ফাইল চিত্র।
উত্তরপ্রদেশ ভোটে প্রথম দুই পর্বে ভোট হতে চলেছে রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে থাকা জাঠবলয় ও ব্রজভূমিতে। গোটা উত্তরপ্রদেশ জয়ে বিজেপির গলার কাঁটা ওই দুই এলাকা। তাই লখনউয়ের মসনদ ধরে রাখতে ওই এলাকায় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি। বিরোধীদের জাঠ-মুসলিম জোটের মোকাবিলায় জাঠ-ঠাকুর ও দলিত ভোটেই ভরসা করছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। অন্য দিকে বিজেপিকে ভরসা জোগাচ্ছে প্রথম পর্বের মুসলিমবহুল এলাকাগুলিতে হায়দরাবাদের আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দল এমআইএমের উপস্থিতি। এতে বিহারের মতো উত্তরপ্রদেশেও মুসলিম ভোটের বিভাজন ঘটাবে বলেই আশায় বিজেপি নেতারা।
উত্তরপ্রদেশের প্রথম দুটি পর্বে কুড়ি জেলায় মোট ১১৩টি আসনে ভোট হতে চলেছে। এর মধ্যে প্রথম পর্বে ভোট হবে বাগপত, মিরাট, মুজফ্ফরপুর, হাপুর, বুলন্দশহর, আলিগড়, মথুরা, আগরা, গাজিয়াবাদে। অন্য দিকে দ্বিতীয় পর্বে ভোট হবে বিজনৌর, আমরোহা, বরেলী, শাহজহানপুর, মোরাবাদাবাদ, বদাঁয়ূ এলাকায়। ২০১৭ সালে ওই এলাকাগুলিতে প্রতিপক্ষকে কার্যত দাঁড়াতে দেয়নি বিজেপি। ২০১৩ সালের মুজফ্ফরনগর গোষ্ঠী সংঘর্ষের ছায়ায় জাঠ ও মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে উস্কে দিয়ে, হিন্দু ভোটের মেরুকরণে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখল করে বিজেপি। কিন্তু পাঁচ বছর পরে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একে কৃষি আইনের কারণে ক্ষুব্ধ স্থানীয় জাঠ কৃষক সমাজ। উপরন্তু ফসলের ন্যূনতম দামকে আইনি স্বীকৃতি না দেওয়া, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মূল ফসল আখের দাম না পাওয়া, সারের বর্ধিত দামের কারণে বিজেপির উপরে ভরসা হারিয়েছে কৃষক সমাজ।
উল্টো দিকে পাঁচ বছর আগে তীব্র মেরুকরণের হাওয়াও অনুপস্থিত। গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের সঙ্গে জাঠেদের সম্পর্ক আগের মতোই অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে। জাঠবহুল এলাকাগুলিতে নতুন করে জনসমর্থন ফিরে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় লোক দলের নেতা জয়ন্ত চৌধুরি। পিতা অজিত সিংহের গত মে মাসে মৃত্যুর ঘটনায় এক দিকে তাঁর প্রতি যেমন সহানুভূতির হাওয়া রয়েছে তেমনই গোড়া থেকেই কৃষি আইনের তীব্র বিরোধিতা, নিয়মিত কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন ও সাহায্য করে যাওয়া, খাপ পঞ্চায়েতগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা কৃষক তথা জাঠ সমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে জয়ন্তের। আরএলডি নেতা জয়ন্ত এ বার হাত মিলিয়েছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সঙ্গে। পরিকল্পনা হল, আরএলডির জাঠ ভোট ও এসপির মুসলিম ভোটকে এক ছাতার তলায় এনে বিজেপি প্রার্থীকে হারানো। মূলত বিজেপি-বিরোধী ভোট যাতে বিভাজিত না হয় সেই লক্ষ্যেই ওই উদ্যোগ নিয়েছেন অখিলশ।
