রাজ্যসভায় অমিত শাহ।
রাজ্যসভায় পাশ হয়ে গেল বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন সংশোধনী বিল (ইউএপিএ)। এ বার রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ স্বাক্ষর করলেই তা আইনে পরিণত হবে। যার পর, সন্দেহের বশে কোনও ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা যাবে।
১৯৬৭ সালের ইউএপিএ আইন অনুযায়ী এতদিন কোনও সংগঠন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, সন্ত্রাসী কাজকর্মের প্রস্তুতি নিলে এবং তাদের মাধ্যমে কোনও ভাবে সন্ত্রাসবাদের প্রচার হলে, ওই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে চিহ্নিত করতে পারত কেন্দ্রীয় সরকার। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ডিজি-র অনুমতি নিয়ে ওই সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারত জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই বিলটিতে যে সংশোধন ঘটিয়েছে, তার আওতায় শুধুমাত্র কোনও সংগঠনই নয়, সন্দেহভাজন কোনও ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা যাবে। তদন্ত চলাকালীন ওই ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে এনআইএ। সে ক্ষেত্রে আর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ডিজির কাছ থেকে আগে ভাগে অনুমতি নিতে হবে না তাদের। তার পরিবর্তে এনআইএ-র ডিজি-র অনুমতি নিলেই চলবে।
আরও পড়ুন: ঠান্ডা যুদ্ধের দিন ফিরছে? ভেঙে গেল ৩২ বছরের পুরনো রুশ-মার্কিন চুক্তি
এতদিন পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অথবা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বা তার চেয়ে উচ্চপদে আসীন কোনও অফিসারই সন্ত্রাস সংযোগ নিয়ে তদন্ত করতে পারতেন। কিন্তু সংশোধিত বিলটিতে এনআইএ-র হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর বলে সংস্থার ইনস্পেক্টর পদে কর্মরত কোনও কর্মীও তদন্ত করতে পারবেন।
দ্বিতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর, গত ৮ জুলাই লোকসভায় ইউএপিএ সংশোধনী বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ২৪ জুলাই বিলটি সেখানে পাশ করিয়ে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। তার পর শুক্রবার রাজ্যসভায় বিলটি নিয়ে ভোটাভুটি শুরু হলে পুনর্বিবেচনা করে দেখতে বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেয় বিরোধীরা। কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। তার পর ভোটাভুটি শুরু হলে, বিলটির সমর্থনে ভোট দেন ১৪৭ জন সাংসদ। বিপক্ষে ভোট দেন ৪২ জন।
এ দিনও রাজ্যসভায় বিলটি নিয়ে বিতর্ক চলাকালীন সরকার পক্ষের হয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন অমিত শাহ। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের কোনও ধর্ম হয় না। সন্ত্রাসবাদীরা মানবতা বিরোধী। তাই তাদের বিরুদ্ধে কড়া আইনে সমর্থন জানানো উচিত আমাদের সকলের।’’ কোনও সংগঠনের বদলে ব্যক্তি বিশেষকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়ায় অমিত শাহের যুক্তি, ‘‘কোনও সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে, অনেক ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত সদস্যরা পরবর্তীকালে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। তাই এমন সিদ্ধান্ত।’’
আরও পড়ুন: অবস্থা সঙ্কটজনক, তবে এখনই দিল্লি আনা হচ্ছে না উন্নাওয়ের নির্যাতিতাকে
সংশোধিত বিলটি পাশ হয়ে আইনে পরিণত হলে, তার অপব্যবহার হতে পারে, সরকার বিরোধী যে কারও গায়ে সন্ত্রাসবাদী তকমা সেঁটে দেওয়া হতে পারে বলে শুরু থেকেই দাবি তুলছিল কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা। তাঁদের আশ্বস্ত করে শাহ জানান, সন্ত্রাসী সন্দেহে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে আবেদন জানাতে পারবেন তিনি। আবেদন হাতে পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে স্বরাষ্ট্র সচিবকে। এ ছাড়াও, দায়িত্বে থাকা অথবা অবসরপ্রাপ্ত এক জন বিচারপতি এবং অবসরপ্রাপ্ত দুই সরকারি সচিবকে নিয়ে কমিটি গড়া হবে। সেখানেও আবেদন পর্যালোচনা করে দেখার আবেদন জানানো যাবে।
কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বিলটি পাশ করানো নিয়ে মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা প্রবীণ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম। বিলটিকে ঐতিহাসিক ভুল বলে উল্লেখ করেন তিনি। মাওবাদী সংযোগের অভিযোগে গত বছর গৌতম নাভলাখা-সহ পাঁচ সমাজকর্মীকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্র পুলিশ। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। সেই প্রসঙ্গে টেনে চিদম্বরম বলেন, ‘‘দয়া করে হাফিজ সইদের সঙ্গে গৌতম নাভলাখার তুলনা করবেন না।’’
ঠিক কী ধরনের প্রমাণ হাতে পেলে এক জন ব্যক্তি সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, সংশোধিত বিলটিতে তা স্পষ্ট করে বলা নেই। আবার কোনওরকম মামলা দায়ের না করেই কাউকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে, তা-ও বলা নেই সবিস্তারে। এতে নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে পারে বলে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে বিভিন্ন মহল। তা নিয়ে এদিন সংশোধিত বিলটিকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন পি চিম্বরমও। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের মনে হলেই কাউকে সন্ত্রাবাদী ঘোষণা করে দেবে। এফআইআর, চার্জশিট, মামলা, শুনানির কোনও বালাই নেই। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে যে কাউকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করা হচ্ছে? শুধু মাত্র আপনাদের মনে হয়েছে বলেই!’’ এই বিলটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ইসলামাবাদ শর্ত দেওয়ায় কুলভূষণের সঙ্গে দেখা করলেন না ভারতীয় কূটনীতিকরা
এর জবাবে কংগ্রেসকেই তুলোধনা করেন অমিত শাহ। তিনি বলেন, ‘‘জরুরি অবস্থার সময় কী হয়েছিল? সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জেলে পোরা হয়েছিল সমস্ত বিরোধী নেতাদের। টানা ১৯ মাস গণতন্ত্রের অস্তিত্বই ছিল না। সেই আপনারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে আইনের অপব্যাহারের অভিযোগ তুলছেন? তার চেয়ে বরং নিজেদের অতীতটা আর একবার ঝালিয়ে নিন।’’ তবে শুধু কংগ্রেস নেতারাই নন, এমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি এবং তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রও এর আগে সংশোধিত বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।