বুধবার লোকসভার হামলার সেই মুহূর্ত। ছবি: পিটিআই।
মুহূর্তের জন্য হলেও যেন ফিরে এল বাইশ বছর আগের আতঙ্কের স্মৃতি।
এক সময় নিয়ম ছিল কোনও সাংসদের মৃত্যুসংবাদ এলে, পরের দিন অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যেত। বাইশ বছর আগের সেই তেরো তারিখে আমাদের অনেককেই বাঁচিয়ে দিয়েছিল এক সাংসদের মৃত্যুসংবাদ। অধিবেশন মুলতুবি হওয়ায় জঙ্গিরা হামলা করার আগেই বহু সাংসদ বেরিয়ে যান। সংসদ প্রায় ফাঁকা
হয়ে যায়।
আমি তখন তৃণমূলের লোকসভার মুখ্য আহ্বায়ক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলনেত্রী। আমরা কিন্তু বাড়ি ফিরে যাইনি সে দিন। সেন্ট্রাল হলের কোণে কয়েক জন গল্প করছিলাম। হঠাৎই কান ফাটানো আওয়াজ বাইরে। যেন অকাল দীপাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে। মুহূর্তেই ভুল ভাঙে। লালকৃষ্ণ আডবাণী তখন সংসদে। তাঁর অফিস থেকে সেন্ট্রাল হলে বসা সাংসদদের কাছে দফায় দফায় নির্দেশ আসছে, কেউ যেন বাইরে না পা রাখেন। এমনকি, হল থেকেও বেরোনো যাবে না। মনে হচ্ছিল, মূল ফটক থেকে সোজা যে রাস্তাটি সেন্ট্রাল হলে পৌঁছেছে (পুরনো ভবনের) সেটা দিয়ে জঙ্গিরা ঢুকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করবে বুঝি। কিন্তু ততক্ষণে নিরাপত্তারক্ষীরা অপরিসীম দক্ষতায় তাদের ভিতরে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আজ লোকসভায় আমার মতো খুব কম সাংসদই রয়েছেন, যাঁরা সে দিনও ছিলেন। সেই ১৩ তারিখেই যে আবার সংসদ আক্রান্ত হবে, এমন কেউ কি ভাবতে পেরেছিলাম? আজ দুপুরে অধিবেশনের মধ্যে হঠাৎই বিকট আওয়াজে মনে হল, রেলিং ভেঙে পড়ল নাকি! উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, লাফিয়ে নেমে কিন্তু টাল সামলে এক যুবক অনায়াস দক্ষতায় একটার পর একটা সারি টপকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই কাণ্ড করা সম্ভব নয় যদি না প্রশিক্ষণ থাকে।
তখন অবশ্য এত ভাবার সময় নেই, কারণ আরও এক জন লাফিয়ে নেমেছে। সাংসদদের কয়েক জন ছুটে দিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছেন। সবই ঘটছে কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে। রক্ষীদের তখনও দেখা নেই। এই আতঙ্ক আমাদের গ্রাস করেছে যে এই ব্যক্তিরা সশস্ত্র কি না। তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে কি না। এক জনকে দেখলাম জুতো খুলছে। এরপরই হলদেটে ধোঁয়ায় যখন লোকসভা আচ্ছন্ন, পিছন থেকে কাকলি ঘোষদস্তিদার চিৎকার করে আমায় বলতে লাগলেন, “সুদীপদা বেরিয়ে আসুন, বিস্ফোরণ হতে পারে।”
সেই ধোঁয়ায় ততক্ষণে আমার শ্বাসের সমস্যা শুরু হয়ে গিয়েছে। গেটের কাছে এসে দেখি, কংগ্রেস সাংসদেরাও রাহুলকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। জানতে চাইলাম ওঁর মতামত। রাহুল বলেন, “আমার মনে হয় কোনও বিষয় নিয়ে এদের কোনও দাবি রয়েছে, তাই প্রতিবাদ জানাতে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”
বাইরে এসে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে যেন স্বস্তি এল। এর সঙ্গেই ভাবছিলাম, এত হাঁকডাক করে তৈরি করা নতুন ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই ঠুনকো! স্বাধীনতার পরে লোকসভার ভিতরে এমনটা আগে তো কখনও ঘটেনি। বাইশ বছর আগেও নিরাপত্তারক্ষীদের অসামান্য বীরত্বের জন্য জঙ্গিরা ঢুকতে পারেনি অধিবেশন কক্ষ পর্যন্ত। আজ অল্পের উপর দিয়ে বড় ফাঁড়া কাটল আমাদের।