বিচার চাই: দেশ জুড়ে ঘটে চলা ধর্ষণের প্রতিবাদে মোমবাতি মিছিল। শনিবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই
রাজধানী লখনউ থেকে দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। কানপুর থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূর।
উন্নাও।
গোটা উত্তরপ্রদেশ বাদ থাক। শুধু উন্নাওয়েই এ বছরের ১১ মাসে ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা ১৮৫টি। উন্নাওয়ে ধর্ষণের শিকার ২৩ বছরের তরুণীকে অভিযুক্তরা পুড়িয়ে মারার দিনেও সেখানে তিন বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়েছে।
গত কয়েক বছরে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে এই এলাকায়। যার দৌলতে যোগী আদিত্যনাথের শাসনে রাজ্যের ধর্ষণ রাজধানী হয়ে উঠেছে এই জনপদ! মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগী তা হলে কী করছেন? কেন তিনি এর নৈতিক দায়িত্ব নেবেন না? এই প্রশ্ন তুলেই আজ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলল বিরোধী শিবির।
এই উন্নাওয়েই দু’বছর আগে বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। সেঙ্গারের নামে ধর্ষিতার পরিবারের উপর হামলা চালিয়ে সাক্ষী লোপাটের মামলাও ঝুলছে। এ বার সেই উন্নাওয়েই ধর্ষণের শিকার ২৩ বছরের এক তরুণীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাতেও বিজেপি-ঘনিষ্ঠদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠল।
শুক্রবার রাতে দিল্লির হাসপাতালে উন্নাওয়ের তরুণীর মৃত্যু হয়। তার পরে শনিবার সকালেই উন্নাও পৌঁছে যান কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার পরে প্রিয়ঙ্কা বলেন, ‘‘নির্যাতিতার পরিবারকে গত এক বছর ধরে হেনস্থা করা হচ্ছিল। আমি শুনলাম, অভিযুক্তদের সঙ্গে বিজেপির একটা যোগাযোগ রয়েছে। সে কারণেই তাদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছিল।’’ এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলে এআইসিসি-তে উত্তরপ্রদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রিয়ঙ্কার যুক্তি, ‘‘কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী হলে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করতেন।’’
যোগী-রাজ
• চলতি বছরে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা
• ওই সময়ে উন্নাও জেলায় ১৮৫টি যৌন হেনস্থার ঘটনা। ধর্ষণ ও হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে উন্নাওয়ের অসোহা, অজগেন, মাখি, বাঙ্গরমউয়ে
• অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত পরে জামিনে মুক্ত বা পলাতক
• অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ না-পেলে এক ইঞ্চিও নড়ে না পুলিশ
• যোগীর পুলিশের দাবি, গত ২ বছরে ৫ হাজার ১৭৮টি এনকাউন্টারে উত্তরপ্রদেশে ১০৩ জন অপরাধী নিহত হয়েছে। আহত ১ হাজার ৮৫৯ জন। রাজ্যে ১৭ হাজার ৭৪৫ জন অপরাধী হয় আত্মসমর্পণ করেছে, নয় জামিন খারিজ হয়ে যাওয়ায় জেলে
যোগীর পদত্যাগের দাবি তুলে আজ এসপি-নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব বিধানসভার সামনে ধর্নায় বসেছেন। রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেলের কাছে দরবার করেছেন বিএসপি নেত্রী মায়াবতী। চাপের মুখে যোগী এই ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতে মামলার শুনানি হবে। অপরাধীদের শাস্তি হবে।’’
কিন্তু যোগীর আশ্বাসবাণীতে এলাকার মানুষের ক্ষোভ কমেনি। মুখ্যমন্ত্রী যোগী তাঁর দুই মন্ত্রী, স্বামীপ্রসাদ মৌর্য ও কমলারাণী বরুণকে উন্নাও যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন মন্ত্রীরা। তাঁদের গাড়ি ঘিরে গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তোলেন, এত দেরিতে কেন! বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজও উন্নাও গিয়েছিলেন। ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক সেঙ্গারকে তিনি সম্প্রতি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ক্ষোভ বাড়ছে দেখে নির্যাতিতার পরিবারের জন্য ২৫ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে উত্তরপ্রদেশ সরকার। তাতে অবশ্য বিরোধীরা থামেননি। শুধু যোগী নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকেও আঙুল তুলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী বলেন, ‘‘ভারত এখন বিশ্বের ধর্ষণ রাজধানী বলে পরিচিত। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো প্রশ্ন তুলছে, কেন আমরা মেয়ে-বোনদের রক্ষা করতে পারি না। উত্তরপ্রদেশের একজন বিজেপি বিধায়ক ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত। তার পরেও প্রধানমন্ত্রী একটা কথা বলেন না!’’
মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসে যোগী পুলিশকে কার্যত ‘এনকাউন্টার’-এর ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। যৌন হেনস্থা রুখতে তৈরি হয়েছিল অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড। আজ সে প্রসঙ্গ তুলে অখিলেশ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেছিলেন, ‘অপরাধীয়ো কো ঠোক দিয়া জায়েগা’। সরকার একজনের প্রাণও বাঁচাতে পারছে না।’’
উন্নাওয়ের তরুণী ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ প্রথমে এফআইআর নিতে চায়নি বলে ইতিমধ্যেই শোনা গিয়েছে। রায়বরেলী কোর্টের নির্দেশে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। কিন্তু প্রধান অভিযুক্ত শিবম ত্রিবেদী হাইকোর্টে জামিন পেয়ে যায়। শুক্রবার তরুণী রায়বরেলী কোর্টে যাওয়ার জন্যই ট্রেন ধরতে বেরিয়েছিলেন। সে সময় তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়। প্রিয়ঙ্কার প্রশ্ন, ‘‘যে সব পুলিশ অফিসার এফআইআর নিতে চাননি, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এ রাজ্যে অপরাধীদের স্থান নেই। এখন মনে হচ্ছে, এ রাজ্যে নারী জাতির স্থান নেই। অভিযুক্তরা দু’মাসে জামিন পেয়ে যায়! নির্যাতিতা রোজ একা ট্রেনে রায়বরেলী যেতেন। তাঁকে নিয়মিত ধমকানো হত। থানায় বারবার গিয়েও নিরাপত্তা মেলেনি। তার পর পাঁচজনে মিলে ওঁকে জ্বালিয়ে দিল। কে এর দায় নেবে? মুখ্যমন্ত্রী কাদের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?’’