সিপিএমের ২২তম রাজ্য সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। আগরতলার টাউন হলে। ছবি: বাপি রায়চৌধুরী।
তাঁরা যখন কাণ্ডারী, দুই রাজ্যে তখনই বাম দুর্গের পতন ঘটেছিল। বিপর্যয়ের পরে দলের মধ্যে কাঠগড়ায় দাঁড়়াতে হয়েছিল বাংলার পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। ত্রিপুরায় সেই আক্রমণ থেকে মানিক সরকারকে রক্ষাকবচ দিল তাঁর দলই!
উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যে ২৫ বছরের বাম জমানার অবসানের পিছনে ‘রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ত্রুটি’র কথা স্বীকার করে নিচ্ছে সিপিএম। কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ৯ মাসের মাথায় প্রথম রাজ্য সম্মেলনে প্রশাসনিক ত্রুটি নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হয়নি সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে। বরং, মুখ্যমন্ত্রী মানিকের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পাশেই দাঁড়়াচ্ছেন এ রাজ্যের সিপিএমের রাজ্য ও জেলার নেতারা।
বাংলায় ‘পরিবর্তনে’র পরের বছর দলের রাজ্য সম্মেলনে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম-পর্বে বুদ্ধবাবুর সরকারের ভূরি ভূরি ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছিলেন প্রতিনিধিরা। সিঙ্গুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপরে তৃণমূল নেত্রীর নেতৃত্বে ২৪ দিনের ধর্না কেন তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেননি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু, সেই প্রশ্নও উঠেছিল। বস্তুত, বিরোধী আসনে যাওয়ার পর থেকে বুদ্ধবাবুও তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা কমিয়ে এনে এখন একেবারেই অন্তরালে।
আরও পড়ুন: ‘ভোট এক্সপ্রেসে’ রাজা উজির, রোষে মামা
ত্রিপুরায় মানিকবাবুই বিরোধী দলনেতা। দলের বিপর্যয়েও নিজের আসন ধরে রাখতে পেরেছেন বলে। সম্মেলনেও বাংলার উল্টো ছবি। বাম সরকারের শেষ দিকে এখানে জাতীয় সড়়ক অবরোধ করে রেখেছিল জনজাতি সংগঠন আইপিএফটি। আগরতলায় মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের আবাসের সামনে ধর্না চলেছিল। কোনওটাই পুলিশ দিয়ে তোলেননি মুখ্যমন্ত্রী মানিক। সম্মেলনে আজ দক্ষিণ ত্রিপুরার এক প্রতিনিধি সেই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েই বলেছেন, সেই সময়ে অবরোধে লাঠি-গুলি চালালে রাজ্যে আগুন জ্বলত। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেত।
ত্রিপুরা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যও বলছেন, ‘‘বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসার ৮-৯ মাসের মধ্যে জনজাতি মানুষ ক্ষুব্ধ। তখন যদি আমাদের সরকার লাঠি-গুলি চালাত, তা হলে এখন ওই মানুষগুলি নতুন সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও আমাদের দিকে আর তাকাতেন না!’’ পাতা দশেকের ছোট্ট সম্পাদকীয় প্রতিবেদনেও জনজাতির আবেগকে ছোট করে দেখা, তাঁদের বেড়ে চলা চাহিদার কথা বুঝতে না পারা, স্থানীয় স্তরে নেতা-কর্মীদের চালচলনে ত্রুটি, বিজেপির দাপট বাড়়ছে দেখেও মানুষের কাছে পাল্টা প্রচার নিয়ে যেতে না পারা— এই রকম রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আত্মসমালোচনা জায়গা পেয়েছে। মানিকের সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার দিকে তিরের নিশানা নেই।
আরও পড়ুন: ‘গান’ ছেড়ে জীবনের গানে প্রাক্তন মাওবাদীরা
আগরতলার টাউন হলে শ’তিনেক প্রতিনিধিকে নিয়ে আজ শুরু ত্রিপুরা সিপিএমের ২২তম রাজ্য সম্মেলন। শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানানোর পরে সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ও রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ই এই সম্মেলনের মন্ত্র। সেই সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়়াই করার মতো সংগঠন ফিরে পাওয়াও তাঁদের লক্ষ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পরিস্থিতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। আবার আপনা আপনিই পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অনুকূলে চলে আসবে না’। মানিক-বিজনেরা যখন বিপর্যয়ের ময়না তদন্তে, সে দিনই ঘটা করে পালিত হচ্ছে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের জন্মদিন!