বাগ্মী হিসাবে সুনাম রয়েছে মোদীর। ফাইল চিত্র।
বাগ্মী হিসাবে সুনাম রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। বক্তৃতার ধাঁচে নিয়মিত বদলও আনেন তিনি। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তিনি যে ভাবে বলতেন, তা বদলে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। তাঁকে ‘প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ ঘোষণার পর থেকেই নিজের বক্তব্যে আমূল বদল এনেছিলেন মোদী। তখনই কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, সেই বক্তৃতা কারা লেখেন। বিজেপির তরফে অবশ্য কোনও সদুত্তর তখন পাওয়া যায়নি।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর গত আট বছরেও মোদীর বক্তৃতায় অনেক বদল এসেছে। প্রতি দিনই তিনি কোথাও না কোথাও, কোনও না কোনও কর্মসূচিতে ভাষণ দেন। আবার প্রশাসনিক বৈঠকেও তাঁকে বক্তৃতা করতে হয়। দলের সাংসদের নিয়ে বৈঠকে যেমন বলেন, রাজনৈতিক সভায় তেমন বলেন না। রাজনৈতিক বক্তৃতাও নির্ভর করে কোন রাজ্যে বলছেন, তার উপর। বিষয় এবং বক্তৃতার ভঙ্গি সেই অনুয়াযী বেছে নেওয়া হয়। কোনও রাজ্যের কোন অঞ্চলে সভা, তার উপরও নির্ভর করে বক্তৃতার বিষয়। স্থান-কাল বদলালে বিভিন্ন বিষয় ঢোকাতে হয় ভাষণে। স্থানীয় রাজনীতি, স্থানীয় সমস্যা, স্থানীয় সংস্কৃতি, ভাষা— সবই খেয়াল রাখতে হয়।
কিন্তু এ সব কিছু মোদীর মতো ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সম্ভবপর নয়। জনপ্রিয় জনশ্রুতি হল—হয় মোদীর বক্তৃতা তৈরি করে একটি গোটা দল। কারা রয়েছেন সেই দলে? কত পারিশ্রমিকই বা পান তাঁরা?
এমন অনেক প্রশ্ন-সহ বছর খানেক আগে তথ্য জানার অধিকার আইনে একটি সংস্থা আবেদন করেছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। সেই আর্জির জবাবে তত খোলসা করে কিছু বলা হয়নি। জানানো হয়েছে, কোন ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য বক্তব্য, তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ব্যক্তি, সরকারি কর্তা, দফতর এবং সংস্থা ভাষণ তৈরিতে সাহায্য করে। তবে সকলেই তথ্য দিয়ে থাকে। মূল বক্তব্যের চূড়ান্ত রূপ দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তবে এ সবের জন্য খরচের পরিমাণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি।
অতীতে ভারতের অনেক প্রধানমন্ত্রীই ‘বাগ্মী’ বলে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে মোদীর ঠিক আগের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সেই তুলনায় আসবেন না। মনমোহন কম কথায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর তুলনায় অনেক সরব মোদী। শুধু তা-ই নয়, মোদীর প্রতিটি বক্তৃতাই অত্যন্ত সচেতন ও সুচারু ভাবে তৈরি করা। স্থান, কাল এবং বিষয় হিসাবে ব্যবহার করা হয় মনীষীদের উক্তিও।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও বক্তৃতা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। অনেক সময় দিতেন প্রতিটি ভাষণ তৈরির জন্য। অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করে আগে লিখে নিয়ে পরে বলতেন। সতর্ক ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীও। দেশের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও একই পথ নিতেন। এঁদের বক্তৃতা কারা লিখতেন বা লিখতে সাহায্য করতেন, তা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানা না গেলেও শোনা যায়, বাজপেয়ীর অনেক বক্তৃতা লেখায় বড় ভূমিকা থাকত প্রাক্তন সাংবাদিক সুধীন্দ্র কুলকার্নির। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ‘ডিরেক্টর’ পদে ছিলেন। একই ভাবে মনমোহনের বক্তৃতা লেখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন তাঁর তৎকালীন ‘মিডিয়া উপদেষ্টা’ সঞ্জয় বারু। ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে যে কাজটি করতেন এইচ ওয়াই সারদা প্রসাদ। মোদীর ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও এক জনের নাম জানা যায় না।
আমেরিকায় প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা লেখার জন্য আলাদা নিয়োগ হয়। রুজভেল্ট, কেনেডি, নিক্সন, রেগন, ক্লিন্টন, ওবামা থেকে ট্রাম্প— সকলেরই আলাদা বক্তৃতালেখক ছিলেন। জো বাইডেন শপথ নেওয়ার পর প্রথম বক্তৃতা তৈরি করতে একটি আলাদা ‘টিম’ তৈরি করেছিলেন। তার সদস্য ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিনয় রেড্ডি।
মোদীর বক্তৃতা লেখার ক্ষেত্রে সরাসরি না হলেও প্রতিটি রাজ্য বিজেপিকেও উদ্যোগ নিতে হয়। গেরুয়া শিবির সূত্রের খবর, কোনও রাজ্যে মোদীর সফরের আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বক্তৃতার বিষয় সম্পর্কে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। স্থান ও বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞ কোনও নেতা প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পান। সেই মতো তাঁকে তথ্য সরবরাহ করতে হয়। আবার আঞ্চলিক ভাষায় মোদী কী বলতে চান, সেটা জেনে বক্তব্যের সেই অংশ দেবনাগরী হরফেও লিখে পাঠাতে হয়। তবে গোটা বিষয়টাই বিজেপি গোপনীয়তার সঙ্গে করে। অনেক সময়েই মোদী লিখিত বক্তৃতা টেলিপ্রম্পটার দেখে বলেন। আঞ্চলিক ভাষায় কিছু বলতে হলে তো অবশ্যই।