ঠোঁট-রাঙানিই চোখ রাঙাল মাঝ আকাশে

চুমুর হাতছানি নয়। আজ ঠোঁট রাঙানোর রং বোমাতঙ্ক ছড়াল ভারতের আকাশে। একই সঙ্গে পরীক্ষা করল, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা তৈরি। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা ২৫ মিনিট। ব্যাঙ্কক থেকে ইস্তানবুল যাওয়ার পথে তুরস্ক এয়ারলাইন্সের টিকে০৬৫ বিমান তখন নাগপুরের আকাশে। হঠাৎ দেখা গেল, বিমানের পিছন দিকের একটি শৌচালয়ের আয়নায় লাল লিপস্টিকে লেখা সতর্কবার্তা--‘বম্ব ইন সিজিআর’।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

বোমাতঙ্কে জরুরি অবতরণের পর তুর্কি বিমানে তল্লাশি নিরাপত্তা রক্ষীদের । মঙ্গলবার নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে। ছবি: এএফপি।

চুমুর হাতছানি নয়। আজ ঠোঁট রাঙানোর রং বোমাতঙ্ক ছড়াল ভারতের আকাশে। একই সঙ্গে পরীক্ষা করল, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা তৈরি।

Advertisement

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা ২৫ মিনিট। ব্যাঙ্কক থেকে ইস্তানবুল যাওয়ার পথে তুরস্ক এয়ারলাইন্সের টিকে০৬৫ বিমান তখন নাগপুরের আকাশে। হঠাৎ দেখা গেল, বিমানের পিছন দিকের একটি শৌচালয়ের আয়নায় লাল লিপস্টিকে লেখা সতর্কবার্তা--‘বম্ব ইন সিজিআর’। যার অর্থ, বিমানের কার্গো বা মালপত্র রাখার জায়গায় বোমা রয়েছে।

পাইলট আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে নাগপুরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে (এটিসি) খবর পাঠান। বিমান দিল্লির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ইন্দিরা গাঁধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জারি হয় জরুরি অবস্থা। এনএসজি, সিআইএসএফ, বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো, গুপ্তচর সংস্থা র-এর অফিসাররা চলে আসেন। বিমানবন্দরের বাইরেও কড়া পাহারা বসে যায়।

Advertisement

দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে দিল্লিতে জরুরি অবতরণ করে তুরস্কের বিমান। সেটিকে বিমানবন্দরের এক পাশে পরিত্যক্ত একটি ‘বে’ বা বিমান রাখার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৩৪ জন যাত্রী ও ১৪ জন বিমানকর্মীকে নামিয়ে নিয়ে আসার পরে গোটা বিমান জুড়ে শুরু হয় চিরুনি তল্লাশি। এয়ারবাস-৩৩০-তে দু’টি মালপত্র রাখার জায়গা থাকে। একটি একেবারে বিমানের পেটের নীচে। অন্যটি পিছন দিকে। বোমা বিমানের পেটের নীচেই রাখা হবে বলে মনে করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বোমা মেলেনি। বিমানটিকেও সন্ধ্যাবেলায় ইস্তানবুল উড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

বিস্ফোরণে বিমান উড়ে যায়নি ঠিকই। কিন্তু ওই লিপস্টিক-বার্তা আজ দেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্তাদের শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত নামিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে এনেছে আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাই ও ২৬/১১-র মুম্বই সন্ত্রাসের আতঙ্ক।

কেন? প্রথম ও প্রধান কারণ, পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। তাদের নিশানায় তুরস্ক রয়েছে বলে সম্প্রতি সতর্কবার্তা জারি করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো। তুর্কি দূতাবাস ও তাদের অন্য কোনও সম্পত্তিতে তারা হামলা চালাতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। তুরস্কের সরকারি সংস্থার বিমানে আইএস বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে— এই আতঙ্ক অবশ্য এখন বিশ্ব জুড়ে। গত বছর তুরস্ক এয়ারলাইন্সের একটি বিমানের ইঞ্জিনে আরবি হরফে লেখা প্রার্থনা পাওয়া যায়। তার পর থেকেই এই পরিস্থিতি। গত এপ্রিল মাস থেকে বেশ কয়েক বার তুরস্কের বিমানে বোমাতঙ্ক ছড়িয়েছে।

নাগপুরের এটিসি থেকে খবর ছড়ানোর পরেই তাই ওই বিমানে বিস্ফোরক রয়েছে ধরে নিয়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক পরিকল্পনা তৈরি করতে শুরু করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সিআইএসএফ-এর ডিজি সুরেন্দ্র সিংহকে ফোন করে খবর নেন। এনএসজি-সিআইএসএফ-বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের কর্মীদের পাশাপাশি আইবি ও র’-এর অফিসাররাও বিমানে তল্লাশি চালান। যাত্রীদের জেরা করেন।

একটি প্রশ্নের অবশ্য উত্তর মেলেনি। তা হল, কে বিমানের শৌচালয়ের আয়নায় লিপস্টিক দিয়ে ওই কথাগুলি লিখে রেখেছিলেন। বিমানের মহিলা যাত্রীদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের ব্যাগ ও শরীরেও তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এর কোনও উত্তর মেলেনি। বিমানমন্ত্রী অশোক গজপতি রাজু বলেন, ‘‘যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে আনার পরে সকলকেই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও সদুত্তর মেলেনি। কোনও যাত্রীকে আটক করা হয়নি। সব যাত্রীকে নিয়েই বিমানটি নিজের গন্তব্যে উড়ে যাচ্ছে।’’

আজকের ঘটনার পর গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তাদের অনেকেরই শিকাগোর ‘লিপস্টিক কিলার’-এর কথা মনে পড়েছে। ১৯৪৫-এ শিকাগোয় উইলিয়ান হায়ারেন্স নামে এক ‘সিরিয়াল কিলার’-এর আবির্ভাব ঘটে। একের পর এক মহিলাকে খুনের পর উইলিয়াম আয়নায় লিপস্টিক দিয়ে অনুরোধ জানিয়ে যেত, ‘পরের খুনটা করার আগেই আমাকে ধরে ফেলুন।’

গোয়েন্দা কর্তারা অবশ্য মানছেন, এই লিপস্টিক-বার্তা আজ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে রীতিমতো পরীক্ষার মুখে ফেলেছিল। সেই পরীক্ষায় তাঁরা উতরে গিয়েছেন বলেও বিমানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের দাবি। গত সপ্তাহেই প্রাক্তন র প্রধান এ এস দুলাতের বইয়ে খোলসা হয়ে গিয়েছে, আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাইয়ের সময়ে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা অপ্রস্তুত ছিল।

আর আজ?

বিমানমন্ত্রীর দাবি, মুহূর্তের মধ্যে সকলে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। মুম্বই কাছে হলেও দিল্লির বিমানবন্দর অনেক বড় বলে বিমানটিকে এখানে নিয়ে আসা হয়। সিদ্ধান্ত নিতে একটুও দেরি হয়নি। কয়েক মিনিটের মধ্যে এনএসজি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। জরুরি অবস্থা জারি হয়ে যায় বিমানবন্দরে। প্রশাসন সব রকম পরিস্থিতির জন্যই তৈরি ছিল।

তুরস্ক এয়ারলাইন্সের টিকে০৬৫-এ শেষ পর্যন্ত বোমা মেলেনি। কিন্তু লিপস্টিক হাতে কে শৌচালয়ের আয়নায় বোমার খবর লিখে এসেছিলেন, সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি। তা এখনও রহস্যই থেকে গেল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement