বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। —ফাইল চিত্র।
সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে কড়া সুর শোনা গেল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের গলায়। আমেরিকা ও ভারতের আইনি সম্পর্ক নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানান, অসন্তোষের স্বর চাপা দিতে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার যেন না হয়।
ভারত-আমেরিকা আইনি সম্পর্ক নিয়ে যৌথ গ্রীষ্মকালীন সম্মেলনে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘অসন্তোষের স্বরকে চাপা দিতে বা নাগরিকদের হয়রান করার জন্য যেন সন্ত্রাস-বিরোধী আইন-সহ অপরাধ আইনের অপব্যবহার কখনওই না করা হয়।’’ এ প্রসঙ্গে অর্ণব গোস্বামী বনাম সরকার মামলার প্রসঙ্গ টেনে বিচারপতি বলেন, ‘‘নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার বিরুদ্ধে তারাই যে প্রথম রক্ষণ হিসেবে কাজ করে, সেটা যেন আমাদের আদালতগুলি নিশ্চিত করে।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রাখা এবং তা যদি এক দিনের জন্যও হয়, তা কিন্তু যথেষ্টই। আমাদের সব সময় আমাদের সিদ্ধান্তের গভীরতর পদ্ধতিগত বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া দরকার।’’ অনেকে মনে করাচ্ছেন, কয়েক দিন আগে দিল্লি হিংসায় উস্কানির অভিযোগে ইউএপিএ-র কঠোর ধারায় আটক তিন পড়ুয়াকে জামিন দিতে গিয়ে কেন্দ্রকে ভর্ৎসনা করে দিল্লি হাইকোর্টও বলেছিল, প্রতিবাদের অধিকার আর জঙ্গি কার্যকলাপের ফারাক বুঝতে হবে।
এলগার পরিষদ মামলায় গত বছর গ্রেফতার হয়ে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে বন্দি ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছে গত সপ্তাহেই। একাধিক বার তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল আদালতে। এই মৃত্যু নিয়ে বিদেশেও কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার এবং ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। সমালোচকদের অভিযোগ, সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই সন্ত্রাস দমন আইনে প্রতিবাদীদের অন্যায় ভাবে বন্দি করে রাখছে সরকার। এমনকি বহু ক্ষেত্রে আদালতেও সুবিচার মিলছে না বলেও সরব হয়েছেন অনেকে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের এমন মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে সুর চড়িয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। এ প্রসঙ্গে এলগার পরিষদ মামলায় একাধিক সমাজকর্মীর গ্রেফতারির প্রসঙ্গও তুলছেন তাঁরা। একাধিক প্রতিবাদীকেই বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) আটক করে রাখার নজির রয়েছে মোদী সরকারের। তার মধ্যে অল্প কয়েক জনই আদালতে দীর্ঘ মামলার পরে মুক্ত হয়ে বাইরে এসেছেন। এঁদেরই একজন অসমের কৃষক নেতা অখিল গগৈ। মোদী সরকারের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় তাঁকে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে আটক করে কেন্দ্র সরকার। দেড় বছর বন্দি থাকার পরে সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই ইউএপিএ-র অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গেই কাশ্মীরের এক ব্যক্তির উদাহরণও তুলছেন অনেকে। জঙ্গি দমন আইনে আটক হওয়ার ১১ বছর পরে আদালতে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছেন তিনি। সম্প্রতি মুক্তিও পেয়েছেন জেল থেকে। সমালোচকদের বক্তব্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিছক সন্দেহের বশে এমনকি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও জঙ্গি দমন আইন বা বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে প্রতিবাদীদের। জেলে কয়েক জনের মৃত্যুও হয়েছে।
আমেরিকার বিচারব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করার পাশাপাশি চন্দ্রচূড় জানান, নাগরিক স্বাধীনতা, কথা বলা ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় শান্তি বজায় রাখার প্রশ্নে আমেরিকার আদালতগুলি অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাঁর মতে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র এবং বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আমেরিকা ও ভারতের বিচারব্যবস্থা সব সময়েই অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপরে আমেরিকার বিচারব্যবস্থার প্রভাবের প্রসঙ্গ টেনে বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘প্রাপ্তবয়স্কদের সমলিঙ্গ সম্পর্ককে অপরাধের তকমামুক্ত করার বিচারের সময় আমি লরেন্স বনাম টেক্সাস মামলায় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেছিলাম।’’