পরিস্থিতি যে কঠিন তা ঘরোয়া ভাবে মেনে নিচ্ছেন বিজেপি নেতারাও। এক শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতার মতে, “মূলত চারশো আসনের মধ্যে প্রথম পর্বের ১১৩টি আসন ঠিক করবে ক্ষমতায় কারা আসতে চলেছে। “মেরুকরণের হাওয়া উধাও, উপরন্তু দেরি করে আইন প্রত্যাহারে কৃষক সমাজের বড় অংশ যে সরে গিয়েছেন তা বুঝতে পারছেন বিজেপি নেতারা। এই পরিস্থিতিতে দুই পর্বে ভাল ফল করতে জাঠ-ঠাকুর-দলিত সমীকরণের ভরসা করতে চান বিজেপি নেতৃত্ব। তাঁরা মনে করছেন, ভোটের আগে যদি ওই সমীকরণ বিজেপির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে তাহলে বিরোধী ভোটব্যাঙ্কের বিভাজনের সূত্রে আসন ছিনিয়ে নেবে বিজেপি। তাই দলিত নেত্রী বেবিরানি মৌর্য, ঠাকুর নেতা জয়বীর সিংহ ও জাঠ নেতা সাহেন্দ্র সিংহ রামালা-এই ত্রয়ীর উপরে ভরসা করছে দল।
গত দুটি লোকসভা ও পাঁচ বছর আগে হওয়া বিধানসভাতেও জাতপাতের ছক ভেঙে রাজ্যের দলিত ভোটকে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন অমিত শাহেরা। এ বারে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও, উত্তরপ্রদেশ জিততে দলিত ভোটেই আস্থা রাখতে চাইছে বিজেপি। সেই কারণে জাটভ শ্রেণির বেবিরানি মৌর্যকে প্রার্থী করা হয়েছে আগরা থেকে। জাটভেরা রাজ্যের মোট দলিতদের অর্ধেক। অতীতে জাটভেরা বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর মূল ভোটব্যাঙ্ক ছিলেন। সম্প্রতি দলিত ও ওবিসি নেতার দলত্যাগের ঘটনায় কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় এক নেতার যুক্তি, ‘‘দলত্যাগ কিছু প্রভাব ফেললেও, আমাদের দ্বিতীয় সারির দলিত নেতাদের ফৌজ প্রস্তুত রয়েছে।’’ জাঠ ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে এ যাত্রায় বাগপত জেলার ছাপরৌলি বিধায়ক সাহেন্দ্র সিংহ রামালার উপরে ভরসা করেছে দল। ২০১৭ সালে বিজেপির প্রবল হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র আরএলডি বিধায়ক হিসেবে তিনি জিতে এসেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি আরএলডি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। প্রথম পর্বে ভোটে যাওয়া বাগপত ছাড়াও সংলগ্ন শ্যামলী, মিরাট, বুলন্দশহর, হাপুরের মতো জেলাগুলিতে জনসমর্থন রয়েছে রামালার। তাঁর হাত ধরেই জাঠ ভোটকে পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে বিজেপি। অন্য দিকে আলিগড়ের ঠাকুর নেতা হলেন জয়বীর সিংহ। দীর্ঘ দিনের ওই ঠাকুর নেতা যোগী আদিত্যনাথ ঘনিষ্ঠ এবং স্থানীয় ঠাকুর সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা। প্রথম পর্বের আলিগড়, বুলন্দশহর ছাড়াও দ্বিতীয় পর্বের শম্বল, বদাঁয়ূ, আমরোহার মতো জেলায় ভাল জনভিত্তি রয়েছে জয়বীরের। বিজেপির দাবি, প্রথম দুটি পর্বে বিরোধীদের জাঠ ও মুসলিম ভোটের জবাবে জাঠ-ঠাকুর-দলিত ভোট এক জায়গায় নিয় আসাই লক্ষ্য।
প্রথম দুই পর্বে ভোটে দাঁড়িয়েছে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দল এমআইএম। বিরোধীদের মতে, মূলত বিজেপি বিরোধী মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে বিভাজন ঘটিয়ে যোগী আদিত্যনাথকে সুবিধা করে দিতেই উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী দিচ্ছেন ওয়েইসি। রাজনীতিকদের মতে, বিহারের ভোটে প্রার্থী দিয়ে নীতীশ কুমারদের জিততে সাহায্য করেছিলেন ওয়েইসি। এ ক্ষেত্রেও সেই কারণে বি টিমকে মাঠে নামিয়েছে বিজেপি বলে বিরোধীদের অভিযোগ।