লোকসভায় ট্রাই আইন সংশোধন নিয়ে দু’দিন আগেই কেন্দ্র-বিরোধিতায় সরব হয়েছিল তৃণমূল। আজ সেই অবস্থান থেকে কার্যত একশো আশি ডিগ্রি ডিগবাজি খেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাশেই দাঁড়ালো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল!
প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নিয়েই ট্রাইয়ের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নৃপেন্দ্র মিশ্রকে তাঁর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগের জন্য ট্রাই আইনে সংশোধনের প্রস্তাব করে অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন মোদী। ট্রাই আইন সংশোধন করার প্রয়োজন ছিল, কারণ ওই সংস্থার আইন অনুযায়ী তাদের কোনও চেয়ারম্যান অবসরের পরে সরকারি কোনও পদে যোগ দিতে পারবেন না। মোদী-সরকারের এই অর্ডিন্যান্স জারি করা এবং আইন সংশোধনের চেষ্টা নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক এবং বিরোধিতা তৈরি হয়।
গত শুক্রবার এই সংশোধনীটি সরকার লোকসভায় আনার সময়েই তার বিরোধিতা করে একটি বিধিসম্মত প্রস্তাব দেন তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায়। সরকারের এই প্রয়াসের তীব্র বিরোধিতা করে তিনি বলেন, আইন বদলের সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তাই নেই। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পছন্দের লোককে পদে বসাতে আইন বদল নিন্দনীয়।
কিন্তু বিরোধিতার এই ছবি বদলে যায় আজ। সকালে লোকসভায় দাঁড়িয়ে তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একটি দায়িত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল হিসেবে তৃণমূল মনে করে, প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ করার। দেশের প্রশাসনিক স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের আপত্তি থাকার কোনও কারণ নেই। আমরা এই আইন সংশোধনকে সমর্থন করছি।”
স্বাভাবিক ভাবেই এর পরে রাজধানীতে প্রশ্ন উঠেছে, দু’দিনের মধ্যে তৃণমূলের এই অবস্থান বদল কেন? সৌগতবাবু আজ নিজেই জানান, শুক্রবার তিনি যে বিবৃতি এবং প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে। এ ব্যাপারে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি তাঁর। পাশাপাশি তিনি বলেন, আইন মেনে বিলটি আনার সময় তিনি একটি আপত্তি জানিয়েছিলেন মাত্র।
তৃণমূল সূত্রের খবর, সৌগতবাবুর বিরোধিতার বিষয়টি কানে আসার পর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন মমতা। সুদীপবাবুকে তিনি জানান, এ নিয়ে মোদী সরকারের সঙ্গে কোনও রকম সংঘাতে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না।
অনেকেই মনে করছেন, পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশ্নে মমতা এবং বিজেপি দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে চলছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই চালালেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাটাও তাঁর অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দুই বিরোধী, কংগ্রেস এবং সিপিএমের বক্তব্য, কেন্দ্র যে ভাবে বন্দর কেলেঙ্কারির মতো নানা ঘটনায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে চাপ বাড়াচ্ছে, তাতে উদ্বেগ বাড়ছে মমতার। ফলে তাঁকে বিজেপির সঙ্গে আপসের পথে হাঁটতে হচ্ছে।
দলীয় সূত্রের বক্তব্য, তৃণমূলের সংসদীয় দলের মধ্যেই দু’টি ভাগ। একটি ভাগ বিজেপি-র সঙ্গে যে কোনও প্রকারে যুদ্ধংদেহী আচরণ নিয়ে এগোতে চায়। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদের মতো সাংসদেরা। অন্য দিকে, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ একাধিক নেতা বিজেপি তথা অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের প্রাপ্য আদায় করার পথে চলেন। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রী কিন্তু এই দু’টি অংশের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলারই পক্ষপাতী।
আজ সংসদে ট্রাই আইন সংশোধন বিতর্কে তৃণমূলের আচমকা অবস্থান বদলকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি কংগ্রেস ও সিপিএম। এআইসিসি নেতা শাকিল আহমেদ বলেন, “নাগপুরের সঙ্গে কালীঘাটের কী যোগাযোগ চলছে, জানি না! সংবাদমাধ্যমেরই অনেকে বলছেন, সারদা কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত নিয়ে তৃণমূল উদ্বিগ্ন। এই যুক্তি ফেলা যাচ্ছে না। হতেই পারে, এই কারণে তৃণমূল এত বিপ্লব দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত আপসের পথে হাঁটল!”
কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, “তৃণমূলের বক্তব্য, তাঁরা কোনও ব্যক্তি নিয়োগের বিরুদ্ধে নন। একই অবস্থান কংগ্রেসেরও। তবে তার সমান্তরালে কংগ্রেস নৈতিকতার প্রশ্নও তুলতে চাইছে।” তাঁর কটাক্ষ, সিবিআই তদন্তে তৃণমূল এতটাই জুজু দেখছে যে, নৈতিকতাকেও বিসর্জন দিয়ে দিল! সিপিএমের মহম্মদ সেলিম বলেন, “এর আগে ভোটের সময় দেখেছি, মমতা মোদীকে আক্রমণ করছেন। কিন্তু যখনই সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ এল, তখনই দেখলাম মমতা বদলে গেলেন!”