জঙ্গলের ভূমিপুত্ররা একমত, ভারতীয় নেকড়ে সাধারণত মানুষকে আক্রমণের ঝুঁকি নেয় না। বরং এড়িয়ে চলে। কিন্তু এ বার বর্ষায় উত্তরপ্রদেশের বহরাইচে নেকড়ে দলের তাণ্ডব কি সেই বিশ্বাস টলিয়ে দিল? সরকারি হিসাবেই এই এলাকায় জঙ্গল ঘেরা গ্রামগুলিতে দশটি প্রাণ গিয়েছে। এক মহিলা, ন’জন শিশু! আহত ৫০-এর বেশি। গ্রামবাসীদের বয়ানের ভিত্তিতে একটি নেকড়ের পালকে এই হামলার জন্য দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ বন দফতর ‘অপারেশন ভেড়িয়া’ চালু করে পাঁচটি নেকড়েকে ধরেছে। ষষ্ঠ পশুটি মারা গিয়েছে। তার পরই ‘অপারেশন ভেড়িয়া’য় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও সাফল্য নিয়ে শোরগোল চলছে। অথচ বিজ্ঞানীদের মত, এটি কোনও বিশেষ নেকড়ে দলের কাজ হতে পারে না। একটিমাত্র র্যাবিস আক্রান্ত নেকড়ে বা অন্য পশুর উপস্থিতির কারণেও হতে পারে। কিন্তু কিছু সংবাদসংস্থা ও লোকজন সমাজমাধ্যমে মুখরোচক ভিডিয়োয় দাবি করছে, মানুষের উপর প্রতিশোধের স্পৃহা নিয়ে ঘুরছে নেকড়েরা। উত্তপ্ত বিশেষণ, ওয়্যারউলফ-এর (নেকড়ে-মানুষ) গল্প জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ফলে, সতর্কতা অবলম্বনের বদলে লাঠি হাতে চক্কর দিচ্ছেন বাসিন্দারা। শিয়াল, কুকুর যে চারপেয়েই সামনে পড়ছে, ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। পরিণামে, বনকর্মীরা আসার আগেই ষষ্ঠ নেকড়েটি গণপিটুনিতে মৃত। এমন আক্রোশে নেকড়ে সংরক্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় ধাক্কা খাবে।
ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ বা ভারতীয় ধূসর নেকড়ে ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণ (সুরক্ষা) আইন মোতাবেক এক নম্বর সারণিভুক্ত বিপন্ন প্রাণী। এত প্রাচীন নেকড়ে অন্য দেশে নেই। কিন্তু, এদের বড় জোর দু’-তিন হাজার অবশিষ্ট। কাগজে-কলমে বাঘের সমান সুরক্ষার দাবিদার হলেও সরকার এই বিপন্ন প্রজাতি নিয়ে ভাবিত নয়। অথচ, ভাবা জরুরি। কারণ, এরা অনেক সময়ই গ্রামসীমান্তের বনবাদাড়ে লুকিয়ে থাকে। চাষের প্রয়োজনে, গ্রামের পরিধি বাড়াতে এই জমিগুলোকে সাফ করলে নিজেদের বাসস্থান হারায়। অন্য দিকে, এদের খাদ্যতালিকায় আছে চিঙ্কারা, কৃষ্ণসার, খরগোশ। তারা উত্তরপ্রদেশের এই অঞ্চলে শেষ হয়ে এসেছে। তাই সেখানে পোষা ভেড়া-ছাগল খোঁজে। মানুষ কড়া পাহারা বসালে গবাদি পশুর মৃতদেহ খেতে বাধ্য হয়।
মানুষের পক্ষে এদের চেয়ে ক্ষতিকর গ্রামপালানো ফেরারি কুকুর, বুনো শূকর (বিগ ক্যাট বাদে)। তবে, গত চল্লিশ বছরে সারা বিশ্বে একমাত্র ভারতে আশির দশকে বিহারে ও ১৯৯৬-৯৭-এ এই উত্তরপ্রদেশেই শিশুদের উপর হামলা করেছে নেকড়ে। সে বারও ওঠে অলৌকিকের তত্ত্ব। শাবকের ক্ষতি করায় কোনও নেকড়ে-নেতা নাকি ক্ষিপ্ত, বিশেষ বিশেষ দিনে শাস্তি দিচ্ছে ইত্যাদি! গবেষণা জানায়, শিকারের অভাবে এক আলফা-নেকড়ে দরিদ্র, অরক্ষিত শিশুদের নিয়ে যাচ্ছিল। তখনই সুযোগসন্ধানী লোকজন নিজেদের শত্রুকে মেরে ওয়্যারউলফকে দোষ চাপানোয় ভয় দ্বিগুণ হয়েছিল।
ত্রিশ বছর পরে বহরাইচে সেই মানাই (নেকড়ে-মানব) ফেরেনি। বরং, থেকে গিয়েছে দারিদ্রের দানব। ঘরগুলি ভাঙাচোরা, শৌচালয় দূর অস্ত্, দরজাও নেই। বিদ্যুতের সমস্যা, খাটিয়া পেতে বাইরে শিশুকে নিয়ে ঘুমান মায়েরা। নির্মম সত্য, জীবনধারণের তাগিদে শিশুদের চেয়েও সুরক্ষিত গবাদি পশু। বাচ্চারা ঝোপঝাড়ে খেললে, প্রাকৃতিক প্রয়োজনে মাঠে-ঘাটে গেলে খরগোশ মনে করছে শ্বাপদ। বিজ্ঞানীদের দাবি: এলাকায় নেকড়ে ও কুকুরের সঙ্কর প্রাণী আছে, তাদের ছানাদের পোষার চলও রয়েছে! এই সব প্রাণী বড় হলেই হিংস্র স্বভাব প্রকাশ্যে আসে। মানুষ তখন তাদের তাড়িয়ে দেন। এরা জঙ্গলের নেকড়ের মতো শিকারি নয়, আবার মানুষের স্বভাবের সঙ্গেও সুপরিচিত। ফলে, মানবশিশুকে ধরা তাদের পক্ষে সহজ। সঙ্কর প্রাণী ত্রাস ছড়ালে ঝামেলাও বেশি, কারণ, দৃশ্যত গ্রামের কুকুরদের থেকে এদের আলাদা করা মুশকিল।
আক্রান্তদের ক্ষতস্থানের নমুনার বিচার ও আটক পশুদের বৈশিষ্ট্য মেলানো, সঙ্কর প্রাণীর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয়েছে কি না— খবর মেলেনি। সরকার জানিয়েছে, সংবেদনশীল এলাকাগুলি চিহ্নিত হয়েছে, ভবিষ্যতে বিপদ এড়ানো যাবে। শিয়াল, গ্রামকুকুর, নেকড়ে ইত্যাদি আপাত-সদৃশ প্রাণীকে আলাদা করে চেনাতে পোস্টার পড়েছে। তবে সবচেয়ে জরুরি অধিবাসীদের জীবনের মানোন্নয়ন ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। তার বদলে আবহাওয়া ভারী করছে গুজবের বাতাস।
শীত আসছে, এ সময় লেপার্ডের উপদ্রবও বাড়তে দেখা যায়। লেপার্ড হানার একটি কালচক্র লক্ষ করা গিয়েছে। কিছু শারীরবৃত্তীয় কারণেই তিন-চার বছর অন্তর সমস্যা বাড়ে। বহরাইচ-সহ দেশের কিছু এলাকা থেকে সেই দুঃসংবাদও আসছে। যে কারণেই ঘটুক, জীবনহানির আশঙ্কা নির্মূল করতেই হবে। কিন্তু তার জন্য গোটা নেকড়ে সম্প্রদায় যেন ধ্বংস না হয়ে যায়। মানুষ মারমুখী হলে লোকবসতি ঘেঁষে বসবাসকারী জীবগুলির সমূহ বিপদ।
সংরক্ষণ, বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব তো রয়েইছে, ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতিরও অনেকখানি জুড়ে আছে ‘ভেড়িয়া’। মানুষ দেখলে যারা চকিতে মিলিয়ে যায়। আশপাশে ঘুরলেও লোকে ওদের দেখতে পায় না, দেখলেও চিনতে পারে না। তাই বলে, ‘ভূত্তা’। পাক দেয় রহস্য। ঘন নীলাভ কুয়াশাময় আধখাওয়া চাঁদ। তার নীচে গলা তুলে নেকড়ের রোমাঞ্চক ডাক। ওই দৃশ্য, সেই শব্দ, এই হিমেল আবহ বিনা গ্রামীণ ভারতের নৈশ মায়ার অনেকখানিই অন্তর্হিত হবে।