নোবেল জয়ের খবর আসার পরে নিজের দফতরে কৈলাস সত্যার্থী। নয়াদিল্লিতে শুক্রবার। ছবি: রয়টার্স।
খনির সেই অন্ধকারটা আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে গিয়ে প্রতিদিন তাকে নামতে হতো অভ্র খনির ৩০০ ফুট গভীরে। মনে মনে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছিল সে, বেশি দিন আর এই কষ্ট সহ্য করতে হবে না। শরীরের ভিতরটা তো একটু একটু করে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিল! অভ্র যে খুব ক্ষতিকর। ধস নামারও ভয় রয়েছে। বন্ধুকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে সে। ন’বছর আগে এই অন্ধকূপ থেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন মাঝবয়সি একটি মানুষ। সে দিনের সেই ত্রাতা কৈলাস সত্যার্থী, আজ শান্তির নোবেল-জয়ী। আর সেই খুদে মানান? এখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বললেন, “যে দিন উনি আমায় বাঁচিয়েছিলেন, সেই দিনটাই ছিল এ পর্যন্ত আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। আজ ফের সেই আনন্দটা অনুভব করছি। বিশ্বাস করুন, আগে কখনও এত খুশি হইনি!”
মানান একা নন। তাঁর মতো আরও কত শত মুখে আজ এই এক উচ্ছ্বাস। গত চৌত্রিশ বছরের লড়াইয়ে এই ১২৫ কোটির দেশে কম করে আশি হাজার শিশুকে রক্ষা করেছিলেন যে মানুষটি, তাঁকেই আজ সেরার শিরোপা দিয়েছে বিশ্ব। তবে বছর ষাটের কৈলাস সত্যার্থীর মতে, এ সম্মান তাঁর নয়। বললেন, “আজকের আধুনিক পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ শিশু ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। নোবেল কমিটি আজ তাদের আর্তিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে। সম্মান জানিয়েছে ওই নিষ্পাপ মুখগুলোকেই।”
এ হেন কৈলাসকে এ দেশের বহু মানুষই কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও চিনতেন না। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সম্মান মিললেও, দেশের মাটিতে তেমন কোনও খেতাবই জোটেনি তাঁর। আড়ালে থেকেই নিজের মতো করে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন কৈলাস। সে সংগ্রাম খানিক গল্পের মতোই!
কাহিনির শুরু ১৯৮০ সালে। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কৈলাস ঠিক করেন চাকরি ছেড়ে শিশুশ্রম বিরোধী লড়াইয়ে নামবেন। পরিকল্পনা মাফিক দিল্লিতে তৈরি করে ফেলেন নিজের সংস্থা ‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন’। মধ্যপ্রদেশের বিদিশার বাসিন্দা কৈলাসের তখন মাত্র ২৬ বছর বয়স। এর পর ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেন স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। কৈলাস ঠিক করেন, এমন একটা কিছু করবেন, যাতে শিশুদের দিয়ে তৈরি করা জিনিস দেশীয় বা আন্তর্জাতিক বাজারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আইনকে অস্ত্র করেই লড়াই শুরু করেন তিনি। সফলও হন। খুদে খুদে আঙুলে ছোটদের দিয়ে কার্পেট তৈরি এ দেশে বরাবরই হয়ে এসেছে। অত নিখুঁত কাজ বড়দের দ্বারা অসম্ভব। তাই বাজারে শিশু-শ্রমিকের চাহিদা ছিল বেশ। বিশ্ব বাজারে চড়া দামে বিক্রিও হতো ওই সব শৌখিন কার্পেট। কৈলাসের হাত ধরেই আসে ‘রাগমার্ক’। কার্পেট তৈরিতে যে শিশুশ্রম ব্যবহার করা হয়নি, কার্যত তারই সিলমোহর হয়ে ওঠে এই ‘রাগমার্ক’।
সাফল্যের স্বাদ মিলতেই আরও এক ধাপ এগোন কৈলাস। এ বার ঠিক করেন, যে করেই হোক, শিশু-বিক্রি বন্ধ করবেন। পেটের দায়ে, কখনও আবার ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে নামাতে বহু বাবা-মা বেচে দেন নিজের সন্তানকে। এ ‘রোগে’ গ্রামগুলোই বেশি আক্রান্ত। কৈলাস সমীক্ষা করে দেখেন, ৭০ শতাংশ শিশুশ্রমিকই গ্রাম থেকে শহরে আসে কাজের সন্ধানে। গ্রামগুলোকেই তাই লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে বেছে নেন কৈলাস। শুরু করেন তাঁর নতুন অভিযান ‘বাল মিত্র গ্রাম’। শিশুশ্রম রোধ, শিশু অধিকার রক্ষা ও সর্বশিক্ষা অভিযান এই তিন উদ্যোগকে এক সুতোয় বাঁধেন তিনি। এ বারেও সাফল্য এসে ধরা দেয়।
গত তেরো বছরের চেষ্টায় রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড-সহ আরও ন’টি রাজ্যের ৩৫৬টি গ্রামকে ‘শিশু-বান্ধব’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন কৈলাসরা। স্কুলমুখো করেছেন খুদেদের। স্থানীয় সমস্যার সঙ্গে যুঝতে তৈরি করেছেন যুব-দল। ছোটদেরও সামিল করেছেন পঞ্চায়েতে। এ সবের পাশাপাশিই শহরের আনাচে-কানাচে হানা দিয়ে চলেছে শিশু-উদ্ধার অভিযান। ঠিক যে ভাবে কোডার্মার অভ্র-খনি থেকে কৈলাস উদ্ধার করেছিলেন মানানকে। চলতে থাকে প্রচার-অভিযানও। সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কৈলাস দারিদ্র, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, জনবিস্ফোরণ, এই সবের জন্য দায়ী শিশুশ্রম। ভবিষ্যৎ যে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবেই!
আক্রান্ত হয়েছেন বহু বার। কখনও পাচারকারী, কখনও বা দোকানমালিকের হাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। বছর তিনেক আগে দিল্লির এক কাপড়ের দোকান থেকে একটি বাচ্চাকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন কৈলাস ও তাঁর সহকর্মী। ২০০৪ সালেও সার্কাস-মাফিয়াদের হাত থেকে কিছু বাচ্চাকে উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হন কৈলাসরা। বহু বার ভাঙচুর হয় তাঁদের অফিসও। তবু থেমে থাকেনি লড়াই।
আজ নোবেল-জয়ের খবর আসার পর কৈলাস বললেন, “মানবতাই আজ কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এখনও অনেক কাজ করা বাকি। তবু এ আশায় বাঁচি, এ জীবনে এর শেষ দেখে যাব।”