এক সময়ে পাঁচ নেতাই ছিলেন রাহুল ব্রিগেডে। এখন একা সচিন পাইলট। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
জোড়ার যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই ভাঙার খবর পেয়েছিল কংগ্রেস। রবিবার রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ শুরুর আগেই খবরটা জানাজানি হয়েছিল। মরাঠা মুলুকের কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী মুরলী দেওরার ছেলে মিলিন্দ দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন একনাথ শিন্ডের শিবসেনা শিবিরে। তার পর থেকেই একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। যেখানে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের সুদিনে ইউপিএ-২ সরকারের পাঁচ তরুণ মন্ত্রী হালকা মেজাজে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। সেই জটলায় রয়েছেন মিলিন্দ দেওরা, আরপিএন সিংহ, জিতিন প্রসাদ, জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে এবং সচিন পাইলট।
শেষ জনকে বাদ দিলে গত কয়েক বছরে বাকি সকলে কংগ্রেস ছেড়েছেন। কংগ্রেসের ককপিটে এখন একা ‘পাইলট’। এবং তাঁর হাতেও যে রাজনীতির বিমানের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা-ও নয়। রাজস্থান কংগ্রেসের মধ্যে তিনিও খুব একটা ভাল জায়গায় নেই। একটা সময়ে রটে গিয়েছিল, অশোক গহলৌতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে দল ছেড়েই দেবেন প্রয়াত রাজেশ পাইলটের পুত্র। শেষ পর্যন্ত একটা ‘গোললাইন সেভ’ হয়েছে। রাহুলের যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন সচিনও। কিন্তু অনেকেই বলছেন, তাঁর সঙ্গেও কংগ্রেসের সম্পর্ক সরু সুতোয় ঝুলছে। লোকসভা ভোট পর্যন্ত তাঁরাও কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন এই যুবকের রাজনৈতিক যাত্রার দিকে।
কেন এমন হল? কেন রাহুলকে ছেড়ে গেল তাঁর বহুচর্চিত ‘ব্রিগেড’?
অনেকের মতে, নেতৃত্বের সঙ্কট। সেই মতাবলম্বীরা মনে করেন, কংগ্রেসে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তার অনেকটাই একটি পরিবারের কথা ভেবে। সংগঠনের জন্য বা অন্য কোনও বৃহত্তর কারণে নয়। তাঁদের মতে, নেতৃত্বকে দলকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। কংগ্রেসের বর্তমান নেতৃত্বের সেই ‘ঘাটতি’ রয়েছে। এরই কাছাকাছির অভিমত হল, রাহুল যে ‘তরুণ ব্রিগেড’ তৈরি করেছিলেন, তার সেনানীদের প্রথাগত শিক্ষাদীক্ষা উচ্চমার্গের হলেও রাজনীতিতে তাঁদের উত্থানের নেপথ্যে ছিল পারিবারিক পরিচয়। মূলত ‘পিতৃভাগ্যে’ কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকার ‘অধৈর্যে’ তাঁদের কংগ্রেসে থাকতে একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিল। সে কারণে ‘বিরোধী’ থেকে ফের ‘শাসক’-এর জামা গায়ে চাপাতে চেয়েচিলেন তাঁরা। তৃতীয় অভিমত হল, এটা ঠিকই যে, রাহুল নিজের একটি ‘টিম’ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু, সেই ‘টিম’কে তিনি একটি সুতোয় বেঁধে রাখতে পারেননি তা-ও বাস্তব। রাহুল জানতেন, তাঁর মতোই এঁরাও কেউই মাটি থেকে রাজনীতি করে উপরে উঠে আসেননি। বরং দ্বিতীয় মনমোহন সিংহ জমানায় কিছুটা প্যারাসুটে চেপে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন রাহুল-ঘনিষ্ঠেরা। ফলে ‘নেতা’ হিসেবে রাহুলের বোঝা উচিত ছিল, কাকে কতটা দিচ্ছেন এবং তার পরিণাম কী হতে পারে। তাঁদের ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও রাহুলের আরও যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।
