সনিষ্ঠ: রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, উপেন্দ্রকিশোরের লেখা অনুবাদ করেন উইলিয়াম রাদিচে। —ফাইল চিত্র।
গত ১০ নভেম্বর উইলিয়াম রাদিচের প্রয়াণে বাংলা এক প্রিয় বন্ধুকে হারাল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে প্রগাঢ় প্রেম তা এক প্রকার নিয়তি-নির্ধারিতই ছিল। ১৯৫১-র লন্ডনে উইলিয়ামের জন্ম, মৃত্যু হল ২০২৪-এর কেমব্রিজে। ওঁর মা বেটি রাদিচে ছিলেন ধ্রুপদী সাহিত্যের বিশারদ, অনুবাদক, পেঙ্গুইন ক্লাসিকস-এর সম্পাদক। আপন ভাষাতাত্ত্বিক প্রতিভা ও অনুবাদ-দক্ষতা তিনি চারিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের মধ্যে।
তাঁর সময়ের অনেক ইংরেজ নারী-পুরুষের মতোই, উইলিয়ামও অল্পবয়স থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হন। সরকারি ইস্কুলে পড়াশোনা শেষে অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আসেন। ছ’সপ্তাহ যেতে না যেতেই একটা কাণ্ড হল, ভারতের প্রতি ওঁর আকর্ষণ ওঁকে টেনে নিয়ে এল এই উপমহাদেশে। গোড়ায় হিমাচলপ্রদেশের সানাওয়ারে লরেন্স স্কুলে পড়াতেন। গানবাজনায় আগ্রহ ছিল, পিয়ানো বাজাতেন দারুণ, ভারতে এসে সরোদে নাড়া বাঁধলেন। আর যে মাসোহারা পেতেন তা নিয়ে বেরোলেন ভারতভ্রমণে, দিল্লি হয়ে শেষে কলকাতা। সত্যজিৎ রায়ের ছবির ভক্ত ছিলেন আগেই, এ বার ইচ্ছে হল রবীন্দ্রনাথকে পড়ার, মূল বাংলায়।
ইংল্যান্ডে ফিরে অক্সফোর্ডের পড়াশোনা শেষ করলেন, বার করলেন ওঁর প্রথম কবিতার বই এইট সেকশনস (১৯৭৫)। বাংলা ভাষা শেখার ইচ্ছেটা কিন্তু মনের মধ্যে নিষ্কম্প মোমের মতো জ্বলছিলই। মাকে যখন বললেন তিনি বাংলা শিখতে চান, মা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন কার কাছে ছেলেকে পাঠাতে হবে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ় (সোয়াস)-এ বাংলা পড়াতেন তারাপদ মুখোপাধ্যায়, তিনি তো উইলিয়ামকে দেখে অবাক। এই ইংরেজ তরুণ কেবল বাংলা পড়া নিয়েই নয়, দক্ষ ভাবে বাংলা বলতে পারা নিয়েও স্থিরলক্ষ্য, ‘সিরিয়াস’। বাংলা ভাষার সঙ্গে ওঁর প্রেমপর্ব শুরু হল এ ভাবেই, প্রগাঢ় আন্তরিকতায়— প্রথমে কলকাতা তথা এই বাংলা এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের প্রতিও তৈরি হল একট গভীর সংরাগ।
অক্সফোর্ড থেকে ডি ফিল ডিগ্রি পাওয়ার পর উইলিয়াম সোয়াস-এ সিনিয়র লেকচারার হন। তিনি ছিলেন এক চমৎকার কবি, ন’টা কাব্যগ্রন্থ রয়েছে ওঁর। ওঁর কবিতায় উঠে এসেছে ঘটমান বর্তমান— ওঁর বন্ধুবান্ধব থেকে সহকর্মীরা, সোয়াস-এর নানা অনুষ্ঠান ইত্যাদি। প্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ— ওঁর জীবনের ধ্রুবতারা।
উইলিয়ামকে আমি প্রথম দেখি কলকাতায়, বাঁশদ্রোণী বাজারে এক আলুবিক্রেতার সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরায় রত। আমার রাঁধুনি তো তা দেখে স্তম্ভিত: লম্বা এক সাহেব— চার পাশের অগণিত মানুষের মধ্যে যাঁকে আলাদা করে চোখে পড়বেই— এমন অনায়াস আর চমৎকার বাংলায় কথা বলে যাচ্ছেন! উইলিয়াম কলকাতা আসতেন নিয়মিত, থাকতেন বন্ধুবান্ধবদের কাছে, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র ভবনে কাজ করতেন মন দিয়ে।
বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওঁর গবেষণা ও নিষ্ঠার ফসল ফলল ১৯৮৫ সালে, পেঙ্গুইন বুকস থেকে প্রকাশিত ওঁর রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ সিলেক্টেড পোয়েমস-এর প্রকাশে। মার্টিন কেম্পশেনের মতে, রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এই বই প্রকাশ ছিল এক সন্ধিক্ষণ— সারা বিশ্ব দেখতে পেল এক জন ইংরেজের মূল বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের আন্তরিক আগ্রহ ও সামর্থ্য। উইলিয়ামের হাতে একে একে অনূদিত হল আরও রবীন্দ্র-রচনা: সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ় (১৯৯১), পার্টিকলস, জটিংস, স্পার্কস: দ্য কালেক্টেড ব্রিফ পোয়েমস (২০০১); নাটকও: দ্য পোস্ট অফিস (২০০৮, ডাকঘর), কার্ড কান্ট্রি (২০০৮, তাসের দেশ) এবং ‘দেবতার গ্রাস’-এরও অনুবাদ ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’— পরম বীরের সুরসঙ্গতে যে লিব্রেটো হয়ে উঠেছিল দারুণ এক কীর্তি। উইলিয়ামের সবচেয়ে বড় কাজ ওঁর অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি (২০১১, ইংরেজি নামটিও তা-ই, রবীন্দ্রসাধর্শতবর্ষে প্রকাশিত)। মূল বাংলায় রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানা ফর্ম— গীতিনাট্য, সনেট, গান ইত্যাদিও তিনি অনুবাদে ধরেছিলেন পরম নিষ্ঠায়, পৌঁছেছিলেন মূলের ছন্দ-কাঠামো, অনুবৃত্তি ও স্তবক-বিন্যাসের যতটা কাছে পৌঁছনো যায় সেই নৈকট্যে। লিখেছিলেন ‘গীতাঞ্জলি রিবর্ন’ শিরোনামে এক আলো-করা মুখবন্ধ, এমনই ঝরঝরে যে ১৯৮৩ সালে জেমস টালারোভক এবং ১৯৯৮-এ জো উইন্টারের করা অনুবাদের পর গীতাঞ্জলি-র আর একখানা উপযুক্ত অনুবাদ পেলাম আমরা, তা নিয়ে সংশয় রইল না কোনও।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য অনুবাদ করেছিলেন উইলিয়াম— দ্য পোয়েম অব দ্য কিলিং অব মেঘনাদ (২০১০)। মূলের প্রতি পূর্ণ সুবিচার করেছিল এই অনুবাদকাজটিও। পড়লে বোঝা যায়, বাংলা সাহিত্যের ভাষা ও ফর্ম-কেও কী ভাবে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি।
অন্য অনেক সফল অনুবাদকের মতোই, উইলিয়ামের পাঠকদের মধ্যেও আছে অনুরাগী ও নিন্দক দুই-ই। উইলিয়াম নিজেই বলেছিলেন, ‘নেটিভ’ বাংলাভাষীর মতো মূল বাংলা ভাষার সাগরে অনায়াসে সাঁতারের ক্ষমতা তাঁর না থাকতে পারে, কিন্তু এক জন ইংরেজ হিসাবে দেখলে অন্তত তাঁর শুকনো ডাঙায় এসে ওঠার আর সেখানেই ফুলেফলে বেড়ে ওঠার আত্মবিশ্বাসটুকু আছে। শুকনো ডাঙা মানে এখানে ইংরেজি, যে ভাষায় তিনি অনুবাদ করেন। হ্যাঁ, কখনওসখনও তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিগুলো তাঁকে অন্য সব পথে-বিপথেও নিয়ে যায় বটে, ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গানের মতো প্রবল বাতাসে পালও তুলে দেন তিনি। কিন্তু ওই গানেরই অসমসাহসী নেয়ের মতো, শক্তিধর কবিতার মুখোমুখি হয়ে তিনি তার তারিফও করেন, আর তাঁর পাঠকেরা তাঁর অনুবাদ-সৃষ্টির সর্বজনীন আবেদনে হয়ে পড়েন বিমোহিত।
