মৌসম নুর —ফাইল চিত্র।
বড়দিনের আগে শীত পড়েছে জমিয়ে। আর এই ঠান্ডায় কংগ্রেসের প্রতি তৃণমূলের ‘অ্যালার্জি’ আর নিছক ‘অ্যালার্জি’ নেই। তা বেড়ে পরিণত হতে চলেছে বড় ধরনের অসুখে!
সদ্যসমাপ্ত শীতকালীন অধিবেশনে প্রায় ১৫০ জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করার প্রতিবাদে বিরোধীদের মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ যখন দিল্লির যন্তর মন্তরে জনসভা করছে, তখন এ কথা জানালেন তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতাই। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “এই ঠান্ডায় ব্যাপারটা আর অ্যালার্জি নেই, বড় অসুখের দিকে চলে গিয়েছে।”
এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল শুক্রবার সকালেই। ‘ইন্ডিয়া’র সমস্ত দলের অন্তত এক-দু’জন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-সাংসদ উপস্থিত ছিলেন প্রতিবাদসভার মঞ্চে। তার মধ্যে ছিলেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়্গে, এনসিপি-র শরদ পওয়ার, সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি, আরজেডি-র মনোজ ঝা, ডিএমকে-র তিরুচি শিবার মতো নেতারা। অথচ সাসপেন্ড হওয়া সাংসদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই কর্মসূচিতে একমাত্র প্রতিনিধি মৌসম নুর। তা-ও আবার তিনি বক্তৃতা দিলেন নামমাত্র। মেরেকেটে কয়েক লাইন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, যাঁকে কোনও জোট বৈঠক তো দূরস্থান, সংসদীয় কক্ষ সমন্বয়ের আলোচনা বা দলীয় কৌশলের বৈঠকেও সে ভাবে দেখা যায় না, সেই মৌসমকে আজকের এই ‘হাই প্রোফাইল’ মঞ্চে পাঠিয়ে কী বার্তা দিতে চাইল তৃণমূল?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আলোচনা করে সংবাদমাধ্যম মারফত বার্তা দিচ্ছে, বাংলায় নাকি তারা ৭ থেকে ৯টি আসন চায়। এ সব আকাশকুসুম কল্পনা। রাজনৈতিক কোনও যুক্তি নেই। গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ৩ শতাংশ ভোটও পায়নি। রায়গঞ্জ বা অন্য আসন ছেড়ে দিন, বাংলা থেকে কংগ্রেসকে দু’টির (মালদহ-দক্ষিণ এবং বহরমপুর) বেশি আসন দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।’’ তাঁর দাবি, ‘‘বাংলায় আমাদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কোনও প্রয়োজনই নেই। বাংলায় যদি সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেস একসঙ্গে লড়তে চায়, তা হলে লড়ুক। তাতে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।” তৃণমূল সূত্রের মতে, সম্প্রতি দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকের মঞ্চে যখন মমতা নিজে কথা না বলে ডেরেক ও’ব্রায়েনকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে শীতল অবস্থান নিচ্ছেন।
এ দিন দলের শীর্ষ পর্যায়ের কাউকে না পাঠিয়ে মৌসমকে পাঠানোর আরও একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এক নেতার কথায়, ‘‘এ সব কি ছেলেখেলা হচ্ছে? আমরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে দিল্লির ‘ইন্ডিয়া’ বৈঠকে বলেছিলাম তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এবং সেই তিনটির প্রত্যেকটিই হল আসন রফা। তা না হলে, কোনও জনসংযোগ অনুষ্ঠানে আমরা যাব না। আমাদের তারিখও দেওয়া রয়েছে৩১ ডিসেম্বর। বৈঠকের পরে তিন দিন কেটে গিয়েছে। আমরাসংবাদমাধ্যমে একটি সংখ্যা (পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের চাহিদা) শুনতে পাচ্ছি। তা অবাস্তব। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনও কথা আমাদের সঙ্গে বলেননি।”
ঘটনা হল, দু’দিন আগে রাহুল এবং খড়্গে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের দিল্লিতে ডেকে কথা বলেছেন। তাঁদের চাহিদা রাজ্যে ৯টি আসনে লড়াই করা, তবে দর কষাকষির খাতিরে ৬ বা ৭টি আসনেও প্রদেশ কংগ্রেস নামতে রাজি বলে সূত্রের খবর। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, দর কষাকষির ক্ষেত্রে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল (সংখ্যার হিসাবে), তারা প্রথমে যে সংখ্যাটি বলে, ক্রমশ তার থেকে কিছুটা পিছু হটে এবং কিছুটা কমে রাজি হয়। এটাই আসন রফার স্বাভাবিক ধরন। প্রশ্ন হল, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে আসন রফা তথা সামগ্রিক ভাবে ‘ইন্ডিয়া’য় অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনই কেন এত কড়া অবস্থান নিচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্ব?
প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ এবং বামেদের অভিযোগ, মমতা আসলে গোড়া থেকেই সমমনস্ক দলগুলির সঙ্গে জোট তৈরির পক্ষে ছিলেন না। তাঁর উদ্দেশ্য কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানো নয়, বরং রাজ্যে নিজের অবস্থান সুরক্ষিত রাখা। দলের ক্রমশ প্রকাশিত দুর্নীতিকে আড়াল করা। জোট-বিরোধী ভাষ্য তৈরি করে, হঠাৎ করে খড়্গেকে প্রধানমন্ত্রী-মুখ হিসেবে তুলে ধরার মতামত জানিয়ে এবং আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ম মতো স্পষ্ট করে আদতে রাজ্যে বিজেপিরই সুবিধা করে দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী। বাম নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এ কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অফিস দেখার সময়ে তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতাও করেছেন মমতা। সেখানে কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলেই তাঁদের দাবি।