জয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ। করুণাও মিলল না। পুরনো বিপ্লবী বন্ধুরাও ছেড়ে যাচ্ছে। প্রফুল্ল চিত্তে আর কী ভাবে থাকা যায়?
বৃহস্পতিবারের দুপুরে সিপিএমের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহার ঘোষণা হবে। তার আগের দিন সিপিএমের সদর দফতর এ কে গোপালন ভবনে দলের হাল হকিকত নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানেই এক রসিক কমিউনিস্ট নেতা এই মন্তব্যটা করলেন। লোকসভা ভোটের আগে জাতীয় রাজনীতিতে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা করছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় যে বিশেষ সাফল্য মিলছে না, তা দলের ওই নেতার মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট। জয়ললিতা-নবীন পট্টনায়ক-প্রফুল্ল মহন্তদের নিয়ে তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির চেষ্টা শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। যার জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দিকেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে। সিপিএম নেতাদের আশঙ্কা, শীর্ষ নেতৃত্বের এই ব্যর্থতা দলের নিচুস্তরেও হতাশা বাড়াবে। নির্বাচনী ইস্তাহারের বীজমন্ত্র দিয়ে সেই হতাশা কাটানো যাবে কি না, তা নিয়েও নেতারা সন্দিহান।
সিপিএম সূত্রের খবর, আগামিকালের নির্বাচনী ইস্তাহারে কংগ্রেস ও বিজেপির থেকে সমদূরত্বের কথা বলা হলেও জোর দেওয়া হবে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে আটকানোর উপরে। একই সঙ্গে বিকল্প সরকার নয়, বলা হবে কেন্দ্রে বিকল্প নীতির প্রয়োজনের কথাও। মোদী-রাহুল গাঁধীর লড়াইয়ে নিজেদেরও প্রাসঙ্গিক রাখতে বলা হবে, এই লোকসভা ভোট নেতাদের নয়, নীতির লড়াই। কিন্তু সিপিএম অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে নিয়ে সরকার গড়ে সেই বিকল্প নীতি আনবে, ইস্তাহারে তেমন কোনও স্বপ্ন দেখাবে না সিপিএম নেতৃত্ব।
প্রশ্ন উঠছে, তা হলে মানুষ লোকসভা ভোটে সিপিএমকে ভোট দেবেন কেন? শীর্ষ নেতৃত্ব মানছেন, এই বিষয়টা মানুষকে বোঝানো শক্ত। লোকসভায় পরবর্তী সরকার গঠনে যদি সিপিএমের কোনও ভূমিকাই না থাকে, তা হলে শুধু কংগ্রেস, বিজেপি বা তৃণমূলের সমালোচনা করে ভোট চাওয়া মুশকিল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার বক্তব্য, “তাই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে একজোট করে এক মঞ্চে আনার চেষ্টা হচ্ছিল। যাতে সিপিএম একা না হলেও এই বিকল্প জোট বা তৃতীয় ফ্রন্ট পরবর্তী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে প্রচার করা যায়। কিন্তু সেটাও ঠিক দানা বাঁধল না।”
গত দুই লোকসভা ভোটে পরিস্থিতি অবশ্য অন্যরকম ছিল। দলীয় নেতাদের বক্তব্য, ২০০৪ ও ২০০৯, দুই লোকসভা ভোটের ইস্তাহারেই সিপিএম স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল। ২০০৪-এর ভোটের ইস্তাহারে সিপিএমের প্রধান আহ্বান ছিল, এনডিএ-সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে কেন্দ্রে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন। ২০০৯-এর ভোটের আগে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে সমর্থন প্রত্যাহার করার পর সিপিএম কেন্দ্রে বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের ডাক দেয়। ভোটে ভরাডুবির পর প্রকাশ কারাট স্বীকার করেন, একেবারে সরকার গঠনের ডাক দিয়ে ফেলাটা বাড়াবাড়ি হয়েছিল। এ বারে সেই পথে তারা হাঁটছে না বলেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে সিপিএম জাতীয় রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে? দলের এক নেতারই মন্তব্য, “শুরুতেই তৃতীয় ফ্রন্টের প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ায় এখন এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে হচ্ছে।”
এই বিকল্প জোটের সব থেকে বড় ভরসা ছিলেন জয়ললিতা। কিন্তু নিজের রাজ্য তামিলনাড়ুতেই সিপিএমকে এক ইঞ্চি বাড়তি জমি ছাড়তে রাজি হননি তিনি। করুণানিধির ডিএমকে-র সঙ্গে কথাবার্তাও বিশেষ এগোয়নি। অন্ধ্রে জগন্মোহনের সঙ্গে জোট নিয়ে বামেদের মধ্যেই মতভেদ তৈরি হয়েছে। অসমে প্রফুল্ল মহন্ত বামেদের ছেড়ে তৃণমূলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। বাম দুর্গ কেরলে আরএসপি বাম জোট ছেড়েছে। ওড়িশার নবীন পট্টনায়কও এই বিকল্প জোটের প্রথম বৈঠকে যোগ দেননি। সিপিএমের ভরসা এখন মুলায়ম, নীতীশ কুমার ও এইচ ডি দেবগৌড়াদের মতো কয়েক জন। কিন্তু এঁরা নিজেদের রাজ্য থেকে বিপুল আসনে জিতে আসবেন, এমন আশা বাম নেতারাও করছেন না। ভোটের পরে এঁরা বামেদের সঙ্গে থাকবেন, নাকি পরিস্থিতি বুঝে ভোল বদলাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গত সপ্তাহে অণ্ণা হজারে রামলীলা ময়দানে মমতার সঙ্গে এক মঞ্চে না আসায় সিপিএম নেতারা উজ্জীবিত হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা বুঝতে পারছেন, ওই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
সিপিএম নেতারা মানছেন, এই পরিস্থিতিতে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুুরার বাইরে থেকে বামেদের কোনও আসন জিতে আসার সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। তার মধ্যেই অবশ্য আজ তামিলনাড়ু, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ় ও আন্দামান-নিকোবরের ১৪টি আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে সিপিএম। তামিলনাড়ুর কোয়েম্বত্তূরে বর্তমান সাংসদ পি আর নটরাজনকে ফের প্রার্থী করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইউ বাসুকিকেও প্রার্থী করা হয়েছে। একই ভাবে রাজস্থানের শিকর থেকে আর এক কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা অমরা রামকে প্রার্থী করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত লোকসভার মোট ৮৮টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল সিপিএম।