—ফাইল চিত্র।
নাবালিকাকে অপহরণ করে ধর্ষণের মামলার শুনানি চলছিল। দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালতের বিচারপতি বললেন, কমবয়সিদের নিখাদ প্রেমকে আইনের বেড়ায় আটকানো যায় না। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, তখন পুলিশি পদক্ষেপ করেও লাভ হয় না।
মামলাটি ন’বছর আগের। শুনানি হচ্ছিল দিল্লি হাই কোর্টের এজলাসে। আদালতকে মামলাকারী জানিয়েছিলেন, তাঁর নাবালিকা কন্যাকে বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন ‘অপহরণকারী’। পরে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করেন, যা বেআইনি এবং ধর্ষণের সমান।
অন্য দিকে, যিনি ‘ধর্ষিতা’, তিনি এই মামলায় পক্ষ নেন ‘অপহরণকারী’র। আদালতে তিনি পাল্টা জানান, অপহরণ করা হয়নি। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে সংসার পাতবেন বলে নিজের ইচ্ছেতেই ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। প্রেমিকের বাবা-মাকে সাক্ষী রেখে মুসলিম মতে বিয়ে করেছিলেন। আর এখন সুখে সংসার করছেন। তাঁদের দু’টি ফুটফুটে কন্যা সন্তানও রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘আইন আবেগে চলে না’ জাতীয় যুক্তি দিয়ে অপহরণকারীর কড়া শাস্তি চেয়েছিলেন মামলাকারীর আইনজীবী। কিন্তু হাই কোর্ট সেই আবেদনে কর্ণপাত করেনি। বদলে বিচারপতি এ সংক্রান্ত এফআইআর খারিজ করে মন্তব্য করেছেন, ‘‘এই এফআইআর ওই দম্পতি এবং তাঁদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারে। যেটা হতে দিলে আর যাই হোক, সুবিচার হবে না।’’
বিচারপতি বলেন, ‘‘এই ধরনের মামলা, যা কিনা বিরল ঘটনা, অনেক সময় বিচারককে দ্বন্দ্বে ফেলতে পারে। সেই ক্ষেত্রে শুধু অন্ধ ভাবে আইনের ফর্মুলা মেনে চললে হবে না। বিচারকের দ্বন্দ্বকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই নিতে হবে সিদ্ধান্ত। দেখতে হবে যে আইন প্রয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে, তা সার্বিক ভাবে সমাজের উপর কী প্রভাব ফেলবে? যাঁদের উপর ওই আইন প্রয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে, তাঁদের ভবিষ্যতের উপর কী প্রভাব ফেলবে? আদৌ সুবিচার হবে কি!’’
প্রসঙ্গত, কয়েক দিন ঠিক একই রকম একটি মামলায় কিছুটা একই ধরনের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টও। যা পরে সুপ্রিম কোর্টে সমালোচিত হয়। অপহরণ করে ধর্ষণের একটি মামলায় অভিযুক্তকে মুক্তি দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে ‘নির্যাতিতা’ কিশোরীকে তাঁরা উপদেশ দিয়েছিল সংযম অভ্যাস করার। বলেছিল, কয়েক মুহূর্তের আনন্দের জন্য যেন কিশোরীরা তাঁদের সম্মান নষ্ট না করেন। সেই মামলাটিও ছিল এই মামলার মতোই।
সেখানেও কিশোরী ছিলেন এক সন্তানের জননী। কিন্তু নাবালিকা বয়সে বিয়ে করায় তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে অপহরণ এবং ধর্ষণের অভিযোগ আনে তাঁর পরিবার। যার জেরে জেলে যেতে হয় তাঁর স্বামীকে। আর ওই কিশোরী এক সন্তান এবং অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। বাড়িতে উপার্জনের কেউ না থাকায় অভাবের তাড়নায় শেষমেশ আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। হাই কোর্ট তাঁর স্বামীকে মুক্তি দেয়।
কলকাতা হাই কোর্টের সেই নির্দেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এ বার দিল্লি হাই কোর্টও একই ধরনের একটি মামলায় কিছুটা একই রকমের নির্দেশ দিল। দিল্লির হাই কোর্টের বিচারপতি এই মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এই মামলার দুই পক্ষ ‘নির্যাতিতা’ এবং ‘অপহরণকারী’ পরস্পরের সঙ্গে গত ন’বছর ধরে বৈবাহিক সম্পর্কে রয়েছে। একই সঙ্গে এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, তাঁরা সুখে রয়েছে। এই অভিযোগ বা মামলা তাঁদের পরিবারের এবং তাঁদের দুই কন্যার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে।
বিচারপতি এই মামলার রায়ে বলেছেন, ‘‘আদালত শুধু আইনের ধারক এবং বাহক নয়, তাদের কাজ শুধু আইনের ব্যাখ্যা এবং আইনের প্রয়োগ নয়। সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন বিষয়কে বোঝাও তাদের কাজ। তাদের বুঝতে হবে, তাদের দেওয়া নির্দেশ বা রায় এক জন ব্যক্তি বা বৃহত্তর সমাজের উপর কী প্রভাব ফেলে।’’
দিল্লি হাই কোর্ট আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘‘বিচারের যে দাঁড়িপাল্লা তা কোনও অঙ্কের ফর্মুলা মেনে চলে না। এর এক দিকে যদি আইন থাকে, তবে অন্য দিকে থাকে মানুষের জীবন। তাদের সুখ-দুঃখ। তাদের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ। তাই আইনের প্রয়োগ এবং আইন বজায় রাখার কাজ সেই সব কিছু দেখেই করা উচিত।’’