Pranab Mukherjee

রাষ্ট্রনায়ক এমনই হন

দুর্ভাগ্য যে, এই সঙ্কটের সময়ে দেশ এমন এক জন নেতা এবং বড় মাপের মানুষকে হারাল।

Advertisement

বেঙ্কাইয়া নায়ডু (উপরাষ্ট্রপতি)

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৬:৩৭
Share:

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রণবদার নাম আলাদা জায়গার দাবি রাখে। এমন বিদগ্ধ, প্রথম সারির রাজনীতিজ্ঞ চলে যাওয়ার পরে যে শূন্যতা তৈরি হবে, তা চট করে ভরাট হওয়ার নয়।

Advertisement

২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ অফিস (রাষ্ট্রপতির দফতর) প্রণবদা ছেড়ে আসার পরেও, বেশ কয়েক বার কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। আর প্রায় প্রতি বারই মনে হয়েছে, তিনি কার্যত বিশ্বকোষ। ওই বয়সেও চটপট বড় হিসেব কষে ফেলার ক্ষমতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। দুর্ভাগ্য যে, এই সঙ্কটের সময়ে দেশ এমন এক জন নেতা এবং বড় মাপের মানুষকে হারাল।

রাজ্যসভা পরিচালনা করতে গিয়ে কয়েক বারই কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। তখন ফোন করে সেই চাপ কাটিয়ে আমাকে সহজ করে দিয়েছেন তিনি। পরেও মাথায় গেঁথে গিয়েছে তাঁর পরামর্শ। হাউসে প্রায়ই ওঁকে উদ্ধৃত করে বলেছি, “বিতর্ক, আলোচনা হোক। তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন। সভা পণ্ড করে লাভ নেই।”

Advertisement

লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং ভি পি সিংহ ছাড়া প্রণবদাই একমাত্র রাজনীতিক, সংসদের দুই কক্ষেই (লোকসভা ও রাজ্যসভা) নেতা হিসেবে বসার বিরল সম্মান যাঁর ঝুলিতে। সংসদের যাবতীয় নিয়ম-কানুন, খুঁটিনাটি ছিল তাঁর ঠোঁটস্থ। তবে মাঝেমধ্যে বেশ চটেও যেতেন। এক বার রাজ্যসভার বিরোধী নেতা হিসেবে একটি বিষয় তুলেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। তাতে তাঁকে বেশ কড়া কথা শুনিয়েছিলেন প্রণবদা। কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আডবাণীজিকে এ ভাবে বলাটা বোধ হয় উচিত হয়নি তাঁর। প্রণবদা সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নিয়ে পরে আডবাণীজির সঙ্গে কথা বলে সেই তিক্ততা মুছে ফেলেছিলেন। বিষয়টি তাঁকে বলার জন্য ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি আমাকেও। সম্ভবত এই বিরল গুণই ছিল সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি।

১৯৬৯ সালে রাজ্যসভায় তাঁর প্রথম বার পা রাখা। ১৯৭৩ সালে প্রথম বার মন্ত্রী। সেখান থেকে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে আসা পর্যন্ত বিপুল বিস্তৃত যাত্রায় প্রণব দা দেশের আমূল পরিবর্তনের শরিক। একেবারে সাদামাঠা জীবন থেকে সাফল্যের এই শীর্ষে উত্তরণ নিছক ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকার কারণে হয়নি। বরং জ্ঞানের অফুরান ভান্ডার, জানার পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চলার চেষ্টা, বুদ্ধি, কাজ করার প্রচণ্ড দক্ষতা এবং আশপাশের মানুষকে বোঝার ক্ষমতাই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছে ওই উচ্চতায়।

প্রণবদার লাগাতার কাজ করা আর ধকল নেওয়ার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের ইউপিএ সরকারের আমলে তিনি কতগুলি মন্ত্রিগোষ্ঠী এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত মন্ত্রিগোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন, শুধু সেই সংখ্যাই বিভিন্ন দলের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বুঝতে যথেষ্ট। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য মিটিয়ে দেওয়ার দুর্লভ ক্ষমতার কারণেই ওই দায়িত্ব বর্তেছিল তাঁর উপরে। তখন নাগাড়ে তাঁর কাজ করা ও চাপ নেওয়ার ক্ষমতা আর অত কিছুর মধ্যেও প্রত্যেক কাজ নিঁখুত ভাবে করার চেষ্টা দেখে অবাক হতে হত।

সমাজে খামতি কোথায়, তা প্রণবদা জানতেন খুব ভাল করে। কিন্তু একই সঙ্গে, দেশের হাতে সব সমস্যা সমাধানের জন্য যে অফুরন্ত টাকা নেই, সেই বাস্তবও ভাল করে বুঝতেন তিনি। ১৯৮০ সালে প্রথম বার অর্থমন্ত্রী হওয়ার পরেই হাত দিয়েছিলেন সংস্কারে। দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে অসম্ভব খেটেছিলেন সেই প্রথম রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার জন্য। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ২০০৫ সালে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা-কাঠামোর চুক্তি তাঁর সই করা। একই বছরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় রাশিয়াকেও পাশে টেনেছিলেন তিনি। আবার ১৯৯৬ সালে ভারত যখন প্রথম বার আসিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির পূর্ণ সদস্য হল, তখনও বিদেশমন্ত্রী সেই প্রণব দা-ই।

এত দক্ষতা থাকার কারণেই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটা সুপ্ত লক্ষ্য প্রণবদা-র মধ্যে ছিল। দু’- দু’বার তার খুব কাছেও চলে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তিনি নিজের মতো করে তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন। দেশে জরুরি অবস্থা জারির সময়ে প্রণবদা-র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলার জায়গা আছে। কিন্তু তাঁর জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, সাংস্কৃতিক পরম্পরার বিষয়ে দখল এবং সর্বোপরি দেশমাতৃকাকে ভালবাসার প্রবল জাতীয়তাবোধের কারণেই প্রণবদাকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসানো যায়। দেশের বহুত্ববাদ এবং বিবিধতার দর্শনে তাঁর আস্থা ছিল অটুট।

অনেকের কথায় কান না-দিয়েই দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১৮ সালে নাগপুরে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়েছিলেন প্রণবদা। সেখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন শান্তি এবং সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার মন্ত্রকে মাথায় রেখে। যা ভারতের মূল দর্শন। বলেছিলেন, এ দেশে জাতীয়তাবাদের ধারার উৎস সংবিধান। তাই কাউকে বাইরে রাখা, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা কিংবা কোনও কিছুকে ধ্বংস করা সেই জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় স্বীকৃত নয়। রাষ্ট্রনায়ক তো এমনই হন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement