অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে রাসায়নিক কারখানা থেকে গ্যাস লিকের ঘটনা উস্কে দিল ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার স্মৃতি। ১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ভোরে ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কারখানা থেকে ছড়াতে শুরু করে মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস। সরকারি মতে, ওই মারণ গ্যাসে তিন হাজার ৭৮৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। যদিও বেসরকারি মতে, সেই সংখ্যাটা আরও পাঁচ গুণ বেশি। আর এমন ভয়াবহ শিল্প বিপর্যয়ের চিহ্ন আজও শরীরে-মনে বয়ে চলেছেন অনেকেই। সেই ইতিহাস ফের তাজা হয়ে উঠল বৃহস্পতিবার।
ভোপাল শহরের জনবসতির মধ্যেই ছিল ইউনিয়ন কার্বাইডের ওই রাসায়নিক কারখানা। তৈরি হত মিথাইল আইসোসায়ানেট।
২ ডিসেম্বর গভীর রাতে জমিয়ে রাখা প্রায় ৪০ মেট্রিক টন ওই মারণ গ্যাস লিক করে বেরোতে থাকে। গোটা শহর তখন ঘুমে অচেতন। রাসায়নিক ধর্ম অনুযায়ী, মিথাইল আইসোসায়ানেট ভারী গ্যাস। তাই বাতাসের নীচের স্তরেই তা জমতে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে শহরে।
কী ভাবে ঘটেছিল সে দিনের দুর্ঘটনা? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারখানায় জমিয়ে রাখা মিথাইল আইসোসায়ানেটের ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনও ভাবে জল মিশে যায়। তাতে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। ভিতরের তাপ ও চাপে ট্যাঙ্ক খুলে যায়। ব্যস! বন্দি থাকা মৃত্যুদূত বেরিয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রমাণ মেলে তার মারণ ক্ষমতার।
প্রথমে দম বন্ধ হয়ে আসা। তার পর কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের জ্বালা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। ভোপাল জুড়ে তখন মৃত্যুর তাণ্ডব চলছিল।
গ্যাস শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তেই তার প্রথম ধাক্কাতেই অসুস্থ হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। হাসপাতালে কার্যত ভিড় ভেঙে পড়ে। প্রত্যেকেই তখন বাঁচার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর গোটা শহর জুড়ে তখন হাহাকার।
মারণ গ্যাস থেকে ছাড় মেলেনি শিশু, বয়স্ক, পুরুষ বা মহিলা, কারও। তার গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি গর্ভস্থ শিশুরাও। যারা জন্মগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে অন্তত ১৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় এক মাসের মধ্যে।
অনেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। কেউ কেউ সফল হয়েছিলেন বটে। কিন্তু সে দিন ভেঙে পড়েছিল ভোপালের পরিবহণ ব্যবস্থা। ভিড়ের চাপে কেউ কেউ পদপিষ্ট হন।
এর মধ্যেই শুরু হয় উদ্ধার কাজ। গোটা শহরের অলিতেগলিতে তখন হাহাকার। বাঁচার জন্য আকুতি।
ভোপালের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ এই গ্যাস লিকের ফলে আক্রান্ত হয়েছিলেন। যা ভোপালের তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছিল।
শুধু মানুষ নয়, মিথাইল আইসোসায়ানেটের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি প্রকৃতি ও পশুপাখিও। ক্রমশ পাতা পড়ে যেতে থাকে গাছের। কোনও কোনও গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়। মৃত্যু হয় অসংখ্য পশুপাখির। জলও দূষিত হয়ে যায়।
এখানেই থেমে থাকেনি মৃত্যুর তাণ্ডব। বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস মিশেছিল বাতাসে। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল দীর্ঘদিন। দুর্ঘটনার পর, অচিরেই যেন একটা সবুজ শহর হয়ে উঠেছিল গ্যাস-চেম্বার।
গ্যাস লিকের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর শুরু হয় দুর্ঘটনার কারণ সন্ধান। অভিযোগ ওঠে, শহরের মধ্যে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক কারখানা হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলই না ইউনিয়ন কার্বাইডের ওই রাসায়নিক কারখানায়। বিপুল পরিমাণ গ্যাস ছোট ছোট সিলিন্ডারে রাখাই ছিল দস্তুর। কিন্তু তা মানা হয়নি।
বড় বড় ট্যাঙ্কে রাখা হয়েছিল ওই বিপুল পরিমাণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস। গ্যাসের তীব্রতায় পাইপলাইনই ক্ষইছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিপর্যয় মোকাবিলা দুটি ক্ষেত্রেই ছিল চরম গাফিলতি।
ভোপালের গ্যাস ট্র্যাজেডিকে অনেকেই বলেন, শিল্পের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম বিপর্যয়। ঘটনার মূল অভিযুক্ত ছিলেন ইউনিয়ন কার্বাইডের সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন। দুর্ঘটনার পর পরই এ দেশ ছেড়ে আমেরিকা পালিয়ে যান ওই মার্কিন নাগরিক। এর পর তাঁকে বিচারের জন্য এদেশে আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডায় মৃত্যু হয় তাঁর।
সে দিন অবশ্য অনেকে মৃত্যুকে হার মানিয়ে দিয়েছিলেন বটে। কিন্তু সারাজীবন ধরে বয়ে চলতে হয়েছে সেই যুদ্ধের ক্ষত। গ্যাস দুর্ঘটনার জেরে শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে পাঁচ লক্ষের বেশি মানুষ। স্থায়ী ভাবে পঙ্গুত্বের শিকার হন ৩ হাজার ৯০০ জন।
৩৬ বছর আগের সেই পুরনো ক্ষত বৃহস্পতিবার ফের টাটকা হয়ে উঠল। মারণ গ্যাসের প্রভাব এখনও বয়ে নিয়ে চলেছে ভোপাল। এ বার দেশে দ্বিতীয় উদাহরণ তৈরি হল বিশাখাপতনমে।