গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
তিনটি বিষয়। কিন্তু বিভ্রান্তি-বিতর্ক-ধোঁয়াশা বহু। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)— কেউ বলছেন, তিনটি আলাদা বিষয়। কারও মত, একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সব বিভ্রান্তি দূর করা যাঁদের দায়িত্ব, সেই কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি নেতৃত্ব যেন আরও অস্পষ্টতা বাড়িয়ে চলেছেন। বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, ইচ্ছে করেই এই ধোঁয়াশা-বিভ্রান্তি জিইয়ে রাখা হচ্ছে।
রাজনীতির এই দড়ি টানাটানির মাঝে পড়ে সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত বিভ্রান্ত। কোনটার সঙ্গে কার যোগ, কোনটা দরকারি, কোনটা নয়— সে সব বাছবিচার করতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। কখনও ছুটছেন এনআরসির জন্য নথি জোগাড় করতে। কখনও বা সিএএ অনুযায়ী নাগরিক হতে কী কী লাগবে— এ সব হাজারো প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।
বিভ্রান্তি যে কতটা, তার নজির ভূরিভূরি। অমিত শাহ এক সময় বললেন, আধার, ভোটার, পাসপোর্ট— এ সব কোনওটাই নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। আবার তিনিই অন্য সময় বলছেন, রেশন কার্ড না থাকলেও সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে কোনও সমস্যা হবে না। সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলেছেন, সারা দেশে এনআরসি হবে। আবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন, সরকারি ভাবে এনআরসি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। পরে আবার অমিত শাহও ঘুরে গিয়ে বলছেন, মোদী ঠিকই বলেছেন। এখানেই শেষ নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নথি এবং সরকারি বক্তব্যেও বিভ্রান্তির ছড়াছড়ি।
অমিত শাহ সম্প্রতি বলেছেন, এনপিআর-এর সঙ্গে এনআরসির কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হরিভাই পি চৌধুরী বলেছিলেন, এনপিআর-এর তথ্য এনআরসির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আবার ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ এর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বার্ষিক রিপোর্টের বক্তব্যও আলাদা। ১৭-১৮ সালে এনপিআর আপডেট করার কথা বলা হলেও এনআরসির কথা বলা হয়নি। কিন্তু পরের বছরের রিপোর্টে বলা হল, এনআরসি তৈরির প্রথম ধাপ হল এনপিআর।
এনআরসির সঙ্গেই সম্পর্কিত ডিটেনশন ক্যাম্প। নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়লে তাঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হয়। এ নিয়েও বিভ্রান্তির অন্ত নেই। অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যুর খবর এসেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদী ২২ ডিসেম্বর রামলীলা ময়দানের সভায় বললেন, ‘‘দেশের কোথাও কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই।’’ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লোকসভা ভোটের প্রচারে অসমে গিয়ে এই মোদীই আবার বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে রাজ্যের সব ডিটেনশন ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। যদি ডিটেনশন ক্যাম্প না-ই থাকে, তাহলে ভাঙার কথা বললেন কেন? প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
আবার ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘‘ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনও বিদেশি নাগরিকের কাছে পর্যাপ্ত নথি না থাকলে তাঁকে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে। কারণ, তাঁদের জেলে রাখা যায় না।’’ কর্নাটকেও সম্প্রতি এই রকম ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির খবর এসেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্প নয়, বিদেশি নাগরিকরা অপরাধ করলে তাঁদের রাখার জন্য ওই ক্যাম্প তৈরি হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদে পাশ হওয়ার পর আইনে পরিণত হতেই দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে অশান্তি। সেই সিএএ-এনআরসি নিয়ে নাগরিকদের একাংশের মধ্যে আতঙ্ক-বিভ্রান্তি ছিলই, মঙ্গলবার তার সঙ্গে যোগ হয় এনপিআর। এনপিআর ও আদমশুমারির জন্য বাজেট বরাদ্দে সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সব মিলিয়ে আম জনতার মধ্যে বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। অনেকেরই বক্তব্য, ‘‘একেই তিন-তিনটে বিষয়। তার উপর এক এক জনের এক এক রকম বক্তব্য, অথবা একই নেতার ভিন্ন সময়ে ভিন্ন বক্তব্যে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।’’