হাতের মুদ্রায় করোনাভাইরাস দেখাচ্ছেন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ প্রশিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সরকার।
যে ভাবে দৈনন্দিন কথ্য ভাষার অভিধান বদলে দিয়েছে কোভিড-১৯, সে ভাবেই প্রসারিত হচ্ছে শ্রবণ ও বাক্সমস্যাযুক্ত মানুষদের ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’-ও। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কথ্য ভাষার মাধ্যমে সহজেই বর্তমান বিপদ ও তার মাত্রা বোঝানো যায়। কিন্তু সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ-এ দ্রুত তা অন্তর্ভুক্ত করা এবং তারপর ‘কমিউনিকেট’ করা একেবারেই সহজ কাজ নয়। আর নতুন ভাবে সামনে আসা শব্দগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি বোধগম্য করে তোলা না গেলে ওঁদের মধ্যে সংক্রমণের হার বেড়েই চলবে।
করোনাভাইরাসের জন্য হাতের মুদ্রার মাধ্যমে আলাদা চিহ্ন বার করা হয়েছে। মাস্ক, হ্যান্ড হাইজিন, হোম আইসোলেশন, দূরত্ববিধি-সহ শব্দগুলো বোঝানোর জন্য সঙ্কেত তৈরি করে ভিডিয়োয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’-এর ক্ষেত্রে গবেষণা, শিক্ষা ও নীতি প্রণয়নকারী, কেন্দ্রের অধীনস্থ ‘ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ (আইএসএলআরটিসি)-এর ওয়েবসাইটেও ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’-এর মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতির ভিডিয়ো আপলোড করা হচ্ছে।
‘অ্যাসোসিয়েশন অব সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রিটার’-এর জেনারেল সেক্রেটারি তথা আইএসএলআরটিসি-র এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রতিনিধি-সদস্য প্রীতি সাপরার কথায়, ‘‘করোনা সম্পর্কিত শব্দের অভিধান শ্রবণে সমস্যাযুক্ত মানুষেরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে কী ভাবে সুরক্ষিত থাকতে হবে, তা নিয়ে তৈরি ভিডিয়ো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।’’ সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রিটার অলকা জোশীর কথায়, ‘‘ভিডিয়ো বার্তার মাধ্যমে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করছি। রাস্তায় থুতু ফেলবেন না, সব সময় মাস্ক পরে থাকুন, দূরত্ব বজায় রাখুন, ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, এমন যাবতীয় সুরক্ষাবিধি নিয়ে ভিডিয়ো তৈরি করা হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: নিজের জীবন দিয়ে অধিকাংশ যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন বায়ুসেনার পদকপ্রাপ্ত পাইলট
ইন্টারপ্রিটাররা জানাচ্ছেন, ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ (আইএসএল)-এর পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক সাইন ল্যাঙ্গোয়েজও ব্যবহৃত হয়। সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রিটার শুভা লাহিড়ী সরকার বলেন, ‘‘এমনিতে আইএসএল ও আঞ্চলিক সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে তফাত রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সেই তফাত প্রায় মুছে গিয়ে অভিন্ন ভাষা তৈরি হয়েছে।’’ আর সেই ভাষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে সব থেকে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেফ’-এর (এনএডি) প্রেসিডেন্ট
তথা আইএসএলআরটিসি-র এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য এ.এস নারায়ণ বলছেন, ‘‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে করোনা সম্পর্কিত এত নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, যা এই ভাষার পরিধিকে আরও প্রসারিত করেছে।’’
বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য অভিযোগ করছেন, কেন্দ্রীয় সরকার করোনা নিয়ে যত প্রচার করেছে, তার সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রেই সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ব্যবহার না হওয়ায় জনগোষ্ঠীর বড় অংশের কাছে সে বার্তা পৌঁছয়নি। কারণ, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশে শ্রবণে সমস্যা যুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। শ্রবণে সমস্যাযুক্তদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা এক সংস্থার প্রেসিডেন্ট স্নিগ্ধা সরকার বলছেন, ‘‘যাঁরা সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ জানেন, তাঁরাই বর্তমান পরিস্থিতি ওয়েবসাইটে বা অনলাইনে তুলে ধরছেন। ফলে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে পরিবর্তন হলেও সেটা খুব অসংগঠিত ভাবে হচ্ছে।’’ শ্রবণে সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘করোনার কারণে প্রায় নিঃশব্দেই নৈঃশব্দের ভাষার পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে!’’
আরও পড়ুন: কোঝিকোড়ে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত দুই যাত্রীর কোভিড পজিটিভ, নিভৃতবাসে যেতে বলা হল উদ্ধারকারীদের
আর যাঁদের জন্য এই পরিবর্তন, কী ভাবছেন তাঁরা? সঙ্কেত-অনুবাদকের মাধ্যমে শ্রবণে সমস্যাযুক্ত রবীন্দ্রনাথ সরকারের (সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ প্রশিক্ষকও বটে) বক্তব্য, ‘‘যাঁরা শুনতে পান, কথা বলতে পারেন, তাঁরা যেমন ঠিক সময়ে সমস্ত তথ্য পাচ্ছেন, আমরাও যেন তা পাই। এটা আমাদের সুরক্ষার প্রশ্ন!’’