নবীন তথা অর্বাচীন ও প্রাচীনদের নির্বাচন-নেত্য শেষ হয়েছে। ফলাফল হাতে নিয়ে কাছাকোঁচা সামলে জয়ীরা সব দলে দলে ধাওয়া করেছেন দিল্লি অবধি। কী? না, সকলেই দেশের, দশের উন্নতির জন্য সেবা করবেন। সমগ্র ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করবেন।
উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ? হা-হা!
মহান দেশের গোটা চেহারার কথা হলফ করে বলা যায় না। তবে অর্থনৈতিক রাজধানী তথা, ধনী এই অসাড় শহর মুম্বইয়ের পুব পারে একটি অঞ্চলে যেতে হয়েছিল ভিন্ন কাজে। অ্যান্টপ হিলে। বেলা হেলে পড়েছে। রোদের তাত কমেনি। কোত্থেকে একটা কটু গন্ধ ভেসে আসছে দমকা বাতাসে। প্রয়োজনমতো নাকে রুমাল চাপা দিচ্ছি এবং হাঁটছি। খিলখিল হাসির উচ্ছ্বাসে চোখে পড়ল, সামান্য দূরে খানিকটা খোলা জায়গায় একটি ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ প্যারাম্বুলেটরে চড়ে হাওয়া খাচ্ছে ও নিষ্পাপ হাসিতে বাতাসকে খুশি করে দিচ্ছে। নিষ্পাপ, পবিত্র, অকপট, সহজ— শিশুদের ব্যাপারে এই সব কথা কী সুন্দর ভাবে খাপ খেয়ে যায়। তারপরে ধাক্কা লাগে বাস্তবের সঙ্গে। সে ধাক্কায় ঘুমে-দেখা স্বপ্ন খানখান হয়ে যায়। জলজ্যান্ত চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যতে’র বৃহত্তর ছবি। যেমন এখন, হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল।
কাঁচা, এবড়ো-খেবড়ো হাঁটা রাস্তার বাঁ দিকে, সামান্য নিচুতে খোলা নর্দমা বা নালা। অসম্ভব নোংরা জল বইছে। বইছে, না একেবারে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে—উঁচু জমি থেকে ঠাহর পাওয়া মুশকিল। তবে কটু গন্ধের যে আভাস এতক্ষণ দূর থেকে পাচ্ছিলুম, এখানে তার ভয়ংকর ঝাঁঝে গা গুলিয়ে ‘ওয়াক’ উঠে আসে। নালা সাফাই হচ্ছে। ‘ঐ আসে, ঐ অতি ভৈরব হরষে’র আগমনবার্তা পৌঁছে গেছে শহরের কর্তৃপক্ষের আপিসে, কাছারিতে। মাথার ওপরে ‘গুরুগুরু’ গর্জন ও মাটিতে শান্তিজলের মতন বৃষ্টির ছিটেফোঁটা। দিকে দিকে ‘ম্যানহোল’, নর্দমা সাফাইয়ের হিড়িক পড়ে গেছে। সারা বচ্ছর ধরে শহরের নোংরা জঞ্জাল, ক্লেদ-কলুষ-পুঁজ-রক্ত, পাপ জমে জমে এ শহরের একমাত্র নদী মিঠি থেকে আরম্ভ করে, তার খাল-বিল-নালা সব ভরাট হয়ে গিয়েছে। ফলে তিরতির জলস্রোতও ক্ষীণ ক্ষীণতর হতে হতে এখন প্রায় নিথর, নিরেট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনের তিন-চার মাস যে নাগাড়ে জলপ্রপাতের মতন বৃষ্টি হবে, সেই জলস্রোত বেরুবে কোথা থেকে? সমুদ্রেই বা পৌঁছবে কোন উপায়ে? কয়েক বছর আগের সেই ২৬/৭-এর বন্যার কথা ভেবে তটস্থ কর্তৃপক্ষ। ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের লোকজন সব বদ্ধ নালা-নর্দমায়।
না, না! ভুল বললুম। নর্দমা সাফাইয়ের জন্য লোক নামানো হয়েছে— নিজেরা নামবেন কচু! তেনারা তো শাসকদল। নেতা, মন্ত্রিমণ্ডলের ভায়রা ভাই। রুমালে বিলিতি সেন্টের শিশি উল্টে, নাকে চেপে ধরে, চতুর্দিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড়জোর একবার পরিদর্শন করতে যাবেন— নালা-নদী-নর্দমা। নইলে, “গন্ধ শুঁকে মরতে হবে, এ আবার কি আহ্লাদ!”