বাংলা শিশুসাহিত্যও ছিল তাঁর কাছের। অনুবাদে তাকেও তিনি নিয়ে এসেছিলেন ইংরেজির পরিসরে। অনুবাদ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা টুনটুনির বই (দ্য টেলর বার্ড’স বুক) আর বোকা বাঘ (দ্য স্টুপিড টাইগার, ১৯৮১)।
ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিলই ওঁর সঙ্গে। আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন স্কটল্যান্ডে, ঘর-ভর্তি দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন পাঠে, বক্তৃতায়। লন্ডন, দিল্লি, শিমলা, এডিনবরা— কত জায়গায় কত সভা, সম্মেলনে আমরা এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছি! উইলিয়াম ও তাঁর সর্বসহায়িকা স্ত্রী এলিজ়াবেথের উষ্ণ আতিথেয়তার পরশ পেয়েছি নর্থাম্বারল্যান্ডের রাইডিং মিল-এ ওঁদের সুন্দর বাড়িটিতে। লন্ডনে উইলিয়ামের ফ্ল্যাটে, সোয়াস-এ ওঁর অফিসে বসেও কত কথা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে! ওঁর বিরাট সহৃদয়তার পরিচয় পেয়েছি, যখন তিনি স্কটিশ সেন্টার অব টেগোর স্টাডিজ় (স্কটস)-এর ‘পেট্রন’-এর ভূমিকা গ্রহণ করলেন, ওঁর ব্যক্তিগত রবীন্দ্র-সংগ্রহ দান করে দিলেন স্কটস-কে। এডিনবরা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরির ‘স্পেশাল কালেকশনস’-এ সংরক্ষিত ওঁর সেই সংগ্রহ, গবেষক পাঠকদের জন্য।
২০১৩ সালে উইলিয়ামের একটা গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে, সেরেও উঠেছিলেন তা থেকে। দীর্ঘ একটা সময় তিনি ছিলেন অচেতন, এলিজ়াবেথ সেই সময় ওঁকে জাগিয়ে তোলার জন্য ক্লাসিক্যাল মিউজ়িক বাজাতেন। চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছিলেন অ্যাকাডেমিক কাজে না ফিরতে। তবে তাঁর কবিতা লেখায় ছেদ পড়েনি। একেবারে শেষ বয়সে তিনি একটা নতুন জঁর-ও আবিষ্কার করেছিলেন, আমার মতে যা ‘ডায়েরি পোয়েম’। সেখানে তিনি একটা বছরের সব ঘটনা লিখে গিয়েছেন ওঁর বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সবার জন্য। ২০২৩-এ আমরা সবাই খুব আনন্দ পেলাম লন্ডনে ইউকে বেঙ্গলি কনভেনশন-এ তিনি জীবনকৃতি সম্মাননা পাওয়ায়। খুব অসুস্থ থাকায় তিনি নিজে হাতে তা নিতে পারেননি, ওঁর হয়ে নিয়েছিলাম আমি।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে তাঁকে ঘিরে বিশ্বে একটা নতুন আগ্রহ জেগেছিল। আর উইলিয়ামও হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের অক্লান্ত প্রচারক— গোটা এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা ঘুরে, নতুন নতুন বক্তৃতা দিয়ে। গুরুদেব যা করেছিলেন সেই কাজটাই করেছেন তিনিও— সর্বজনীন মানববাদ দিয়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যকে পরস্পরের আরও কাছে আনা। ওঁর ব্যক্তিগত বিচক্ষণতা আর গভীরতা মিশে গিয়েছিল ওঁর রবীন্দ্র-বীক্ষার আবেগে। রবীন্দ্র-আবেদন ও পরম্পরাকে জাগরূক রাখার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারকে বিশ্বপাঠকের সামনে তুলে ধরার কাজে ওঁর যে বিরাট অবদান, সে জন্য ওঁর কাছে বাঙালি চিরকাল ঋণী থাকবে।
প্রফেসর ইমেরিটা, ইংলিশ অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ রাইটিং, এডিনবরা নেপিয়ার ইউনিভার্সিটি