—প্রতীকী চিত্র।
কোয়াড কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে এবং নয়াদিল্লির গুরুত্ব কমছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় দফায় তলে তলে জমাট বাঁধছে এই অবধারিত আশঙ্কা।
সরকারি রিপোর্টে ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তির্যক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন। খলিস্তানপন্থী নেতা গুরপতওয়ন্ত সিংহ পন্নুনকে হত্যার চেষ্টা এবং তাতে ভারতের সংযোগের বিষয় নিয়ে চাপও বাড়ানো হচ্ছে সাউথ ব্লকের উপর।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় দফায় মোদীকে আরও বেশি ঝড়বৃষ্টি পোয়াতে হবে আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পতাকা ওড়ানোর ক্ষেত্রে। কারণ, বেশ কিছু দিন চাপা থাকার পর এই প্রশ্নটি আর এড়ানো যাচ্ছে না যে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক নেতৃত্বের প্রশ্নে ভারত কি ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে আমেরিকার কাছে? কারণ, বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলে চিনের একাধিপত্য মোকাবিলা করার জন্য সক্রিয় গোষ্ঠী এইউকেইউএস (আকুস) অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা-ব্রিটেনের গোষ্ঠীতে সংযুক্ত করা হয়নি ভারতকে। সম্প্রতি জাপানকে সেখানে নেওয়া হলেও, ভারত এখনও দরজার বাইরে।
পাশাপাশি বহু ঢাকঢোল পেটানো চতুর্দেশীয় গোষ্ঠী ‘কোয়াড’-এর হতশ্রী অবস্থা। মোদী সরকার চলতি বছরের গোড়ায় প্রজাতন্ত্র দিবসের কাছাকাছি সময়ে ‘কোয়া়ড’ সম্মেলন করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। জি ২০ বাদ্যির রেশ ধরেই ‘কোয়াড’ সম্মেলন ভারতে করা গেলে লোকসভা ভোটে নয়াদিল্লির তৎকালীন ‘বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে সুবিধা হত—এমনই ভাবছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আসতে অস্বীকার করেন। এমনকি, গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় কোয়াডের শীর্ষ সম্মেলনেও তিনি যাননি, ফলে বৈঠকটিই ভেস্তে গিয়েছে। নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ফলে এই বছর কথামতো ভারতে ‘কোয়াড’ হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। অথচ, ‘আকুস’-এর সক্রিয়তা লক্ষণীয়।
আমেরিকার এই ঔদাসীন্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে আরএসএস তথা সংঘপরিবারের মধ্যে থেকেও। রাম মাধব প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘জো বাইডেনের অস্ট্রেলিয়ার কোয়াড সম্মেলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া এবং জানুয়ারিতে ভারত সফরে রাজি না হওয়ায় এই সন্দেহ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে আমেরিকার নেতৃত্ব কোয়াড ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করছে। অন্য দিকে, আকুস দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সমুদ্র অঞ্চলে তাদের কৌশলগত স্বার্থকে জোরদার করছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, আকুসের জয়যাত্রার কথা। অথচ ওই শ্বেতপত্রে নামমাত্র উল্লেখ নেই কোয়াড-এর।’’
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, চিনের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ভারতের নম্বর ক্রমশই কমছে পশ্চিম বিশ্বের কাছে। ‘কোয়াড’কে গুরুত্বহীন করে ‘আকুস’-এ জাপানকে সঙ্গে নেওয়া এবং ভারতের আবেদন কার্যত খারিজ করে দেওয়া, এ কথাই প্রমাণ করছে।
সম্প্রতি আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রকের সহ সচিব কার্ট ক্যাম্পবেল জানিয়েছেন, জাপানকে ‘আকুস’-এর ‘কারিগরি অংশীশিদার’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাপানকে এই গোষ্ঠীতে সঙ্গে রাখলে চিনের রক্তচাপ যে বাড়বে তা বিলক্ষণ অনুধাবন করতে পারছে ওয়াশিংটন। ইতিমধ্যে পশ্চিম এশিয়ায় হামাস এবং ইজ়রায়েল, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা। তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের সম্ভাব্য সংঘাত ঠেকানো তাদের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে ‘আকুস’-কেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের গত সাধারণ সম্মেলনে পশ্চিমের এই ঔদাসীন্য টের পেয়েছিল ভারত সরকার। বাইরের ভাবমূর্তি অবশ্য ঝাড়পোঁছ করে রাখা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। সে বারে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদকে মান্য করার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। কিন্তু হাতেগোনা কিছু দেশ এখনও কর্মসূচি কী হবে তা স্থির করে এবং সমস্ত নিয়মকানুন নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। অনন্তকাল ধরে এই ব্যবস্থা চলতে পারে না।” পশ্চিমের প্রতি তাঁর বার্তা ছিল, “আইন তখনই কার্যকর হবে, যদি তা সমস্ত দেশের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য হয়।”
‘কোয়াড’কে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া নিয়ে জানতে চাওয়ায় বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিভিন্ন চিনা অনুপ্রবেশকে সামলানো নয়দিল্লির কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দিল্লি নিজেদের লক্ষ্য স্থির রেখেছে এবং বেজিং যাতে সমুদ্রপথে সামরিক ও বাণজ্যিক একাধিপত্য না গড়ে তুলতে পারে, তার জন্য গঠনমূলক ভূমিকাও নিয়েছে। ভারতের দাবি, আমেরিকা মুক্তকণ্ঠে এ কথা বারবার স্বীকারও করছে।
নয়াদিল্লির দাবি, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন, তাই বিদেশনীতির ক্ষেত্রে কিছু শৈথিল্য এবং ধীরগতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু নয়াদিল্লিকে বাদ দিয়ে এই অঞ্চলে আমেরিকার চিন-বিরোধী অংশীদারি গড়ে ওঠা কার্যত অসম্ভব।