় সেই সংখ্যাটা ১৮। কলকাতায় প্রতিদিন ২০ লক্ষ গাড়ি চলাচল করে অথচ তার জন্য রাস্তা রয়েছে ছয় শতাংশ। দিল্লিতে যা প্রায় ২০ শতাংশ। দূষণ রোধে সবুজায়নের এক বড় ভূমিকা রয়েছে। সেখানেও দেখব আমাদের হতশ্রী অবস্থা। দিল্লিতে যেখানে সবুজের আচ্ছাদন রয়েছে ১৯ শতাংশ, মুম্বইয়ে ১৮ শতাংশ, কলকাতায় সেখানে মাত্র ৫ শতাংশ। কলকাতায় তো গাছ এখন বিরল হয়ে আসছে! যার জন্য কমছে নানা পাখিও। আর পাখি কমলে গাছও কমবে। উত্সবের আবহে যখন দূষণ আরও বেড়ে যায় তখন বাতাসে কার্বন কণাও বাড়ে। সহজেই কার্বন-সহ অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থের কণা প্রশ্বাসের সাহায্যে ফুসফুসে গিয়ে বাসা বাঁধে। ফলে ফুসফুসের ক্ষমতা কমে যায়। শ্বাসকষ্টের প্রবণতা স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে যায়। আবার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে দূষণ বেড়ে যাওয়ার অর্থ, একগুচ্ছ ক্যান্সার প্রবণ যৌগের উপস্থিতির সংস্পর্শে আসার আশঙ্কাও এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে যাওয়া। এতে ফুসফুস ছাড়াও শ্বাসপ্রশ্বাসে যুক্ত অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্যান্সারের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের দুই গবেষক ‘দূষিত বাতাস এবং স্বাস্থ্যের উপর তার প্রতিক্রিয়া’ নিয়ে এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কী ভাবে নানা রোগের থাকা আমাদের উপর চেপে বসেছে।
দূষণ রোগের শিকার
শ্বাসকষ্ট ৪১ শতাংশ। ফুসফুসের ক্ষমতা হ্রাস ৪৭ শতাংশ। অ্যাজমা ৪.৪ শতাংশ। মাথা ব্যথা ৭৬ শতাংশ। গলায় সংক্রমণ, সর্দি, হাঁচি সাইনুসাইটিস ৬৩ শতাংশ। ক্রনিক সর্দিকাশি ৬২ শতাংশ। ঘুমের সমস্যা ৪৫ শতাংশ। চোখে জ্বালা ১৪.৪ শতাংশ। ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার ৪ শতাংশ। উচ্চরক্তচাপ, বেশি পালস রেট, হাইপার টেনশন ৩০ শতাংশ। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসা ৩২.৯ শতাংশ। রক্তল্পতা, লিভারের রোগ, জিনে পরিবর্তন ৬৭.৮ শতাংশ। ক্যান্সারের আশঙকা ১৫.৩। এর পর নিশ্চয়ই নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন বিধি, উদ্যোগও জরুরি সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি। বেজিং কিংবা সাংহাই নানা ভাবে শব্দ বা আতস বাজির বিরুদ্ধে জরুরিকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমন শহর জুড়ে টানা তিন দিন ঘন ধোঁয়াশা থাকলে কোনও রকম বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ। পাঁচ বা তার বেশি বাজির প্যাকেট কিনলে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। সাংহাই অনুমোদিত বাজি বিক্রেতার সংখ্যা চারশোয় বেঁধে দিয়েছে। গত বছর এক উত্সবের সময় বাজি ফাটানোর জেরে সাংহাই শহরের দূষণ পাঁচগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সাংহাই-এর কাছে ঐতিহাসিক শহর হাংসো তাদের নববর্ষ উত্সবে আতসবাজি প্রদর্শন বাতিল করে দেয়। এত দিন সেখানে প্রচুর বাজি পড়ানো হতো। পাশাপাশি উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন টেকনিকের। যাকে বলা হচ্ছে ‘গ্রিন ফায়ার ওয়াকার্স’। এই কলা কৌশলে এমন কাগজ ব্যবহার করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ পুড়ে যায় ধোঁয়াও হচ্ছে কম এবং সালফার ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ইংল্যান্ডে ফায়ারওয়ার্কস রেগুলেশন অ্যাক্ট ২০০৪ অনুযায়ী রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা অবধি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ। প্রয়োজনে সয়মসীমা বাড়ানোও যায়। বিধিভঙ্গ হলে রয়েছে কড়া শাস্তি। পাঁচ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত জরিমানা অথবা ছয়মাস কারাবাস। সে দেশে ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে সামাজিক ভাবে সংঘবদ্ধ অনুষ্ঠান। ফলে যে যে ভাবে যেখানে খুশি বাজি ফাটাবে না। একটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমাদের দেশে দেওয়ালি উত্সবে শুধু আইন করে, নির্দেশ দিয়ে যথেচ্ছ বাজি পোড়ান বন্ধ করা যাবে না বলেই বহু মানুষ মনে করেন। তাদের মতে চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বেশি বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে। শব্দ ও আতসবাজির দূষণ আমাদের শরীর ও মনে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে তা পাকা উদাহরণের সাহায্যে সাধারণের মনে গেঁথে দিতে হবে। শব্দসীমা নির্দিষ্ট করা, ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগ নিষিদ্ধ করা, বাজি পোড়ানোর স্থান ও সময় বেঁধে দেওয়া— এমন সব আইন প্রয়োজন পরিবেশবিদ ও কর্মীদেরও। তবে চিকিত্সক সমাজের ভূমিকাই মুখ্য হোক এমনটাই দাবি সচেতন সমাজের।
আসলে সর্ষের মধ্যে ভুত থাকলে কোন ওঝা ভুত তাড়াবে? ড্রোন নিয়ে বহুতলের উপর নজরদারি করলেই কি শব্দ-বাজি বন্ধ হবে? না রং মশাল-তুবড়ির দূষণ কমবে? সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে, বলতে হবে, দূষণ চাই না, বাঁচতে চাই, শিশু-বৃদ্ধদের বাঁচতে দাও!