অ্যান্টপ হিলের এমনই একটি অকুস্থলের (অকুস্থলই বটে!) পাশ দিয়ে সে দিন যেতে যেতে চোখে পড়ল আমাদের ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’। উঁহু! প্যারাম্বুলেটারে ‘হাসিখুশি’ বসে হাওয়া খাওয়া স্বপ্নের শিশু নয়। রীতিমতন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানো— না, মাটিতে নয়, নর্দমায় নেমে-যাওয়া দশ-বারো বছরের নাবালক তিনজন।
সবচেয়ে কচিটির নাম গণেশ দেবেন্দ্র। ‘মিউনিসিপাল ইস্কুলে ছয় কেলাসে’ পড়ে। মিউনিসিপ্যালিটির কর্তাব্যক্তিরা ক’জন এসেছিলেন পরিদর্শনে। তাঁরাই খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। কারণ, অপ্রাপ্তবয়স্ককে কাজে লাগানো তো ঘোরতর বে-আইনি! আলোচ্য তিনটি ‘ভবিষ্যৎ’ ছাড়া, আরও জনাকয়েক নোংরা-সাফাই কাজে নেমেছে। কারও হাতেই দস্তানা বা ‘গ্লাভস’ নেই। পায়ে গামবুটের বদলে স্রেফ নিজ নিজ হাওয়াই চটি।
“আজকে নিয়ে আমার চার দিন। পঞ্চাশ টাকা রোজের কাজ। সকাল আটটা থেকে সন্ধে অবধি। আর, সাব্ বলেছেন হপ্তা হলে টাকাটা পাব।”
অন্য দুটি ছেলের নাম হরি কুমার (১৩) ও অশোক ওয়ল্ভাদে (১২)। এরাও হাইস্কুলে পড়ে। এখন গরমের ছুটি। সহসা ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা’র বদলে হপ্তায় সাড়ে তিনশো টাকার ফুরনে কাজ পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! এ ছাড়া, ‘লেখাপড়া-খেলাধুলার-বয়সি ছেলেরা জনসাধারণের অস্বাস্থ্যকর জঞ্জাল, মলমূত্র, পুঁজরক্ত, কলুষ ও পরিত্যক্ত স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদির ভেতর ভয়ঙ্কর তথা মারাত্মক রোগবীজাণুর উপস্থিতি সম্পর্কে কতখানি আর সজাগ, সচেতন থাকতে পারে!’ ফলে ‘টাকা রোজগার হবে’ ভেবেই এরা নির্দ্বিধায়, নির্বিচারে ওই ভয়ানক রোগবীজাণু ঠাসা পচা-নোংরা খোলা নর্দমার আবদ্ধ ‘ক্কাথ’-এর ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এদের খালি হাত-পা। ঢাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। গত চার দিনেই কত রকমের যে রোগ শরীরের রোমকূপ দিয়ে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে, তার হিসেব কে রাখে?
কর্তৃপক্ষ? ছাই!
তাঁদের যখন এই জাতীয় অবহেলার কথা জানিয়ে, এ প্রসঙ্গে সচেতন করা হল, তাঁরা খুব মনোযোগ দিয়ে, শুনেটুনে, “আহ, কি অন্যায়, ছিঃ ছিঃ, ইশ—” ইত্যাদি অভিব্যক্তি প্রকাশ ঘটিয়ে বললেন, “খুবই যাচ্ছেতাই কাণ্ড! শুধু অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাজে লাগানোর মতো বে-আইনি ব্যাপারই নয়। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো—ওদের শরীর-স্বাস্থ্য সংরক্ষণের কোনও রকম বন্দোবস্তই করেনি লেবার কন্ট্রাক্টর! অত্যন্ত অবহেলার ব্যাপার!”
তা, প্রতিকারের ব্যবস্থা কি নেওয়া হবে?
ঘোরতর চিন্তাবিদ, বিজ্ঞ এবং সর্বশক্তিসম্পন্নের কায়দায় তূরীয় কণ্ঠে জবাব এল প্রায় দেববাণীর মতোন, “হবে, হবে। ভাববেন না। যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই শহর, এই রাজ্য, এমনকী এই মহান দেশের জনসাধারণের চোখের সামনে এ জাতীয় শৈশব-হরণের দৃশ্যাবলি একেবারে গা-সওয়া হয়ে গেছে। ইলিশ মাছভাজা চিবোতে চিবোতে টিভির পর্দায় আমরা শৈশববিহীন শিশুদের ছবি দেখি চ্যানেল পাল্টে পাল্টে। স্রেফ আট মাসের শিশুকে ধর্ষণের খবর আমরা নির্বিবাদে শুনি। নাবালক ছেলে মদ খেয়ে তার নতুন গাড়ির তলায় একাধিক মাথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, কচিকাচা ছেলেমেয়েদের ধর্ষণ করে মেরে ফেলছে, দেনার বোঝা সহ্য করতে না পেরে কর্তা তার স্ত্রী ও চারটি সন্তানকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলছে, খিদের জ্বালায় দু’ বছরের বোনের কান্না থামছে না দেখে সাত বছরের দাদা তাকে খুন করে চুপ করাচ্ছে। শুনে চমকে উঠি তৎক্ষণাৎ। শুনে শুনে, দেখে দেখে আমাদের সহ্যশক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়ে গেছে অম্লান বদনে হজম করার শক্তি। ভাবতে পারি আমরা। নানান ধরনের চিন্তা-ভাবনা-তর্কাতর্কির কাজ করে আমাদের মাথার ভিতরে। চিন্তা আমরা করি ঠিকই অবরে-সবরে। কিন্তু অনুভব করি কি কিছু? কোনও বোধ কি কাজ করে হৃদয়ের ভিতর?
কে জানে! যদ্দুর বুঝি, হয়তো না। প্রসঙ্গত, বহু দশক আগেই চার্লি চ্যাপলিন বলে গেছেন, “উই ফিল টু লিটল অ্যান্ড থিঙ্ক টু মাচ!” তাই, বলছিলুম, নতুন মন্ত্রীরা এলেন। পুরনো দলবল ভেঙেচুরে নতুন মন্ত্রিসভা হল। এবং, আরও হবে! শহরের, রাজ্যের, দেশের ওপর তলায় অনেক অদলবদল হচ্ছে, হবে। ‘শৈশব’ শব্দটির সঠিক অর্থ আজকাল দেশচালকরা খুঁজে বের করবেন কি? ‘দেশের-দশের’ বড় বড় কথায় না গিয়ে, এই রাজ্য বা শহরের অথবা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও শহরের শিশুদের মুখ চেয়ে আমরা কি সগর্বে বলতে পারব,—“উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ!!”