ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ার। —ফাইল চিত্র।
‘সাত সমুদ্র তের নদী পার, দীপান্তরের আন্দামান...’— ভারতের দক্ষিণপ্রান্তে অসীম সাগরের বুকে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলি যে ব্রিটিশদের গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি ও উপনিবেশ হয়ে উঠতে পারে, সমীক্ষা ও জরিপের ফলে তা প্রথম অনুভব করেছিলেন ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ার। এত দিন যাঁর নামেই সরকারি ভাবে নামাঙ্কিত ছিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী, ‘পোর্ট ব্লেয়ার’।
সালটা ১৭৮৮, ২০ ডিসেম্বর। কলকাতা থেকে এলিজ়াবেথ ও ভাইপার নামের দুই জাহাজ নিয়ে আন্দামানের উদ্দেশে রওনা হলেন আর্চিবল্ড। তার আগেও অবশ্য এই কাজ তিনি করেছেন। ১৭৭১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘বম্বে মেরিন’ বিভাগে মিডশিপম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি। ভারত, ইরান ও আরবের উপকূল বরাবর তখন সমীক্ষা চালাচ্ছে ব্রিটিশরা। তাতে যোগ দিয়েছিলেন ব্লেয়ার। ১৭৮০ সাল, উত্তমাশা অন্তরীপে জরিপ করতে গিয়ে ফরাসিদের হাতে বন্দি হন তিনি। ছাড়া পান ১৭৮৪ সালে। ওলন্দাজদের কাছে হাত বদল হয়ে বহু কষ্টে ফিরে আসেন।
সমুদ্র ও জরিপের নেশা তখন তাঁকে পেয়ে বসেছে। ১৭৮৬ থেকে ১৭৮৮ সালের সালে মলদ্বীপের দক্ষিণে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ, কলকাতার কাছে ডায়মন্ড হারবার ও হুগলি নদীতে সমীক্ষা চালান তিনি। তার পরে রওনা হন আন্দামান ও নিকোবরের উদ্দেশে। তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের এতে বিশেষ আগ্রহ ছিল। মালয় জলদস্যুদের হামলায় ব্রিটিশরা তখন নাজেহাল। ১৭৮৮ থেকে ১৭৮৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলে ব্লেয়ারের আন্দামান অভিযান।
ব্লেয়ারের তৈরি করা আন্দামানের নটিকাল চার্ট। ছবি: সংগৃহীত।
গ্রেট আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ পূর্বাংশে পা রেখেই তিনি বুঝতে পারেন, দুর্দান্ত একটি প্রাকৃতিক বন্দর (ন্যাচারাল হারবার)-এ এসে পৌঁছেছেন। এখান থেকে জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করা সহজ, উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে সহজেই। খুঁজে পাওয়া এই বন্দরের নাম দেন পোর্ট কর্নওয়ালিস (ব্রিটিশ নেভির বিখ্যাত কমান্ডার ইন চিফ উইলিয়াম কর্নওয়ালিস-এর নামে, মতান্তরে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের নামে)। পরে অবশ্য ব্লেয়ারের সম্মানেই বন্দরের নাম পাল্টে রাখা হয় পোর্ট ব্লেয়ার। পাশাপাশি, বরতং ও ব্যারেন দ্বীপেও সমীক্ষা চালান তিনি। তাঁর রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তিনি ব্যারেনের আগ্নেয়গিরিকে সক্রিয় দেখেছেন।
১৭৮৯ সালের ২২ এপ্রিল কলকাতায় রিপোর্ট জমা দেন তিনি। এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় উপনিবেশ, যার ফার্স্ট অফিসার-ইন-চার্জ হয়ে ১৭৮৯-এর সেপ্টেম্বরেই আন্দামানে ফেরেন ব্লেয়ার। তবে, সেই উপনিবেশ টেকেনি। অসুখের প্রকোপ ও স্থানীয় জনজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘাতে ১৭৯৬ সালে পরিত্যক্ত হয়। ব্লেয়ার ১৭৯৫ সালেই ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছেন। প্রায় ৬০ বছর পরে পাকাপাকি উপনিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয় ব্রিটিশরা।
গত শুক্রবার পোর্ট ব্লেয়ারের নাম পাল্টে ‘শ্রী বিজয় পুরম’ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। নাম পরিবর্তনের খেলা তো এমনই, ছায়া ঘনিয়ে আসে রাধানাথ শিকদার থেকে ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ারের উপর... ইতিহাস স্রেফ নীরব সাক্ষী হয়ে থেকে যায়।