(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) চালু হয়ে গেল ভারতে। জল্পনা ছিলই, সোমবার তাই সত্যি করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার লোকসভা নির্বাচনের আগেই সিএএ কার্যকরের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিল। এই সিএএ নিয়ে দেশবাসীর অনেকের কাছেই এখনও ধারণা স্পষ্ট নয়।
এক নজরে জেনে নেওয়া যাক সিএএ কী?
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের জন্য এ দেশে আসা শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই দেশগুলি থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি সিএএ-তে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এই আইনে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ ওই ছয় সম্প্রদায় ছাড়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা অন্য কোনও দেশ থেকে আসা অন্য কোনও সম্প্রদায়ের শরণার্থীকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
কী ভাবে সিএএ থেকে সুবিধা পাবেন পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আগত শরণার্থীরা? আইন অনুযায়ী, ভিসা বা পাসপোর্টের মতো নথি না থাকলেও ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছিল, নাগরিকত্ব পেতে টানা এক বছর ভারতে থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সংশোধনী আইনে সেই ১১ বছরের সময়কাল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেই মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হবে। সেই মতোই সংশোধনী বিল আনে কেন্দ্র সরকার। লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায় সেই বিল। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিলে সই করেন। যদিও কেন্দ্রের সিএএ মানতে নারাজ বিরোধীরা। সিএএ কার্যকর করা নিয়ে দীর্ঘ দিন কেন্দ্র সরকারের মধ্যেই টালবাহানা চলছে। অন্য দিকে, করোনা পর্বের আগে থেকেই দেশের নানা প্রান্তে সিএএ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। বিজেপি বিরোধী দলগুলিই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সিএএ কার্যকরের বিরোধী।
সিএএ নিয়ে কেন আপত্তি বিরোধীদের? উত্তর-পূর্ব ভারত থেকেই মূলত আপত্তি উঠেছিল সিএএ নিয়ে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সিএএ কার্যকর হলে শরণার্থীদের ব্যাপক ভিড় বৃদ্ধি পাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। তার ফলে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত সমস্যা প্রকট হতে পারে। নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই অনেকে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। পাশাপাশি আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ ভারতে সিএএ বিরোধিতার মূল কারণ, কেন তামিলদের উদ্বাস্তুদের বাদ দেওয়া হল?
সেই সঙ্গে সিএএ-র ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যাঁরা অসমে এসেছেন এবং থেকে গিয়েছেন তাঁদের সকলকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তা নিয়েই আপত্তি তোলেন অসমের আদি বাসিন্দারা। সিএএ-র প্রতিবাদে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ ও অশান্তিতে ৮৩ জনের মৃত্যু হয়। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, অসমের মতো বেশ কিছু রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে।
সিএএ বাতিল আন্দোলনের অন্যতম মুখ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বরাবর সিএএ নিয়ে বিরোধিতা করে আসছেন। তাঁর কথায়, নাগরিকত্ব দেওয়াই যদি কেন্দ্র সরকারের আসল লক্ষ্য হয় তবে নতুন আইনের প্রয়োজন কেন পড়ছে? পাশাপাশি, আইনে মুসলিমদের বাদ দেওয়া নিয়েও আপত্তি তাঁর। মমতার কথায়, এ ভাবেই ‘নাগরিকত্ব’ কেড়ে নেওয়া হবে? বিরোধীদের দাবি, সিএএ ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতি বিরোধী। এই আইনের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ‘বৈষম্য’ সৃষ্টি করছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারের মতো দেশগুলিকে কেন বাদ দেওয়া হল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। যদিও মোদী সরকার বিরোধীদের সব অবিযোগ নাকচ করে দিয়ে দাবি করেছে, এই আইন চালু হলে কোনও ভাবেই ভারতের কোনও নাগরিকের উপর প্রভাব ফেলবে না।