মিলিন্দের বাবা মুরলী ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। জিতিন প্রসাদের বাবা জিতেন্দ্র প্রসাদ ছিলেন প্রয়াত দুই প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং পিভি নরসিংহ রাওয়ের ‘রাজনৈতিক পরামর্শদাতা’। পাশাপাশি তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সহ-সভাপতি। জ্যোতিরাদিত্যের বাবা মাধবরাও শিন্ডে ছিলেন কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী। বিজেপিতে যাওয়ার পর তাঁকে কেন্দ্রে ওই মন্ত্রকেরই দায়িত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। আরপিএন সিংহের বাবা অধুনা প্রয়াত সিপিএন সিংহ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। যিনি এখনও কংগ্রেসে টিকে রয়েছেন, সেই সচিনের বাবা রাজেশও ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ঘটনাপরম্পরা বলছে, এই পাঁচ তরুণ নেতার কেউই নিচুতলা থেকে রাজনীতি করতে করতে উপরে ওঠেননি। বাবাদের ভাগ্যে এবং হাইকম্যান্ডের সঙ্গে সমীকরণের ফলে ক্ষমতার বৃত্তে সহজে ঢুকে পড়ার কারণে দল, আদর্শ ইত্যাদি কাজ করেনি।
তবে এর পাল্টা যুক্তিও আছে। যেখানে বলা হচ্ছে, ২০১৪ সাল থেকে কংগ্রেস টানা ক্ষমতার বাইরে। কেন এই সময়ে ‘রাহুল ব্রিগেড’-এর নেতাদের সেই মতো ‘শেখানো-পড়ানো’ হল না। কেন তাঁরা চলে যাচ্ছেন, তা খুঁজে বার করাও রাহুলদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শুধু যে তরুণ বা কিছু না করেই ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যাওয়া নেতারাই কংগ্রেস ছেড়েছেন বা ছাড়ছেন তা নয়। তালিকায় কপিল সিব্বল, গুলাম নবি আজাদের মতো প্রবীণ ও পোড়খাওয়া নেতারাও রয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, জ্যোতিরাদিত্য যে কারণে দল ছেড়েছিলেন বা সচিন যে কারণে বিরক্ত, তার অন্যতম কারণ নিজেদের রাজ্যে প্রবীণদের সঙ্গে তাঁদের লড়াই। রাজস্থানে সচিনের লড়াই গহলৌতের সঙ্গে। মধ্যপ্রদেশে জ্যোতিরাদিত্যের লড়াই ছিল কমল নাথের সঙ্গে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতোই মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসেও নেতাদের আকচাআকচি নতুন নয়। অতীতে সুরেশ পচৌরি, দিগ্বিজয় সিংহ, কমল নাথদের দ্বন্দ্বে অনেক উথালপাথাল হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে বিজেপিকে সরিয়ে কংগ্রেস সরকার গড়লেও ভোপালের গদি সুরক্ষিত থাকেনি জ্যোতিরাদিত্যের জন্যই। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বিধায়কদের মধ্যে তাঁর প্রভাব কতটা।
অনেকেরই বক্তব্য, রাহুল ‘টিম’ তৈরি করলেও ‘ড্রেসিংরুম’-এর পরিবেশ ঠিক রাখতে পারেননি। ফলে ক্রমক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস এখন এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল যখন ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র দ্বিতীয় পর্ব শুরু করলেন, তখন দলে ক্রমাগত ‘ভাঙনের জয়গান’ কংগ্রেসের জন্য যে খুব ‘ইতিবাচক’ নয়, তা নিয়ে কংগ্রেসের নেতাদেরও খুব একটা সন্দেহ নেই। তাঁদের আশঙ্কা, এই ভাঙনের ছাপ লোকসভা নির্বাচনে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। যার ফলে শাসক বিজেপিকে আরও বেশি শক্তিধর মনে হতে পারে। যে লড়াই সমানে-সমানে হওয়ার কথা ছিল, তা ক্রমশই একপেশে দেখাচ্ছে কংগ্রেসের দিশা এবং নেতৃত্বহীনতার জন্য।